কুয়োতলায় একরাশ বাসন মাজার পর বিনুর মা বাসনগুলো একপাশে রেখে রূপোর বড় বাটিটা হাতে তুলে নিল। এই বাটিটা করেই চৌধুরী গিন্নীর বড় আদরের একমাত্র নাতি কানন দুধ খায়। মাত্র তিন বছর বয়স কাননের। পরম যত্নে বিনুর মা নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে বাটির জল মোছে, তারপর চারিদিকে নজর করে কোমড়ে গোঁজা ছোট্ট একটা পুড়িয়া বের করে ওতে রাখা গুঁড়ো বাটিতে ঢেলে দেয়। গুঁড়োগুলো বাটিতে ভালো করে আঙ্গুল দিয়ে চেপে চেপে ডলতে থাকে। এরপর আবার কাপড়ের আঁচল দিয়ে বাটির ভেতরটা হাল্কা করে মুছে অন্যান্য বাসনের সাথে রেখে একটা ক্রূর হাসি হাসে,
"দেখি এবারে বাছা আমার কি করে বাঁচে। এই বাটি করে দুধ খাওয়ালে ওর মরণ নিশ্চিত। আর যদি বাটিটা আবার ধুয়েও নেয়, তবুও ওতে যা বিষ থাকবে তাতে কানন সাথে সাথে না মরলেও রক্তবমি আর রক্ত পায়খানা করে দু'দিন বাদে তো মরবেই। তোমরা বড়নোক হতি পারো, আমার কাছে আমার নাতিটাও ফেলনা নয়। আমার নাতির গায়ে হাত তোলার মজা এইবারে টের পাবে খনে গিন্নীমা"। বাসনগুলো একসাথে নিয়ে রান্নাঘরের বাসন রাখার বাক্সে রেখে চৌধুরী গিন্নীর কাছে যায়,
"আসি গো গিন্নীমা, বিকেলে তাড়াতাড়ি আসব"।
গত পরশু বিকেলের ঘটনা, বিনুর মা তার মেয়ের ঘরের নাতি, বছর চারেকের বিশুকে নিয়ে কাজে এসেছিল। বড্ড ছটফটে আর দুরন্ত ছেলে বিশু। চৌধুরী বাড়ির ভেতরের টানা বারান্দাটায় নাতিকে বসিয়ে নিজের কাজ সেরে নিচ্ছিল বিনুর মা। গিন্নীমা কাছে বসেই ঐ রূপোর বাটিতে করে নাতিকে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। গরীব ঘরের ছোট্ট বিশু, সচরাচর দুধ জোটেনা। বড্ড লোভ হয় কাননের খাওয়া দেখে, এগিয়ে গিয়ে দু'হাতে বাটিটা তুলে দুধ খেতে গিয়ে একবাটি দুধ মেঝেতে ফেলে দেয়। আদরের নাতির খাওয়ার দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়াতে মেজাজ চড়ে যায় চৌধুরী গিন্নীর, বেশ কয়েক ঘা কসিয়ে দেয় বিশুর ঐ কোমল গাল দুটোয়। বিশুর কান্না শুনে বিনুর মা ছুটে আসে, সেভাবে কিছু বলতে পারে না গিন্নীমাকে। আদরের নাতি বিশুর দুই গালে গিন্নীমার পাঁচ আঙুলের ছাপ দেখে খুব কষ্ট হয়,
"ঐটুকু বাচ্চাডারে এইভাবে না মারলেই পারতে গিন্নীমা, গরীবের ছাওয়াল, না হয় এট্টু দুধ খেতেই গেসলো"। নাতিকে কাঁখে নিয়ে দু'চোখে আগুন ঝরিয়ে চলে যায় বিনুর মা। বদলা নেওয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। পরের দিন আর কাজেও আসে না।
ঘরের কাজ সেরে বিনুর মা চলে গেলে চৌধুরী গিন্নী বৌমাকে পাঠায় কাননকে ঘুম থেকে তুলতে, দুধ গরম করে সদ্য ধোওয়া রূপোর বাটিতে ঢালে কাননকে খাওয়ানোর জন্য।
দুধ নিয়ে নাতিকে খাওয়াতে গিয়ে দেখে, কাননের খুব পেটের গণ্ডগোল। বিছানাতেই বেচারা পাতলা পায়খানা করে ফেলেছে। বাটি ভর্তি দুধ রান্নাঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে দিয়ে কাননকে বারবার নুন চিনির জল খাওয়ানোর কথা বৌমাকে বলে।
