গল্প ও অণুগল্প

ভদ্রলোক



ইকবাল হোসেন (বাংলাদেশ)


সারাদিন ব্যস্ত থাকায় সন্ধ্যার পরে পরেই বাজারে গেলাম। সামান্য কিছু বাজার সেরে এসে দাড়ালাম অটো স্ট্যান্ডে। এমনিই মাসের শেষ। টাকা পয়সার টানাটানি। এর মধ্যে আবার ২০ টাকার হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছি না। একটু পরেই নিজ গন্তব্যের একটা অটো পেয়ে পেলাম। অটোতে আগে থেকে তিনজন যাত্রী ছিল। আমি সহ চারজন হওয়ায় অটোচালক দেরি না করেই গন্তব্যে গাড়ি ছেড়ে দিল। অটোতে থাকা লোকেদের গল্প শুনে মনে হল তারা পূর্ব পরিচিত। বেশভূষা দেখে বেশ ভদ্র মনে হল। একজনের গল্পে বাকি দুজন শুধু হ্যাঁ বা না করে শুধু মাথা নাড়াচ্ছে।

এর মধ্যে একজন ভদ্রলোক বেশ জোরে জোরেই কথা বলছিলেন, শুনতে না চাইলেও সব কথাই কানে আসছিল।

লোকটি বলছে, "আর বইলেন না বাজারের যা অবস্থা কোনো কিছু কিনে শান্তি নাই। মাছ মাংসে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কাঁচা বাজারের তো আরও খারাপ অবস্থা। বেতনের টাকা কোন দিক থেকে এসে কোনদিকে যাচ্ছে টের পাচ্ছি না। এর মধ্যে ছেলে-মেয়েদের স্কুলের টিউশন ফি। বাড়ি ভাড়া, ঔষধ আরও কত কি! আবার ছেলেটার কি যে হয়েছে, কিছুই খেতে চায় না। ওর জন্যই এইবেলা বাজারে আসা। ফল বাজার থেকে কেজি দুই আপেল, আঙ্গুর এক কেজি, কিছু কমলা কিনলাম। এত্তো দাম! সরকারের এই দিকে একটু নজর দেওয়া উচিত। সবকিছুর দাম একটু সহনশীল করলে সবাই কিনতে পারে। আমি তো শুধু ভাবি রিক্সা, ভ্যান, অটোচালক, শ্রমিক আর নিম্ন আয়ের মানুষের কথা। কি করে তারা এই বাজারে টিকে আছে, তাতেই আশ্চর্য হয়ে যাই। আমাদের নিজেদের জায়গা থেকেও তাদের যতটুকু পারা যায় হেল্প করা দরকার"।

ভদ্রলোকের কথা শুনে ভিতরে শ্রদ্ধা চলে এল। মনে মনে ভাবছি, আহা সবাই যদি ওঁনার মত ভাবতো। কতই না সুন্দর হত এই দেশ!

এরই মধ্যে একজন নেমে গেলেন। একটু দূরে আর একজনও নেমে গেলেন। বাকি রইলাম আমি আর সেই ভালোমানুষ ভদ্রলোকটি।

একটা ওষুধের ফার্মেসীর কাছে আসতেই অটোর ড্রাইভার বলল, "ভাই গাড়িটা রেখে দুইটা প্যারাসিটামল নিয়ে আসি আমার ছেলেটার জ্বর। এই যাবো আর আসব"।

আমি চুপচাপ আছি।

ভদ্রলোকটি তখন বলছে, "না না তুমি পরে নিও ওষুধ। আমার বেশ তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে"।

অটোচালক কথা না বাড়িয়ে যেতে লাগল।

"এই রাখো রাখো...", চিৎকার শুনে আমিও একটু চমকে গেছি। বাপরে, এত জোরে চিৎকার করার কি আছে। অটোচালক মামা অনেক জোরে ব্রেক কষে থামালো গাড়িটা। ভদ্রলোক নেমে বলেন, "কি মিঞা কানে শোনো না? গাড়ী থামাতে এত দেরি হয় কেন"?

ভদ্রলোক মানিব্যাগটা অনেক খুঁজে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে দিলেন অটোচালকের হাতে। টাকাটা ফেরত দিয়ে গাড়ির চালক বলছে, "আরো পাঁচ টাকা দেন। বাজার থেকে এখানে দশ টাকা ভাড়া"।

ভদ্রলোকটি তখন বলছেন, "কি? দশ টাকা ভাড়া এইটুকু রাস্তার! কবে থেকে ভাড়া বাড়ল"?

উত্তরে চালক বলল, "সে তো অনেকদিন হল। সবকিছুর যা দাম! তাই ভাড়াও বেড়েছে"।

ভদ্রলোক বললেন, "হুমম, তুই আমারে অজুহাত দেখাস। আমি সকাল বিকাল দুই বেলা যাওয়া-আসা করি পাঁচ টাকা করে। তুই এখন দশ টাকা ভাড়া চাস"?

চালক নিরুপায় হয়ে আমাকে জিগ্যেস করে, "ভাই আপনি বলেন বাজার থেকে এখানে কত ভাড়া"?

আমি বললাম, "বাজার থেকে এখানকার ভাড়া তো দশ টাকাই"।

লোকটি তখন চেঁচিয়ে উঠে আমাকে বললেন, "চুপ করেন। বেশি বুঝেন। এ্যাঁ, সাক্ষীদাতা হয়েছে একেবারে"।

এই ব্যবহার দেখে আমি তো চুপ।

লোকটি তখন অটোচালককে বলছে, "এই জন্যই তোদের মতো ছোটলোকদের আমি দু'চোখে দেখতে পারি না। খাই খাই ভাব সব সময়। যে টাকা দিলাম নিলে নে, না হলে চলে যা"।

এই বলে পাঁচ টাকার কয়েনটা অটোচালকের পায়ের কাছে ফেলে জোরে জোরে হেঁটে চলে গেল ভদ্রলোকটি। চালক তখন লোকটির গমন পথে তাকিয়ে থেকে বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, "এইসব ভদ্রলোকের গুষ্টি কিলাই"!

আমিও মনে মনে ভাবছি, কাকে কি মনে করেছিলাম। উদার, গরীবের বন্ধু, সবাইকে নিয়ে কত চিন্তা ভদ্রলোকের।

আল্লাহ বাঁচিয়েছে, এরকম ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে কিছু না হওয়া ভালো।