জীবনানন্দ দাশ একজন খ্যাতনামা কবি ও সাহিত্যিক। বাংলা কবিতা ছাড়াও তিনি যেমন বাংলায় ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি ইংরেজিতেও কবিতা ও ছোটগল্প লিখেছেন তাঁর মাত্র ৫৫/৫৬ বছরের স্বল্প জীবনে। তবে বাংলা কবিতা লিখেই তিনি যশস্বী হয়েছেন। যদিও তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা ইংরেজি সাহিত্যে।
জীবনানন্দ দাশ পারিবারিকভাবে আদিতে বৈদ্য সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পরে জীবনানন্দ দাশ-এর পিতামহ সর্বানন্দ দাসগুপ্ত পরিবারের দাসগুপ্ত উপাধিটির পরিবর্তে প্রথমে দাস ও পরে দাশ লেখা শুরু করেন। সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র সত্যানন্দ (পেশায় শিক্ষক) এবং সত্যানন্দের জ্যেষ্ঠপুত্র হলেন জীবনানন্দ। এঁদের আদিবাড়ি অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার গাউপাড়া গ্রাম। পিতামহ সর্বানন্দের সময় থেকেই এঁরা পেশাগত কারণে বরিশাল নিবাসী ছিলেন।
জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দেবী বরিশালের মেয়ে। কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়েছেন ফার্স্ট ক্লাস অর্থাৎ বর্তমান কালের হিসেবে ক্লাস টেন পর্যন্ত। তিনি ভাল কবিতা লিখতেন। ভাল গানও গাইতেন। তাঁর লেখা অনেক কবিতা বরিশালের ব্রাহ্মদের দ্বারা পরিচালিত 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই কবিতাগুলির মধ্যে একটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, যেটি ছোটবেলায় আমরা অনেকেই হয় স্কুলে পড়েছি বা বাবামায়ের কাছে মুখেমুখে শিখেছি। 'আদর্শ ছেলে' শীর্ষক এই কবিতাটি চার পঙক্তি, ষোল লাইনে বিন্যস্ত। কবিতার শুরুর দু-লাইন হল -
"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে"।
আর শেষ দু-লাইন হল -
"হাতে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান, তোমরা মানুষ হলে, দেশের কল্যাণ"।
জীবনানন্দ দাশেরা দু'ভাই, এক বোন। দু'ভাই-এর মধ্যে বড়ো জীবনানন্দ (ডাকনাম মিলু), ছোট ভাই অশোকানন্দ (ডাকনাম ভেবলু) ও বোন সুচরিতা (ডাকনাম খুকু)। এঁদের প্রত্যেকেই সুশিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত। পরবর্তী জীবনে এই ভাই ও বোন তাঁদের দাদার অর্থাৎ জীবনানন্দের আর্থিক অসময়ে পাশে থেকেছেন।
ভাই অশোকানন্দের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে জীবনানন্দ খুব ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার চেষ্টা করতেন। বাল্যকালের তেমনই একটি অপ্রকাশিত কবিতার দুটি লাইন হল -
"এল বৃষ্টি বুঝি এল পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্ণিশের দিকে এলোমেলো"।
কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্য হল 'ঝরা পালক' (১৯২৭)। এরপরে আরও পাঁচটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জীবনকালে। এগুলি হল 'ধুসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬), 'বনলতা সেন' (১৯৪২), 'মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮), এবং 'জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৫৪)। 'রূপসী বাংলা' ও 'বেলা-অবেলা কালবেলা' নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে, কবির ভাই অশোকানন্দ দাশের উদ্যোগে।
১৯১৫ সালে জীবনানন্দ ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করে ১৯১৭-তে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ইংরেজী অনার্স ক্লাসে ভর্তি হওয়ার দু'বছর পরে, ১৯১৯ সালে ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ২০তম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় কবির 'বর্ষ-আবাহন' শীর্ষক কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন হল -
"ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে
দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠল জেগে
দিবা পরশ পেয়ে।"
কবিতাটিতে বলাবাহুল্য যে জীবনানন্দের সহজাত প্রকৃতি অনুরাগ ও অল্পবয়সী মনের নির্মলভাব ঝরে পড়ছে।
জীবনানন্দ মারা যান অক্টোবর ১৯৫৪ সালে। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় সাঙ্ঘাতিক আহত হওয়ার কারণে। এই ১৯৫৪-র কার্তিক-অগ্রহায়ণে কবির মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে লেখা ছয় পঙক্তি ও ঊনচল্লিশ লাইনে 'বিধৃত হে হৃদয়' শিরোনামের কবিতাটির কথা এখানে উল্লেখ করি। কবিতাটি কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত 'বেলা-অবেলা কালবেলা' নামের কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। কবি এখানে বেদনাবিষন্ন। জীবনযুদ্ধে বোধহয় ক্লান্ত। ক্ষতজর্জর। তাঁর প্রিয় প্রকৃতির কাছে অভিমান ব্যক্ত করে তিনি লেখেন -
"মৃত সব অরণ্যেরা -
আমার এ জীবনের মৃত অরণ্যেরা বুঝি বলেঃ কেন যাও পৃথিবীর রৌদ্র কোলাহলে
কেন চলে যেতে চাও মিছেঃ
নিখিল বিষের ভোক্তা নীলকণ্ঠ আকাশের নিচে লীন সব অরণ্যের কাছে।
কোথাও পাবে না কিছু মৃত্যুই অনন্ত শাস্তি হয়ে
অন্তহীন অন্ধকারে আছে"।
তথ্যসূত্রঃ
১। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, জীবনানন্দ, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৯ সাল।
২। ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র, ভারবি, কলকাতা, ২০০১ সাল।
৩। গোপালচন্দ রায়, জীবনানন্দ, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮ সাল।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।