কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
(১২.১০.১৯২৪ - ০৫.০৪.২০০০)
শতবর্ষে কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম সোনামুখী, বাঁকুড়া। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মাতা অনিলা দেবী। বাড়ির দেওয়া নাম অণিমা মুখোপাধ্যায়, ডাক নাম মোহর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম অণিমা বদলে রাখেন 'কণিকা'। অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাকতেন 'আকবরী মোহর' বলে। গানের শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শান্তিদেব ঘোষ, অনাদি দস্তিদার, অমিতা সেন, রমা করের কাছে রবীন্দ্রসংগীত; ভি. ভি. ওয়াজেলওয়ার, পি. এন. চিনচোর, ধ্রুবতারা যোশি, হেমেন্দ্রলাল রায় ও অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মার্গসংগীত; হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অতুলপ্রসাদী; ফিরোজা বেগম, কমল দাশগুপ্তের কাছে নজরুলগীতি; প্রকাশকালী ঘোষাল, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে ভজন শিখেছেন। প্রথাগত শিক্ষা বিশ্বভারতীর পাঠভবন ও শিক্ষাভবন থেকে। একদা সংগীত ভবনের ছাত্রী, ১৯৪৩ সালে সংগীত ভবনের কাজে যোগদান করেন। রবীন্দ্রসংগীত ও নৃত্য বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে অধ্যক্ষা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রথম গানের রেকর্ডিং করেন ১৯৩৮ সালে নীহারবিন্দু সেনের কথায় ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে। আধুনিক গান রেকর্ড করায় রবীন্দ্রনাথ খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। ওই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে 'হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি' থেকে দুটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন। 'না না, ডাকব না' ও 'মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে'। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় 'ওগো তুমি পঞ্চদশী', 'ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে', 'ওই মালতীলতা দোলে' ও 'এসো শ্যামল সুন্দর' রেকর্ড করেছেন, যা রবীন্দ্রনাথ শুনে গেছেন।
নাট্যাভিনয়ে তাঁর সবিশেষ দক্ষতা ছিল। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময় 'শ্যামা' নৃত্যনাট্যে তাঁর গান বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। 'মায়ার খেলা', 'তাসের দেশ', 'চিত্রাঙ্গদা', 'কালমৃগয়া' প্রভৃতি নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যের রেকর্ড তাঁকে চিরস্মরণীয় করে দেয়। 'তথাপি', 'নিমন্ত্রণ' ও 'বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা' ইত্যাদি চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে' গানটির জন্য তিনি 'বিএফজেএ'-র শ্রেষ্ঠ গায়িকার সম্মান পান। তাই অ্যান্ড্রুজ পল্লীতে তাঁর বাড়ির নাম রাখেন 'আনন্দধারা'। গ্রামোফোন কোম্পানি 'গোল্ডেন ডিস্ক' দিয়ে সম্বর্ধনা দেয়। পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি, শিরোমনি, আলাউদ্দিন পুরস্কার, লাভ করেছেন 'পদ্মশ্রী' উপাধি, বিশ্বভারতীর 'দেশিকোত্তম' সম্মান। স্বামী বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে প্রকাশ করেছেন তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর বই। 'রবীন্দ্রসংগীতের ভূমিকা', 'রবীন্দ্রসংগীতের নানাদিক' ও 'রবীন্দ্রসংগীত - কাব্য ও সুর'। নিঃসন্তান এই শিল্পী জীবনের শেষ দিকে গ্রামীণ উন্নতির জন্য সমাজসেবামূলক কাজে নিরলসভাবে যুক্ত ছিলেন।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, ১৯৩৭ সালে কলকাতার ছায়া সিনেমা হলে বর্ষামঙ্গল উৎসবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে' গানটি গেয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ মতো 'সমুখে শান্তি পারাবার' গানটি প্রথমবার যে বৃন্দদল গেয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোলকাতা পৌরসভা এই কিংবদন্তি শিল্পীর স্মৃতিতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে বিশাল সুরম্য উদ্যানটির নাম রাখে 'মোহরকুঞ্জ'।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জন্মশতবর্ষে এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে জানাই অন্তরের শতকোটি প্রণাম।
উৎসঃ সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান।
১৫ নভেম্বর, ২০২৩