প্রবন্ধ

জীবনানন্দ দাশ - অর্ন্তমুখী রোমান্টিক কবি



স্বপ্না সেন


বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাঙালীর অন্যতম প্রিয় কবি। এমন একটা সময়ে নিঃশব্দ চরণে তিনি সরস্বতীর আঙিনায় এলেন যখন রবীন্দ্রনাথ গগনে পূর্ণমাত্রায় মহিমান্বিত। তাঁর চারপাশে রয়েছেন তারাশঙ্কর, শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং আরও অনেকে। তাঁরাও তাঁদের লেখনিজালে আবিষ্ট করে রেখেছেন পাঠককুলকে।

জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় অন্য এক রঙ, গন্ধ বয়ে আনলেন। এ ব্যাপারে তাঁর বড় হয়ে ওঠার একটা বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি বরিশালের শিক্ষিত ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ বিদুষী এবং চমৎকার কবিতা লিখতেন। পরিবারের সবাই সজ্জন এবং মানবিক গুণসম্পন্ন। উত্তরাধিকার সূত্রে এই সদগুণগুলি তাঁর মধ্যে ছিল। ছাত্র হিসাবে তিনি মেধাবী ছিলেন। ইংরাজী সাহিত্য এবং অধ্যাপনা তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। তবে বিষয়কর্মে জীবনানন্দের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কর্মজীবনে তিনি প্রায়শই বেকারত্বের সম্মুখীন হয়েছেন।

জীবনানন্দ সম্পর্কে আমার আলোচ্য বিষয় হলো তাঁর কবিতার রোমান্টিকতার ওপর আলোকপাত করা। একজন অনুরাগীর দৃষ্টিতে তার অন্যতম প্রিয় কবিকে একটু বুঝতে চাওয়া। ভূমিকাটির প্রয়োজন ছিল তাঁর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত করার হেতুতে।

জীবনানন্দের কবিতায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতি বারবার ঘুরে ফিরে আসে। ধলেশ্বরী নদী, কীর্তনখোলা নদীর তীর, হেমন্তের সোনালী ধান, সোনালী চিল, হিজল বনের ছায়া, লাশকাটা ঘর সবই তাঁর বরিশালের বাল্য কৈশোরের স্মৃতির ছায়া। রূপসী বাংলায় তাই তিনি লেখেন -
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি
ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাণহ ভরে, সোনালী রোদের রঙ দেখিয়াছি
দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন রূপ তার এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছে ঢেকে গূঢ় রূপ
আনারস বন; ঘাস আমি দেখিয়াছিঃ
দেখেছি সজনে ফুল চুপেচুপে পড়িতেছে ঝরে
মৃদু ঘাসে।

কি তীব্র প্রকৃতির টান কোনও উচ্ছলতা নেই, শব্দের কারিকুরি নেই, অথচ কি অমোঘ ভালবাসা। তিনি রাঙা রোদ ভালোবাসেন। ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো বেড়াতে ভালোবাসেন। নদীর গোলাপি ঢেউয়ের কথা তিনি শুনতে পান। চারিপাশ এত মায়াময় যে তিনি বলেন -
এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে...

জীবনানন্দ বনলতা সেন কবিতায় চমকে দিলেন পাঠক সম্প্রদায়কে। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হেঁটে ক্লান্ত প্রাণে শান্তি খুঁজে পেলেন দুদণ্ডের তরে নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। তিনি কিন্তু তাঁর অতি পরিচিতা নন। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন বলেন এতদিন কোথায় ছিলেন?

এই পর্যন্ত এসে মনে হয় সুধীন দত্তর কবিতা -
একটি কথার দ্বিধা থরো থরো চূড়ে ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।

কিন্তু হায়! এতো মধুর রোমান্টিকতা জীবনানন্দের কোথায়! তিনি অক্লেশে লেখেন -
সব পাখি ঘরে আসে
সব নদী
ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার;
মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

রোমান্টিসিজম আছে কিন্তু তার আশ্লেষকে পরিহার করেছেন জীবনানন্দ। দুদণ্ড শান্তি ছাড়া আর কিছুই তাঁর কাম্য নয়। রোমান্টিক কবি, কিন্তু সেই রোমান্টিসিজমকে তছনছ করে ফেলার প্রবণতা কবির মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়।

