ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

গোবিন্দমাণিক্যের রাজ্য, ভুবনেশ্বরী মন্দির ছুঁয়ে দেখবো বলে ত্রিপুরা ভ্রমণ



অমৃতাভ দে


ছোটবেলায় পাইলট হবার কথা খুব ভেবেছি। নীল আকাশে ওড়বার কথা, মেঘের সাথে মিতালি করার কথা ভেবে ভেবে হারিয়ে গেছি ঘুমের দেশে। পাখির মতো ডানা মেলে ওড়বার বাসনা কম-বেশি সবার মনেই আছে। পাইলট হতে পারিনি। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছি বার বার। মেঘ এসে আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ঝান্ডি দাড়াতে গিয়ে দেখেছি মেঘসমুদ্রকে। মেঘালয়ের রাস্তায় মেঘ জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। প্রথম যেদিন উড়ে গেলাম ত্রিপুরা রাজ্যে, আমাদের বিমান উড়ে গেল মেঘের ভিতর, সেদিন মনে হলো এই তো পাখা পেয়েছি। শরীর কত হালকা হয়ে যাচ্ছে। নিচের সেই চেনা পৃথিবীটাকে উপর থেকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে। ছককাটা মাঠ, আঁকাবাঁকা নদী বাংলাদেশকে সাজিয়ে তুলেছে। আমাদের বিমানের জানালা দিয়ে সূর্যাস্তের আলো তখন আমার মেয়ের মুখে পড়েছে। কাঁটাতারের পাশে বিমান ল্যান্ড করল যখন তখন সূর্য ডুবছে বাংলাদেশের শ্যামল মাঠে। সীমান্তঘেঁষা রাজ্যের বিমানবন্দরটি ছোট হলেও সাজানো পরিচ্ছন্ন ছবির মতো। সাহিত্যের ছাত্র আমি। রবীন্দ্রনাথের নাটক 'বিসর্জন' পড়তে গিয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। গোমতী নদীর দক্ষিণ পাড়ে মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের তৈরি ভুবনেশ্বরী মন্দিরের কথা বারবার মনে পড়ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল জয়সিংহ-রঘুপতি-অপর্ণার কথা। তাই আলাদা অনুভূতি নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছে গাড়ি ধরে আমরা চললাম আগরতলার হোটেলে।

পরদিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সেই ভুবনেশ্বরী মন্দির দেখতে। মন্দিরের কাছেই অতীতের রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আজও দেখা যায়। ধ্বংসস্তূপের দক্ষিণ দিকে জরাজীর্ণ বিষ্ণুমন্দির, গুণবতী মন্দিরের দেবতাও বিষ্ণু। ভুবনেশ্বরী মন্দির দেখতে দেখতে বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম রবীন্দ্রনাথের নাটকের পাতায়। মন্দির থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে দূরে। একসময় নাকি বলির রক্ত এই পথ দিয়েই বয়ে যেত। ভুবনেশ্বরী মন্দির চত্বরে স্থাপিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। স্বাভাবিকভাবেই একটা আলাদা আবেগ কাজ করছিল মনের ভিতর। ১৬৬০ সালে গোবিন্দ মাণিক্য এটি নির্মাণ করেন, যার চার চালা ছাদের উপর একটি স্তুপের ন্যায় অংশ এবং খাঁজকাটা কারুকার্য। মূল মন্দিরটির বহিরস্থ প্রাকারের চতুষ্কোণায় গোল আলম্ব আছে এবং এর উপর একটি কলস আছে।

ফিরে এসে লিখে ফেলেছিলাম -

"গোমতী নদীর তীরে আজও কী লেখা আছে পুরোনো ইতিহাস?
আজও কী রক্ত বয়ে চলে পথে?
আজও কী জয়সিংহ চিৎকার করে বলে, অপর্ণা আমি তোমায় ভালোবাসি খুব?
রঘুপতি আজও কী পরাজিত সৈনিকের মতো
গুমরে গুমরে কাঁদে?

রক্তের দাগ নেই আজ সেই পথে।
সেই পথে আমি আজ ছড়িয়ে দিই কবির প্রেম -

হে নিঃসঙ্গ পুরোহিত, দেবতার কাছে তুমি সেই প্রেম অর্পণ করে দিও..."