"সেরকম বাড়াবাড়ি হলে সন্ধ্যায় খোকাকে সঙ্গে করে কাননকে বদ্যির কাছে নিয়ে যেও বৌমা"।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে বিনুর মা সাত তাড়াতাড়ি কাজে চলে আসে। সঙ্গে করে নাতি বিশুকে আনে, পরশু যার হাতে ওকে মার খেতে হয়েছিল তার দুর্দশার সাক্ষী করতে। চৌধুরী বাড়ির গণ্ডির কাছে এসেও কোনোরকম শোকের চিহ্ন চোখে পড়ে না বিনুর মা'র। অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ বাড়িতে, কোনও রকম কান্নাকাটি নেই। সন্দেহ জাগে মনে,
"তাহলে কি ওরা কেউ বাটিতে বিষের গুঁড়ো মাখানোর সময় আমারে দেখে ফেলছে! তাই ঐ বাটিতে কাননকে আর দুধ খাওয়ায়নি, বা বাটিটা ভালো করে ধুয়ে নিয়েছিল।" দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে চৌধুরী বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখে কাননকে কোলে করে ওর মা বারান্দায় বসে আছে, জানতে পারে সকাল থেকেই কাননের পেট খারাপের কথা। তড়িঘড়ি করে নাতিকে বারান্দায় বসিয়ে রান্নাঘর থেকে বাসনগুলো নিয়ে কুয়ো পাড়ে চলে যায় বিনুর মা। গত পরশু চৌধুরী গিন্নীর হাতে মার খাওয়া আজও মনে আছে বিশুর, চুপটি করে বসে থাকে ওখানে। একটু বাদেই চৌধুরী গিন্নী ওখানে এসে বিশুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে। গিন্নীমাকে দেখেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় বিশুর। ওর করুন মুখটা দেখে আজ খুব কষ্ট হয় চৌধুরী গিন্নীর।
"আহারে সামান্য দুধটুকু ফেলার জন্য আগের দিন কি মারটাই না মেরে ছিলাম ঐ কচি ছেলেটাকে।" বড্ড মায়া হয় আজ বিশুর জন্যে।
"কি রে, খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি"?
ভয়ে ভয়ে ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানায় বিশু। একটু দূরে কুয়োতলা থেকে বাসন মাজতে মাজতে কান খাড়া করে সব শুনতে পায় বিনুর মা। গিন্নীমার এই পরিবর্তনে খুশীই হয় সে, কিন্তু মন থেকে জ্বালাটা পুরোপুরি যায়না। রান্নাঘরে গিয়ে চৌধুরী গিন্নী রূপোর বাটি থেকে দুধটা অন্য বাটিতে ঢেলে গরম করে, সাথে প্লেটে করে বেশ কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে বিশুর কাছে নিয়ে যায়।
"নে বাবা এই দুধ আর বিস্কুট ক'টা খেয়ে নে। পেট খারাপ হওয়ায় নাতিটা আমার দুধটা খেতে পারেনি সকালে।"
সামনে একবাটি দুধ আর অতগুলো বিস্কুট দেখে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিশুর মুখটা। কুয়োর পাড় থেকে বাসন মাজতে মাজতে চৌধুরী গিন্নীর কথাগুলো কানে যায় বিনুর মা'র, নাতির পরিনতির আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাসনের গণ্ডি পেরিয়ে নাতিকে বাঁচানোর জন্য বারান্দার দিকে ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে বিশু বিস্কুট মুখে তুলে খেতে খেতে দুধের বাটির দিকে ছোট হাতদুটো বাড়াচ্ছে দুধ খাওয়ার জন্য...।