সম্পাদকীয়

 

আ মরি বাংলা ভাষা...

এমন মিষ্টি ভাষাকে ভালো না বেসে থাকা যায়! এও কি সম্ভব! এই ভাষাকে ভালবাসায় রূপান্তরিত করতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লক্ষ লক্ষ লিখন কুশীলবেরা যে সারস্বত সাধনায় মগ্ন থেকেছেন, তাকে কোনো শক্তি পরাভূত করতে পারে না। এমন নয়, কোনো অপশক্তি সে চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছিল, ফলশ্রুতিতে আমরা নতুন দেশ পেয়েছি, আমরা বাংলায় আরেকটা জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি, শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর সমস্ত জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি" দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, বাঙালি হিসেবে আমরা আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেই পারি।

১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ছাত্রদের প্রাণদান, ভাষার প্রতি বাঙালির গভীর ভালোবাসার দ্যোতক। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল হওয়ার কারণে 'ইউনেস্কো' ১৯৯৯ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাও বাঙালির গভীর আত্মশ্লাঘার বিষয়।

"ফাগুন এলেই  একটি পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা
নাম দিয়েছি ভাষা, কত নামেই 'তাকে' ডাকি
মেটে না পিপাসা।"

পিপাসার্ত বাঙালির সংখ্যা পৃথিবীজুড়ে আজ ৩০ কোটি। সংখ্যা তথ্যের সারণীতে বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম স্থানে। এটাও বাঙালির আত্মশ্লাঘার বিষয়।

"আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন - এই বাংলায় খুঁজে পাই
বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।

আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি
আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।"

এই বাংলার মুখ দেখার জন্য শুধু ইংল্যান্ড, আমেরিকা নয়, ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, পোলান্ড, চেক ছাড়াও চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পড়াশোনা ও চর্চা চলছে। বাংলা ভাষার প্রতি পৃথিবীজোড়া এই আগ্রহ, বাঙালির আত্মশ্লাঘার বিষয় বৈকি!

জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের একটা বড় অংশ ইংরেজিকে প্রথম ভাষা, কেউ কেউ হিন্দিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এতে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। জীবনানন্দ ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেও, আজকের বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম কবি। হয়তো এসব অনেক বিতর্কের বিষয়। বিচারের ভার ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। সময়ের পরিক্রমায় তবু ফেব্রুয়ারি মাস আসবে, আর বাঙালি হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ভুলে যাবো এতো অকল্পনীয় বিষয়। আমরা নিয়ত স্মরণে রাখব একুশের ভাষা আন্দোলন আর কণ্ঠ মেলাব বাঙ্গালী অস্মিতার আবেগে -

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।"

আমরা ভুলব না, ভুলতে চাই না। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার উত্তোরণে আমাদের প্রত্যেকের সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। এটা সর্বজন স্বীকৃত, বাঙালির মেধা আছে। তার কিছুটা অংশ যদি নিরলস শিল্প-সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত থাকে, আমাদের আশঙ্কার কোনো কারণ থাকে না।

'সমন্বয়' মাসিক ই-পত্রিকা এই সদর্থক ভূমিকা নিতে এগিয়ে এসেছে। নতুন লেখকদের জন্য অবারিত দ্বার। আপনারা লিখুন, সাহস করে লিখুন, সামাজিক মাধ্যমে পাঠান, পাঠকের অভিমত জানুন। একটা লেখা প্রশংসিত না হলে, আরেকটা লিখুন, লিখতে থাকুন। আমাদের পাঠান, তাঁর কিয়দংশও পাঠযোগ্য হলে, আমার প্রকাশ করব। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার উন্নয়নে আমাদের ওপর নিহিত সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব, করতেই থাকব।


১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