টাকার কোনো গরম নেই। আছে প্রবল শৈত্য। মাস-মাইনে পকেটে আসলেই হাত-পা ঘেমে, ঠাণ্ডা হয়ে সটান পেটের ভেতর ধাঁ। লোভাতুর চোখগুলো কয়েকদিন আগে থেকেই উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। না তাকিয়েও বোঝা যায়, দীর্ঘ মাসিক প্রতীক্ষার ধৈর্যের বাঁধ বালির বাঁধে পরিণত হতে চলেছে। ওরা কারা? ওরা-সব খুব কাছেরই জন। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এদের কারোর কারোর সে জন্মদাতাও বটে। আর যাঁর সঙ্গে মিলে জন্ম দেওয়া কম্মোটি ঘটেছিল তিনি তো এই লাইনে অগ্রবর্তিনী। পদ্মিনী অবস্থায় যৌথ জীবনমঞ্চে আবির্ভাব এবং হৃদয়যুদ্ধে জয়ী হয়েই ক্রমে তিনি হস্তিনী হন। ব্লাউজ বড় হতে হতে বিরাটাকার ধারণ। চুল ক্ষীণ হতে হতে ছোট্ট বুল্টির 'স্মৃতিটুকু থাক'।
...আর আত্মজাটি যখন "বাপি-ই-ই" বলে কণ্ঠলগ্না হয়ে পটাং পটাং করে শ্বেত-অলক উৎপাটন করতে থাকে তখনই বাপিটির আত্মারাম হয়ে যায় খাঁচাছাড়া। ...এই পারিবারিক প্রেমের যে কী ভীষণ পরিণতি তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। আর... তাছাড়া সোনালী টেরির আর একজনাও আছে। সেটি আত্মজ। ওই ভূতের মতো প্রাণীটি বাপের প্রাক-মাইনে-প্রাপ্তির সময়কালটিতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সন্ধ্যে থেকে রাত - বলতে গেলে সর্বদা জন্মদাতার সম্মুখে উপস্থিত থেকে মনে করিয়ে দেয় যে, নিজের জন্মের জন্য সে নিজে দায়ী নয়। দায়ী হলেন পিতৃদের স্বয়ং। তাই তার শখ এবং প্রয়োজন মেটাবে কে? কে আবার? যে তাকে ধরাধামে আনয়ন করেছে, সে। অতএব গত তিনদিন ধরে সুপুত্রটি পিতৃসকাশে সদা উপস্থিত থাকছে। এটাই বহু দিন-মাস-বছরের রীতি।
আর এদের মাতৃদেবীর মঞ্চে প্রবেশ ও নির্গমন যখন তখন। নানা অভিযোগ, নানা জ্বালাময়ী ভাষণে উপস্থিতির সময়টুক অগ্নিময় থাকে। এবং মাসের শেষের দু-তিনটে রাত কাটে অবর্ণনীয় যাতনায়...। বিশালবপু পার্শ্ববর্তিনী সমারোহের সঙ্গে নিগূঢ় নৈকট্যে সরে আসেন। তারপর স্বামীর বিরলকেশ মাথায় ঘাটু ঘাটু করে আদর করেন। এরপর বৃহৎ বক্ষ দিয়ে ঠেসিয়ে ধরে কানের কাছে ফিস ফিস, ঘ্যানঘ্যান করে অনেক কিছু ফুটনোটসহ বলতে থাকেন। ...কার কানে আবার? যে তাঁর সিঁথিতে প্রথম সিন্দুর-রেখা অঙ্কন করেছিল। ফাঁদে পড়া প্রাণীটি ভাবে, ওই ধরণের ভুল কেউ একবার করেছে কী মরেছে। কারোর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া মানে নিজের কপালে আগুন দেওয়া। কেন নয়? সিঁদুর দানের পরেই তো যতো রাজ্যের আজগুবি ঘটনা ঘটতে লাগল। দু-দুটো নতুন মানুষ এসে প'ড়ে এই জনবহুল জগতের ভার আরও বাড়ালো। জলের মতো পয়সা-কড়ি বেরিয়ে যেতে লাগল ফর নাথিং! এছাড়া, কিচ্ছুটিই আর হল না। দেশের আর দশের মধ্যে মানুষের মতো মানুষ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো হল না (যদিও কী করে এটা হতে হয় সে প্রক্রিয়াটা জানা নেই), পৃথিবীভ্রমণ হল না (অবশ্য এটা খুবই কঠিন কাজ), হাতে-কলমে-মনস্তত্ত্বে কিছু সৃষ্টি করা হল না (এ বাপারটা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই), কোনো সমীক্ষা করা হল না (কে জানে, কী করে সমীক্ষা করে?), রাজনীতিও করা হল না (সেটা অবশ্য ভালোই হয়েছে)। অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল... সবকিছু অধরাই রয়ে গেল (পড়াশুনো আর করা হল কোথায়! বাবা অকালে স্বর্গে গেলেন বলে ওঁনার চাকরিটা পাওয়া গিয়েছিল। বাপরে বাপ, নইলে কী যে হতো!)