সম্পাদকীয়

 

সুচিত্রা মিত্র
(১৯.০৯.১৯২৪ - ০৩.০১.২০১১)

ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান

তাঁর আবক্ষ মূর্তি গড়েছেন শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, তাঁকে নিয়ে প্রামান্য চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন সুব্রত ঘোষ ও রাজা সেন, ওস্তাদ আমজাদ আলী খান বলেছেন, 'রবীন্দ্রনাথের এক উজ্জ্বল প্রতীক', ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, 'তিনি নিখুঁত, মনে হয়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝি ফিরে এলেন', আজকাল পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁর আত্মকথা 'মনে রেখো'। তাঁকে নিয়ে অনেকেই কবিতা লিখেছেন, তাদের অন্যতম বিষ্ণু দে ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। নীরেনবাবুর কবিতাটা শোনাই এখানে -
"আকাশ যখন চক্ষু বোজে
অন্ধকারের শোকে
তখন যেমন সবাই খোঁজে
সুচিত্রা মিত্রকে,
তেমন আবার কাটলে আঁধার
সূর্য উঠলে ফের
আমরা সবাই খোঁজ করি কার?
সুচিত্রা মিত্রের।
তাঁরই গানের জ্যোৎস্নাজলে
ভাসাই জীবনখানি 
তাই তো তাকে শিল্পী বলে
বন্ধু বলে জানি।
"

রামায়ণের অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝার উত্তরসূরি বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ও সুবর্ণলতা দেবীর কন্যা সুচিত্রা নিবিড় রবীন্দ্র আবহে বড় হয়ে ছিলেন। বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা, গানের আসর হতো, বিশেষকরে রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা ছিল, মা সুবর্ণলতা দেবীও রীতিমতো একজন সুগায়িকা ছিলেন।

পঙ্কজ মল্লিকের গানে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, চিরদিনের জন্য রবীন্দ্র সংগীতের বৃত্তে বাঁধা পড়ে যান। দশম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে, বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত ভবনে ভর্তি হন। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহে প্রাইভেটে ম্যাট্রিকুলেশন ও ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণ হন। 1945 সালে শান্তিনিকেতন থেকে সঙ্গীতে ডিপ্লোমা নিয়ে, স্কটিশচার্চ কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সম্মানের সঙ্গে বি.এ পাশ করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি রিডার, অধ্যাপক ও রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের প্রধান হন। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন সময়ে তিনি বাংলা নিয়ে এম.এ পাশ করেন।

বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় গানের চর্চা শুরু করেন দুই শিক্ষক অমিতা সেন ও অনাদি কুমার দস্তিদারের মাধ্যমে। শান্তিনিকেতনে এসে যাঁদের কাছে গান শিখেছেন তাঁদের অন্যতম ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, ভি ভি ওয়াঝেলকর প্রমুখ। রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়াও তার গলায় প্রান পেয়েছে অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক গান ও হিন্দি ভজন।

বহুমুখী প্রতিভার এই শিল্পী শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন একক ও সমবেত সঙ্গীতে এবং গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে নিয়মিত অংশ নিতেন। স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াকালীন ছাত্র রাজনীতি ও সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে অভিযুক্ত বন্দিদের মুক্তির দাবীতে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে কারারুদ্ধ হন। ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন।

1945 সালে মাত্র 21 বছর বয়সে এইচ.এম.ভির মাধ্যমে প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড করেন সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় নামে। গান দুটি ছিল, 'অশ্রুনদীর সুদূর পারে' ও 'হৃদয়ের একূল ওকূল'। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সংযোগে গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে, নবজীবনের গান গেয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথায় ও সুরে। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়ে অত্যন্ত সাবলীল ও দক্ষ ছিলেন। একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। 1952 সাল থেকে প্রতি বছর রবীন্দ্র সংগীতের গানের রেকর্ড করেছেন। রবীন্দ্র গানের রেকর্ডে, রেকর্ড করেছেন। শিশু সাহিত্য ও সংগীতের ওপর তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। ছবি আঁকার নেশা ছিল, একাধিক চিত্র প্রদর্শনী করেছেন।

জীবনে যে উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি ও সম্মান অর্জন করেছেন, যথাক্রমে সেগুলি হলো - 'টেগোর হিম প্রাইজ', নিখিল বঙ্গ সংগীত সম্মেলনে স্বর্ণপদক, 'পদ্মশ্রী' সম্মান, 'পঙ্কজ মল্লিক স্মৃতি পুরস্কার', 'গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড', 'সঙ্গীত নাটক একাদেমি পুরস্কার', 'শিরোমণি' পুরস্কার, 'দেশিকোত্তম' পুরস্কার, 'আলাউদ্দিন' পুরস্কার, বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট., কলকাতার প্রথম মহিলা শেরিফ ইত্যাদি।

নিজ উদ্যোগে ও সমরেশ চৌধুরীর সহযোগিতায় গড়ে তোলেন 'রবিতীর্থ', এক প্রামান্য সংগীত প্রতিষ্ঠান, যার নামকরণ করেছিলেন ঐতিহাসিক ও রবীন্দ্র গবেষক কালিদাস নাগ এবং প্রথম দিন থেকে যার অধ্যক্ষা ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। এই প্রতিষ্ঠান তাঁর নেতৃত্বে সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের কর্মকান্ডের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের প্রধানা ও রবিতীর্থের অধ্যক্ষা হিসেবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গীত জগতের পরিমন্ডলে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন এবং পেছনে ফেলে রেখে গেছেন অজস্র গুণমুগ্ধ অনুরাগীদের।

স্মৃতি বিজরিত জন্মশতবর্ষে সুচিত্রা মিত্রের উত্তরপুরুষেরা এই উপলব্ধিতে অটল, "রবীন্দ্র সংগীতের জগতে সুচিত্রা মিত্র বহুবিধ ধারার ভূমিকায় ও প্রশংসনীয় কীর্তিতে চিরভাস্বর হয়ে থেকে গেছে।

অপরদিকে বঙ্গ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর ঈর্ষণীয় অনায়াস সফল বিচরণ, সর্বস্তরে স্বীকৃতি ও চিরস্থায়ী অবদান অতি দ্রুত তাঁকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দিয়ে গেছে।"


সূত্রঃ সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান

১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