সম্পাদকীয়

 

শুভ হোক নববর্ষ...

"ধূ ধূ মাঠে রোদ কাঁপে ঝিলিমিলি নিঃঝুম দুপুরে
কুকুর হাঁপায় বসে, চিলেদের তীক্ষ্ণ ক্লান্ত ডাক
মনকে ক্লান্ত করে- তবু তাকে স্বাগত জানাই
পুরনোকে পিছে ফেলে দ্বারে এলো নতুন বৈশাখ...

আলোয় চিহ্নিত এই নববর্ষ, এই বৈশাখ
অন্ধকার প্রাণে প্রাণে আলোকের স্পর্শ দিয়ে যাক..."

পুরনোকে পিছনে ফেলে যখন হাজির হয় নতুন বৈশাখ, বাঙালি সত্ত্বা, মনন, কৃষ্টি নতুন করে জাগরিত হয়ে শুভ ১লা বৈশাখে বর্ষবরণে উদ্বেল হয়ে যায়। নতুন বছর মানে নতুন পোষাক, হালখাতার নিমন্ত্রণ, সঙ্গে থাকে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে প্রভাতফেরী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। এই দিনে গুরুজনদের প্রনাম করে ছোটদের আশীর্বাদ নেওয়ার দিন। নতুন বছরের প্রথম দিনে বাঙালির ভালোমন্দ খাওয়ার দিন। অধিকাংশ বাড়িতে দুপুরের মেনুতে মাংস অবশ্যই এসে হাজির হবে। অনেকে আবার নামী রেস্তরা থেকে পছন্দমতো খাবার আনিয়ে ভুরিভোজের ব্যবস্থা করেন। সন্ধ্যেবেলায় হালখাতার নিমন্ত্রণ এই দিনটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। বৈশাখকে আহ্বান করে তাই কবি বলেন -
"বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ,
যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলো কেশের স্পর্শ।
চাঁপা বনের কাঁপন-ছলে লাগে আমার বুকের তলে
আরেক দিনের প্রভাত হতে হৃদয়দোলার স্পন্দ।
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ।
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ।"

অথবা কবি বলেন -
"সহসা উচ্ছ্বসি উঠে ভরিয়া আকাশ
তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাস।
অম্বরপ্রান্তে যে দূরে ডম্বরু গম্ভীর সুরে
জাগায় বিদ্যুতছন্দে আসন্ন বৈশাখী -
হে রাখাল, বেণু যবে বাজাও একাকী।"

কিংম্বা গেয়ে ওঠেন -
"মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো..."

নতুন বছরের স্বাগত উৎসবের সঙ্গে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ আছে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঘর-দোর সুন্দর করে সাজানো হয়। গ্রামের মানুষ ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে নতুন জামা-কাপড় পরে আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি যায়। সেখানে অতিথি আপ্যায়নের সুবন্দোবস্ত থাকে। কয়েকটি গ্রামের মানুষজন মিলিতভাবে কোনো খোলা মাঠে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। সেখানে নানা রকম কুটির শিল্পজাত গৃহস্থালীর দ্রব্য কেনা-বেচা হয়, থাকে পিঠা-পুলির বিশেষ আয়োজন। কোথাও কোথাও ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন আছে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন, এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা ও কুস্তি।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংস্থা 'ছায়ানট' এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করা। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেতভাবে গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। ১৯৬৭ সাল থেকে 'ছায়ানট' এই অনুষ্ঠান করে চলেছে।

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে তার সমাপ্তি হয়। এই শোভাযাত্রায় বাংলার গ্রামীণ জীবন ও আবহমান বাংলার বৈশিষ্ট্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। লক্ষাধিক মানুষ নানারকম মুখোশ পরে এবং বিভিন্ন প্রাণীর বড় বড় প্রতিলিপি নিয়ে এই জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ১৯৮৯ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে গেছে। একটা কথা স্বীকার করতে আমাদের আজ আর কোনো কুণ্ঠা নেই, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে ওপার বাংলা এপার বাংলা থেকে এখন কয়েক যোজন এগিয়ে আছে।

নতুন বছরে আমাদের একমাত্র প্রার্থনা, 'বাঙ্গালী সত্ত্বা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মনন চির জাগরিত থাকুক, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায় অতীতের সমস্ত সাফল্যকে অতিক্রম করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলুক।'


১৫ এপ্রিল, ২০২৪