। কে জানে, চেষ্টা করলে হয়তো কিছু কিছু হতো। আসলে, মনটাই তো মরে গেল এদের জ্বালায়। সিঁদুর-দান হলো সব দানকে বন্ধ করে দেবার এক পদক্ষেপ। দাতা হওয়াও হল না। এক পয়সা দান-খয়রাত করতে গেলেই এরা দলবদ্ধভাবে রে রে করে তেড়ে আসে (এটাতে অবশ্য আখেরে ভালোই হয়ে থাকে)।
যাইহোক, আইনগতভাবে শয্যার অংশীদার মহিলাটি, যিনি শয্যাকে শরশয্যায় রূপান্তরিত করেছেন, তিনি এখনও কানের কাছে মাছির মতো ভ্যান ভ্যান করছেন। এদিকে হতভাগ্য অনিচ্ছুক শ্রোতাটির তো ভূত-ভবিষৎ-বর্তমান সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। চাকরি-জীবনের পর পেনশন-জীবনেও এই আক্রমণ চলতেই থাকবে। তাহলে? অদূর ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকার! এরপর কী হবে? কী হবে? কী হবে? আর কী? সপাটে এক লাথি খেয়ে মহাশয়টি ছিটকে গেল। কেন? কে মারল লাথিটা? কে আবার অর্ধাঙ্গিনী। হয়তো ঘুমঘোরে অনিচ্ছাকৃত কোন পদস্পর্শ ঘটে থাকবে। যাকগে, মরুকগে! অন্য দিকে ফিরে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়া যাক। রাগ হয়ে যাচ্ছে! স্লিপিং উইথ দ্য এনিমি...!
অপরজনও রাগে গর গর করছিল। সচেতন অবস্থায় ছোঁয়াছুয়ির অনেক পজিটিভ দিক আছে। দেনা-পাওনার হিসাব-নিকাশটা করে নেওয়া যায়। কিন্তু তুই বাপু ঘুমিয়ে কাদা। তোর এই অকেজো অবস্থার অনিচ্ছাকৃত দেহভার বা পদভার আমাকে কেনো সহ্য করতে হবে? ঢপের চপ! কী করতে আছিস এই জগতে, যদি বৌ-ছেলেমেয়ের চাহিদা মেটাতে না পারিস? তাই ঘুমন্ত শুয়োরটাকে দেওয়া গেল কষিয়ে এক লাথি। কত আদর-আব্দারে জবজবিয়ে, কত কত ভালোমন্দ কথা বলা চলছিল কানে মধু ঢেলে। কাছিয়ে যাওয়া হলো কোলের মধ্যে, আর তার উত্তরে নাসিকা-গর্জন! তাই প্রত্যুত্তরটাও পাঠানো গেল। পদাঘাত। যার যেটা প্রাপ্য! বিয়ে করে, ঘর বসিয়ে, ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়ে, পরিবারের কর্তা সেজে, এখন পালালে হবে? এটা যুদ্ধক্ষেত্র। পালালেই কোর্ট মার্শাল।
* * *
সকালবেলা গৃহিনীর ঠকাস্ এককাপ চা-এর পরে কন্যার প্রবেশ। হাতে খবরের কাগজ।
- "বাপি-ই-ই, এই নাও কাগজ। ভাই-এর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছি। ও এই কারেন্ট কাগজটা দিয়ে কিটো-জুতো থেকে কাদা তোলার উপক্রম করছিল। কী ডিসগাস্টিং বলো-ও-ও"!
তারপরেই বাপির গায়ের ফতুয়া-পাঞ্জাবিটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করে দিতে দিতে বাপির গালে লম্বা এক চুমু।
"বাপি-ই-ই, সামনের চার তারিখের মধ্যে আমার এবার বড়তি তিন-হাজার টাকা লাগবে"।
- "অ্যাঁ"?!
