প্রবন্ধ

খাল-বিলের আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)



মমতা বিশ্বাস


ফুলটুসির গায়ের রং ছিল পাকা, নাক বাঁশির মতো খাড়া। মণিকুমার বৌ-পাগলা। নিজে তো কিছু বলে না; কেউ বললেও সহ্য করে না; সেই কারণে মাঝেমাঝে ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। রক্তারক্তি হয়ে গেছে কয়েকবার পাড়ার লোকের সঙ্গে। ফুলটুসি বোঝায় অহেতুক ঝগড়া গণ্ডগোল না করতে। শোনে না। সাধারণ জিনিসও ওর মোটা মাথায় সহজে ঢুকতেই চায় না। বিরক্ত হয়ে ফুলটুসি মাঝে-মধ্যে রাগ দেখিয়ে বলে,
"সাদে কী আর কয় নাবালি দেশের মানুষ নাবাল"।

মণিকুমার গায়ে মাখে না। স্বীকার করে বৌ তার বুদ্ধিমতী। চৌখস। পেটে কালির অক্ষর আছে। বর্ডারে ফন্দি-ফিকিরওয়ালা মানুষের চলাচল। ব্লাকপার্টির মানুষদের সঙ্গে একটু-আধটু ভাব আছে। তবে ঢলানি নয়! সংসারী বুদ্ধিমতী বলেই না বিলে দুই বিঘে জমি কিনতে পেরেছে। না হলে মুনিষ খেটে বিলে দুই বিঘে জমি করা মণিকুমারের হিম্মত হত? মোটেও না। ব্লাকের জিনিস-পত্তর একটু সেরে সামলিয়ে রাখলেই মোটা টাকা হাতে এসে যায়। একবার হয়েছিল কী; গাই-বাছুর পাচার হবে। বিএসএফ-রা তাড়া করেছে। অবিনাশ ফুলটুসির উঠোনের আমগাছে গাই বেঁধে অনুনয়-বিনয় -
"বৌদি, বাচুর ছেড়ে দিচ্ছি, বালতি নিয়ে এসে যদি দুধ দোয়াও, তাহলে এ যাত্রা বেঁচে যায়। সত্তর হাজার টাকা ওপারে পাচ করতে পারলেই। তোমাকে হাজার পাঁচেক দিয়ে দেব। ফুলটুসি বালতি নিয়ে এল। গাই ফাটকে তুলে ছাদন দড়ি দিয়ে বেঁধে দুধ দোয়াচ্ছে। তিনজন বিএসএফ এসে গাই দোয়ানো দেখে; স্থির বিশ্বাস হল এ গাইটি বাংলাদেশে পাচার হবে না। তারা ভুল খবর পেয়েছিল। এই রকমই সম্পর্ক পাচারকারীদের সঙ্গে ফুলটুসির"।

মণিকুমার বৌকে আদর করে টুসি বলে। বৌয়ের কাছে হেরে গেলেও আলাদা একটা সুখ অনুভব করে সে। ফুলটুসি তার জানের জান। সেদিন তেমন কাজ ছিল না। অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিলের জল উঠোন ছুঁই ছুঁই। স্নানের আগে জাল, বালতি হাতে নিয়ে বৌকে ডেকে গেল,
"আয় মাচ ধরতি যাচ্চি। পুকোর ভাসা রুই, কাতলা পাচ্চে নাকি সবাই। দু'কানে যায়ে শুনে আলাম।"

ফুলটুসিকে সেদিন ডাবসে ওঠা ধানক্ষেতের মতো মনে হচ্ছিল। যে ধানক্ষেত চাষীর বুকে অপার আনন্দের হিল্লোল তোলে; ফুলটুসি যে প্রথম মা হবে! কানায় কানায় ভরে উঠেছে ফুলটুসি, যেমন ভরে উঠেছে দামোদরের বিল। ইলিশ, রুই, কাতলা কিনে খাওয়ানোর সঙ্গতি নেই মণিকুমারের। কোনো ক্ষেপে যদি নওলা (রুইমাছ) মাছ ওঠে; বৌটা খেতে পারবে।

"এই সময় ভালো-মোন্দ কত কিচুই তো খাতি ইচ্চে করে, শুনি। সবাই কয়"।

এমন বর্ষণমুখর দিনে মণিকুমারের বৌয়ের সঙ্গে মশকরা করতে ইচ্ছে করছিল। একথা-সেকথা বলার পর তার ঠাকুর দিদির বলা একটা ধাঁধা বৌকে ধরে বসল,
"উঠতি পাখি ঝুপুর ঝুপুর,
বসতি পাখি ন্যাদা।
আহার করতি যায়রে পাকি
ন্যাজ থুয়ে যায় বাঁধা"।

উত্তরটা ক'তো টুসি, কেমন পারিস?

টুসি উত্তর দিতে পারেনি। মণিকুমার তোড়ো জাল জলের মধ্যে ঝপাং করে ছুঁড়ে ফেলে বলল,
"আমার হাতে দড়ি বাঁদা মানে ন্যাজ এইডে, আহার কত্তি গেল মানে; জাল জলে ছুঁড়ে দিলাম মাচ ধরার জন্যি। আস্তে আস্তে জাল টাইনে উপরে তুলে থ্যাপ করে মাটির উপর রাখলাম মানে ন্যাদা হয় বসে পইড়ল। জাল হাতে গুটিয়ে নিয়ার সুমায় লুহার জালের কাটি ঝুম ঝুম শব্দ করে না? তাই উঠতি পাখি ঝুপুর ঝুপুর"।

তার মানে হলো - "খ্যাপলা জাল, খ্যাপলা জাল"।

উত্তরটা বলে মণিকুমার খুশির হাসি হেসে উঠেছিল। এখন সে খ্যাপলা জালে মাছ ধরে না। মাছও নেই, জলও নেই। বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তালের ডোঙায় উঠে কচুড়িপানা বিলি কাটতে কাটতে একটু গভীর জলের দিকে এগোয় পাতজাল ছড়াতে ছড়াতে। ডোঙায় চড়ে এদিক-ওদিক করে। শাপলা টেনে তোলে, লকলকে কমলির ডগা ভাঙে। জাল গোটাতে গোটাতে পাড়ে চলে আসে। ডোঙা বাঁধা দড়ির খুটো মাটিতে পুঁতে রাখে। উঠোনে এসে জাল থেকে মাছ ছাড়ায়। ডোঙায় চ'ড়ে জাল পাতা-তোলার কাজে আগ্রহ দেখে বৌকে কতদিন বলেছে,
"যা টুসি শরীলে তেমন জুত নেই; জালখান তুই পাইতে থুয়ায়"।

টুসির মুখ আলো হয়ে ওঠে। পাতজাল, লগি (ডোঙা বেয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত শক্ত লাঠি) নিয়ে সড়সড় করে বিলের ধারে বাঁধা ডোঙার দড়ি খুলে; ব'সে পড়ে। কচুরি পানা বিলি কাটতে কাটতে এগিয়ে যায়। পুঁটি, খলসে, জিয়ল, ল্যাটা, শোল মাছ পায়।

(ক্রমশ)

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।