প্রত্যেক বছর নারায়ণগঞ্জের চৌমাথার দুগ্গা পুজোর প্যান্ডেল ওদের বাঁধা বায়না। ওরা 'সরকার প্যান্ডেল অ্যান্ড ডেকরেটর'। চারটে গ্রাম পেরিয়ে মনমোহনপুরের দিক থেকে আসে। ছোট লরির পেছনে বাঁশ, ত্রিপল, কাপড়, দড়ি, থার্মোকল থেকে শুরু করে ছোট প্লাই-এর ডিজাইন করে কাটা টুকরো, ঝাড়বাতি সব টুকিটাকি জিনিস একদম ছক করে নিয়ে সরকারের সাঙ্গোপাঙ্গরা দেড় মাস আগেই এসে হাজির হয়। তারপর চৌমাথার খুঁটি পুজোর পাশের মণ্ডপের জায়গা ত্রিপল দিয়ে ঘিরে একটা আড়াল তৈরি করে। নারায়ণগঞ্জের সকলের মনে তখন চরম কৌতুহল! কেমন হবে এ বছরের প্যান্ডেল!
ওরা সবাই এই মাস দেড়েক প্যান্ডেলের ভেতরেই রাত কাটায়। এক কোণে স্টোভে রান্না করে। প্যান্ডেল লাগোয়া একটা ছোট পার্ক আছে। সেখানে প্রতিবার বাঁশ পুঁতে চলে নানারকম আলোর রোশনাই। সেসব দেখতে কচিকাঁচা থেকে বয়স্কদেরও ভিড় জমে যায়। গতকালই বিকেলে এসেছে ওরা। চিরাচরিত ছবির বাইরে পার্কের দোলনা ঘিরে এ বছর একটা ছোট্ট কালো ত্রিপলের ঘেরাটোপ উঠেছে। মুকুন্দ উঁকি দিলেন সেদিকে। উনি চৌমাথা ক্লাবের বড় এক মাথা। দেখতে পেলেন দোলনার কাঠের চারপাশে প্লাই পেরেক দিয়ে পুঁতে বেশ সুন্দর একটা চারকোনা বাক্স তৈরি করা হয়েছে। মৃদু দুলছে সেটি। মুকুন্দ ভাবছিলেন হয়তো এবার নতুন কিছু আলোর ভেলকি হবে। পেছনে ঘুরতেই শুনতে পেলেন "কোঁয়াও কোঁয়াও..." কান্নার শব্দ। অবাক হয়ে ফিরে তাকালেন দোলনার দিকে। ততক্ষণে হাজির এক তরুণী। বুকের আঁচল সরিয়ে ওই চারকোনা দোলনা থেকে বের করে আনলো একরত্তি সন্তানকে। ব্লাউজ তুলতে গিয়ে নজর গেল মুকুন্দ'র আশ্চর্যচকিত ভ্রু'র দিকে।
- "বাচ্চার জইন্য ওটা করিয়েছি বাবু! যাওয়ার আগে সব খুলে আগের মতো করে দেবো"।
- "কত বয়স ওর ? এইটুকু বাচ্চা নিয়ে কাজে এসেছিস"!
- "এই তো এক মাস হবে"!
তারপর হেসে আনন্দের সাথে খলবল করে উঠলো, "বেটি আমার এখানে এসে ভালো আছে বাবু! কম কাঁদছে! এখানে তো বড়লোকদের মতো দোলনা বানিয়ে দিয়েছে বাপে! দ্যাখো, কেমন দোলে!..."
মুকুন্দ'র মুখে আর রা নেই! ক'দিন আগেই ক্লাবের মিটিংয়ে এই প্রায় ভাঙ্গা দোলনাটা ফেলে দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছিল। দোলনাটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে! মুকুন্দ হাত তুলে ইশারায় জানালেন, "আমি চলে যাচ্ছি। ওকে দুধ দে..." তারপর হাতটা নিজের কপালে ঠেকিয়ে অজান্তেই বিড়বিড় করে উঠলেন, "দুগ্গা এলো! এবার সময়ের আগেই মণ্ডপে দুগ্গা এলো!..."