সম্পাদকীয়

 

'রক্তদান, মহৎ দান'...

একটা পোস্টার, সেখানে বড় করে একফোঁটা রক্তের ছবি, একটি শিশুর নিষ্পাপ মুখ, একটা প্রশ্ন, 'যার রক্ত আমার জীবন বাঁচিয়েছে, সে কি তুমি?'

১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত, স্বেচ্ছা রক্তদান যে একটা সামাজিক প্রকল্প, মহৎ উদ্যোগ - সে সম্পর্কে ঠিকমতো অবহিত ছিলাম না। পরবর্তীকালে জেনেছি, গরীবলোকেরা অর্থের বিনিময়ে হাসপাতালে রক্তদান করে। খবরের কাগজে দেখেছি, একেক জন এমনও আছেন, যাঁরা শতাধিক বার স্বেচ্ছা রক্তদান করেছেন। এখানে মাহাত্ম্য যতো না বড় ভূমিকা নিয়েছে, দারিদ্র্য তার চেয়েও প্রবলতর ভূমিকা নিয়েছে। ফলতঃ অসুস্থ, দুঃস্থ লোকের রক্ত হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে বেশি জমা পড়েছে।

আমাদের মতো বহু মানুষ শরীরে রক্ত বয়ে নিয়ে বেরিয়েছে, স্বেচ্ছা রক্তদানের সহজ, সুলভ পরিসর না পাওয়ায় অথবা এ ব্যাপারে ঠিকমতো অবগত না হওয়ায় তাঁদের আর রক্তদান করা হয়ে ওঠেনি। তার ফল সমাজকে ভুগতে হয়েছে। একটা অতি প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিজীবনের কথা, এখানে উল্লেখ না করে পারছি না।

১৯৯২ সালে আমার মা যখন ডাক্তার সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে সিরোসিস অফ লিভার নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, ডাক্তারবাবু তখন একটা কথাই বলেছিলেন, "গাড়ি গ্যারেজ হয়ে গেছে, দেখুন কতদিন বাঁচাতে পারেন"। তখন দেখেছি প্রায় প্রতিদিনই এক বোতল রক্ত লাগত, মেডিকেল কলেজের ব্লাড ব্যাংক, মানিকতলার ব্লাড ব্যাংকে ঘুরে বেড়িয়েছি রক্ত সংগ্রহ করতে। ওঁরা জিজ্ঞাসা করেছেন, ডোনার'স কার্ড আছে? চুপ করে থেকেছি। আমরা ভাইয়েরা তো কোনোদিন স্বেচ্ছায় রক্ত দিইনি। যাই হোক সাত দিন বাদে দেখলাম, আমার মা'র এইচআইভি হয়েছে। সিনিয়র ডাক্তার জুনিয়রদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই পেশেন্টকে অ্যাভয়েড করে চলো। মা তার দু'দিন বাদে মারা যান। তখন মনে মনে ঠিক করলাম, এবার সুযোগ পেলেই রক্তদান করবো।

আমার ৬০ বছর বয়স হতে তখনও ১০ বছর বাকি ছিল। সল্টলেকে এসে, এই সময়ের মধ্যে রক্ত দেওয়ার সুযোগ পাইনি। যখন সুযোগ পেলাম, তখন ৬০ বছর অতিক্রান্ত, তাই আর রক্ত দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ এ জীবনে আর রক্ত দেওয়া যাবে না।

এখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়, বড়ো অপরাধী। যখন দেখি স্বেচ্ছা রক্তদানের মতো মানবিক আয়োজন কোথাও নেওয়া হচ্ছে, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি। কেউ রক্ত দিচ্ছে, এই দৃশ্য দেখলে, সেই মহৎ রক্তদাতাকে অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণতি জানাতে থাকি।

শুভ সামাজিক, মানবিক প্রচেষ্টা, বিশেষ করে রক্তদানের মতো মহতী প্রয়াস যেখানে হবে, 'সমন্বয়' ওয়েব ম্যাগাজিন প্রাথমিকতা দিয়ে সেই নিউজ কভার করবে। সামাজিক, মানবিক দায়িত্ব পালনের বৃহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই 'সমন্বয়' পত্রিকার আবির্ভাব, ভবিষ্যতেও সেই নির্দিষ্ট অভিমুখে তার পথ চলা জারি থাকবে।

একটা কঠিন সত্য আমাদের অনেকের অজানা তা হলো, "বাঙালি জাতি হিসেবে বহু ক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে পথ দেখিয়েছে, স্বেচ্ছায় রক্তদানের ক্ষেত্রেও আজ ভারতকে পথ দেখিয়ে চলেছে।"

সুদীপ কুমার ধর
সম্পাদক, সমন্বয়

১৫ জুলাই, ২০২৩