ভাষার স্বাস্থ্য
আমরা যারা বাংলা ভাষার প্রেমে পড়ে আছি, মাঝে মাঝে সংশয়ে পড়ে যাই, আমাদের এই প্রিয় ভাষার ভবিষ্যত কী? বিশেষ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেখানে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, অনেকের দ্বিতীয় ভাষা আবার হিন্দি। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগবে, যখন ভাষা-বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে আশঙ্কা প্রকাশিত হয়, "পৃথিবীর ছ'হাজার ভাষার অর্ধেক আগামী পঞ্চাশ বছরে লুপ্ত হয়ে যাবে, প্রতি দু’সপ্তাহে কমপক্ষে একটি করে ভাষা মারা যাবে, অর্থাৎ সেই ভাষার শেষ বাচকটি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে"।
এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস 'বৈকুণ্ঠের উইল'-এর একটি সংলাপ প্রণিধানযোগ্য। স্বল্প শিক্ষিত দোকানদার গোকুলের ছোটো ভাই অনার্স পাশ বিনোদ পিতৃশ্রাদ্ধে শহর থেকে এসেছে। সে তার বন্ধুবান্ধব, হাকিমের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিল। গোকুল বলল, "বিনোদ হাকিমের সাথে ইংরেজিতে কথা কচ্চ না কেন? ওরা হাকিম, হুজুর, ওদের কি বাংলা বলা সাজে? পাঁচজনে শুনলেই বা তোমাকে বলবে কী?"
আজ থেকে একশো বছর আগে লেখা উপন্যাসে বিন্দুমাত্র ইংরেজি না জানা এক সরল হৃদয়বান দাদা চায়, কৃতী ভাইটি রাজার ভাষায় কথা বলুক রাজকর্মচারীদের সঙ্গে এবং দুর্বোধ্য ভাষার বিচ্ছুরিত আলোকে আলোকিত হোক স্নেহশীল দাদা। উপনিবেশের সংস্কৃতি কিভাবে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে হেয় করতে শেখায়, তার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে এটি অন্যতম। সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলেছে। কর্তা নেই তো কী? কর্তার ভূত আরও দাপট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি সব ভাষার প্রতি সমদর্শী না হয়, তখন সংখ্যালঘু ভাষার বিপদ বাড়ে। সংখ্যালঘু ভাষার বাচকদের সেই ভাষাকে রক্ষার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। অতিবৃদ্ধ থেকে শিশু সবাইকে অবশ্যই মাতৃভাষায় কথোপকথন করতে হবে।
মানুষের স্বাস্থ্যের মতো ভাষার স্বাস্থ্যেরও বিভিন্ন স্তর আছে যেমন - ১) রামবাবু এখন দারুণ সুস্থ। ২) রামবাবুর শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। ৩) রামবাবু অসুস্থ। ৪) রামবাবু গুরুতর অসুস্থ। ৫) ডাক্তার রামবাবুকে জবাব দিয়েছেন। ৬) রামবাবু চলে গেলেন।
ভাষার ক্ষেত্রে - ১) নিরাপদ। ২) নিরাপত্তা অনিশ্চিত। ৩) অবশ্যই বিপন্ন। ৪) মারাত্মক বিপন্ন। ৫) সংকটজনকভাবে বিপন্ন। ৬) মৃত অর্থাৎ যে ভাষায় কোনও বাচক নেই।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটি হল - আমাদের ভাষা 'নিরাপদে' থাকবে না 'ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন'-এর মতো চিরতরে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?
ঋণস্বীকার: সজল রায়চৌধুরী
১৫ জুলাই, ২০২৪