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি। হৃদয় উত্তাল হয়ে ওঠে এই সম্ভাবনায়। জীবনের কুড়ি বছরে প্রকৃতি তার সৌন্দর্যে মাধুর্যে ভরপুর করে তুলেছে দিগন্ত; কিন্তু কুড়ি বছরের পরে শিশির ঢাকা কুয়াশায় কবির মনে হল কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে হয় শ্যামার মতো, হায় একি সমাপন।

জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম এবং প্রেমিকারা খুব সহজ ভাবে চলাচল করেন না। তাঁর সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সুর্দশনা, শঙ্খমালা এরা কেউই পূর্ণ চরিত্রের নয়। শঙ্খমালা কবিকে কামনা করে যখন পেলেন, তখনই কবি লেখেন -
দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।
সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার বলে।
শ্যামলীর মুখের দিকে
পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,
দুপুরের শূণ্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব
সুদর্শনা কবির কাছে মৃত কারণ
তাকালে এখনও কবি সেই -
অনুভব করেন।

তাও শ্যামলীও যেন তাঁর প্রেমের জগতে স্থির নয়। সুরঞ্জনাকে কবির কতো প্রেমময় আবেগ। তবু তাকেও তাঁর মনে হয় শুধুমাত্র ভোরের কল্লোল।

সবিতার উদ্দেশ্যে বলেন -
মনুষ্যজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে
তবু সবিতা ও - কত কাছে তবু কত দূরে -

সুচেতনাকে তিনি বলেন -
সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে তবু শেষ সত্য নয়।
কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে; তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।

তবুও কবি ক্লান্ত, উচ্ছ্বসিত আবেগে টলমল নন। তাই লিখেছেন -
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয় শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়।

অথচ কবি জীবনানন্দ ঘোরতর রোমান্সে, কৌতুকে, সারল্যে ভরপুর এক কবি। তিনি স্বজনবৎসল, বিষয়ী নন এবং সংসারী নীতিবান মানুষ। তাঁর চাওয়া কখনই সোচ্চার নয়। তিনি স্পর্শকাতর। রুক্ষ ব্যবহার, অবমাননা তাঁকে পীড়িত করে। ক্রমশই তিনি হয়ে ওঠেন অর্ন্তমুখী। তাঁকে একমাত্র আনন্দ দেয় গ্রাম বাংলার প্রকৃতি। আর সব কিছুতেই তার কাছে ধরা পড়ে অনিশ্চয়তা, বেদনা, ভঙ্গুরতা। প্রেমও তাঁর কাছে উচ্চকিত নয়। বেদনায়, বিচ্ছেদে ভারাক্রান্ত অথচ রোমান্টিসিজমের মালায় গাথা। কবি তাই নিজের সম্পর্কে নিস্পৃহ, উদাসীন।

জানি আমি তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে; ক্লান্ত-ক্লান্ত করে -
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে,
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার তার হলো সাধ।

পরম ঔদাসীন্যে জীবনানন্দ লেখেন -

তাহলে কবি মনে করেন বিপন্ন বিস্ময়ের উৎস এক বিচিত্র ভাবনা যা লাশকাটা ঘরে টেবিলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। অথচ কিছু আগেও বধূ ছিল, শিশু ছিল, প্রেম ছিল, আশা ছিল, জ্যোৎস্না ছিল। তবু সে ভূতগ্রস্তের মতো লাশকাটা ঘরের বাসিন্দা হলো। অথচ তাও পেঁচা জাগে, গলিত স্থবির ব্যাঙ আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে -

আর এই মৃত্যু ও উষ্ণতার পাশাপাশি রয়েছে নির্মম বাস্তব কাঠিন্যের ছায়া -
ঘুরঘুরে অন্ধ পেঁচা এসে বলেনি কিঃ বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে? চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।

এখানেই জীবনানন্দের স্বকীয়তা তাঁর রোমান্টিক ভাবনা জগতে। আনন্দ, বিস্ময়, বেদনা, সুখ, দুঃখ, চাওয়া পাওয়া সবই মূল্যহীন। তাদের নিয়ে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ফেলা যায় কিন্তু রক্তের অভ্যন্তর অন্য কথা বলে -
মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে?


গ্রাফিকস্‌: অপূর্ব খোন্দকার

স্বপ্না সেন