- "হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। উঁ-উঁ-উঁ। একটা টপ দেখে এসেছি ওয়েস্টসাইডে। ওটা চাই। ওটা পরে কলেজ-ফেস্টে যাব। মাথা ঘুরিয়ে দেবো সবার। না কোরো না বাপি-ই-ই"।
- "পারবো না মা। আমি সামান্য একজন কেরানি"।
- "পারবে বাপি, পারবে। তুমি অসামান্য এক বাবা। হুঁ-উঁ-উঁ, দিতেই হবে"।
খ্যানখ্যান ঘ্যানঘ্যান করতে করতে মেয়ে চলে গেল। ...ধুপধাপ পদবিক্ষেপে গৃহিণী এলেন। বাজারের বাগটা ছুঁড়ে ফেললেন,
- "অফিসে দেরি হয়ে যাছে তো! কী এতো কাগজ পড়া? ওঠো! বাজার যাও"। বলেই প্রস্থান।
তখনি একটি ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড পরা শৌখিন রোমশ হাত তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে স্টাইলিশভাবে মাটি থেকে বাজারের ব্যাগটি তুলে নিয়ে, সোনালি টেরি ঝাঁকিয়ে মধুর কণ্ঠে জানতে চায়,
- "আমি বাজারে যাবো পাপা"? (ইনি আবার বাবা এবং বাপি ডাক বদলে ফেলে বছর দুই-এক হলো কার অনুপ্রেরণায় যেন 'পাপা' ডাক ধরেছেন)।
কিন্তু পাপাটির বুক চিরে আর্তনাদ বের হয়,
- "না, না, না-না! খবরদার! ব্যাগ দাও, ...ব্যাগ দাও। তুমি অন্তত না"।
- "কেন? কী ফল্ট আমার"?
- "না, তোমার কোনো ফল্ট নেই বাপু! আসলে মাসের শেষ তো, তাই ঠকে গেলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। বাজারে তোমায় ওরা ঠকিয়ে ভূত করে দেবে। আর তুমি, সগর্বে ঠকে ফিরবে। হুঁঃ!" বলে, বাজারে রওনা হলেন কেরানিবাবু।
সোনালি টেরি বাপকে বলেন 'পাপা' আর মাকে ডাকেন 'মিমি' বলে। ভাঙা বুক নিয়ে "মিমি... মিমি..." ডাকতে ডাকতে বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকলেন তিনি। এখন তাঁর রুদ্রমূর্তি।
- "বোকা বুড়োটা চলে গেল বাজারে। আমাকে চান্স দিল না"।
- "কেন রে! তুই খানিক সরাতি বুঝি"?
খিল খিল হাসি মিমি-মায়ের।
- "দ্যাখ বাবা, ওখানে তুই কোনো সুবিধা করতে পারতিস না। পয়সা সরাতে গেলে রোজ বাজারে যেতে হয়। সমস্ত দাম-দর মুখস্থ থাকলে তবে কিছু ঝাড়া যায়। তুই তো কিছুই জানিস না, গাড়ল! আর জানতে তোকে হবেও না। ওই বুড়ো যতদিন আছে ততদিন ওকেই করতে দে। যে যে-কারণে জন্মায়"।
- "থামো! আমার বাইকের কী হবে? রোজ রাতে একসঙ্গে শুচ্ছো। তাও আমার ব্যাপারটা কিছুই এগোতে পারলে না। কী ওয়াইফ রে বাবা! হাজব্যান্ডকে দিয়ে কিছুই করাতে পারে না! বেকুবটার কানে তুলেছিলে আমার বাইকের কথা"?
- "এই-ই! এক থাবড়া মারবো। বাপ-মাকে নিয়ে কীসব বলছে দ্যাখো!! হ্যাঁরে হারামজাদা, নিজে ইনকাম করিস না কেন? বুড়ো মানুষটা তোদের ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে আছে"।
- "ওঃ! মানুষটার প্রতি কী প্রেম রে"!
তারপরেই মায়ের অবেড়যোগ্য দেহকাণ্ডটি জম্পেস করে জড়িয়ে ধরে গণ্ডে চুম্বন।
- "ও মাই ডার্লিং, তাহলে তোমার গয়না বেচে আমায় টাকা দাও। অনেক তো দুয়েছো ওল্ড ম্যানকে"।
- "আঃ! ছাড় ছাড়! এবার পিটুনি খাবি কিন্তু"।
বলতে বলতে স্নেহময়ী মিমি এক রাম-চিমটি কাটেন ছেলের গায়ে।
মা-ছেলের এই প্রেমঘন উতোর চাপানের মধ্যে বাজার এসে যায়। এরপর সবাই মিলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বুড়োটে মনুষটাকে অফিসের দিকে এগিয়ে দেয়। যাতে লেট হয়ে না যায়। তিনটে লেটে একটা ছুটি কাটা যাবে। ধারাবাহিক লেট হলে ছুটি বিক্রির পয়সা কমবে। এতে ক্ষতি সকলেরই। কাজেই...