তারপর চললাম নীরমহল দেখতে। কোন এক সময় রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে জয়পুরের জলমহল দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ত্রিপুরার নীরমহল প্যালেস আমাদের আরো একবার অভিভূত করলো। রুদ্রসাগর লেকের দ্বীপে গড়ে উঠেছে এই নীরমহল প্যালেস। বিশিষ্ট স্থপতি মার্টিন ও বার্ন ১৯৩০-এ শুরু করে দীর্ঘ নয় বছরে হিন্দু এবং মোগল স্থাপত্যে গড়ে তুলেছেন এই নীরমহল। মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর এটি তৈরি করেন প্রমোদভবন রূপে। নামকরণ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এর চারপাশে জল। কিছুক্ষণের জলপথ পেরিয়ে নীরমহল প্যালেসে প্রবেশ করতে হয়। এখানে পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলবে। নৌকাভ্রমণের সময় ফেরার পথে জলের ভিতর নীরমহলের প্রতিবিম্ব আপনাকে নিয়ে যাবে ইতিহাসের অনেক পুরোনো অধ্যায়ে। অসাধারণ এক স্থাপত্য এবং অসাধারণ পরিবেশে গড়ে উঠেছে এই নীরমহল।

পরদিন সকালে চললাম কসবা কালীবাড়ি দেখতে। এখানেই আছে কমলাসাগর। পনেরো শতকের শেষভাগে রানী কমলা দেবীর বাসনা পূরণে মহারাজা ধন্য মাণিক্য এখানে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। মন্দির আছে। সেই মন্দিরে দশভুজা দুর্গা কালী রূপে পূজা পান। আছে শিবলিঙ্গ। সব থেকে ভালো লাগে কাঁটাতারের ওপারে বাংলাদেশ। এখান থেকে আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের রেললাইন ধরে চলেছে পণ্যবাহী ট্রেন। ওপার থেকে বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে এসে হাত মেলালো আমাদের সাথে। বিএসএফ কর্মীদের কাছ থেকে জানা গেল সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি হাট বসে। সেখানে দু'পারের মানুষজনই সেখানে আসেন নানান পসরা নিয়ে। সীমান্ত পাড়ের একটি গ্রামে বড় হয়েছি আমি। এপার বাংলা, ওপার বাংলাকে কখনো আলাদা বলে মনে হয়নি। কমলাসাগরে পৌঁছেও সেই একই অনুভূতি হল। মনে হল "আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা/ মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে থাকুক গে পাহারা।"

এখান থেকে চললাম সিপাহীজলা দেখতে। সুন্দর আরণ্যক পরিবেশ। কত না পশুপাখি। এক বিরাট চিড়িয়াখানা। বিনোদন পার্কও বটে।

ত্রিপুরার অন্যতম আকর্ষণ ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির

মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম একটি পীঠ। কচ্ছপের আকৃতির উঁচু টিলার উপর অবস্থিত বলে 'কুর্মপীঠ' হিসেবেও পরিচিত। ভিতরে একটি বড় ও একটি ছোট দুটি দেবীমূর্তি রয়েছে। বড় মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি। এটি মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী। ছোট আকৃতির মূর্তিটি 'ছোটমা' নামে পরিচিত। রাজা মাণিক্য পনেরশো এক খৃষ্টাব্দে মূর্তিটি স্থাপন করেন। তৎকালীন ত্রিপুরার রাজধানী 'রাঙামাটি' নামে এই স্থানটি পরিচিত। ইতিহাস অনুসারে দেবী মগধেশ্বরী এবং শক্তিপুরাণে শক্তিপীঠ হিসাবেও এর উল্লেখ আছে। কথিত আছে মহারাজা ধন্য মানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে দেবী ত্রিপুরেশ্বরীকে এখানে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে কল্যাণ মানিক্য মন্দির সংলগ্ন স্থানে একটি দীঘি খনন করেন যা 'কল্যাণসাগর' নামে পরিচিত। এই দীঘিটি খননকালে 'ছোটমা'র পাথরের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়।

ত্রিপুরায় বেড়াতে গিয়ে একটা বিকেল অবশ্যই কাটান আখাউড়া চেকপোস্ট-এ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই চেকপোস্ট বিকেলবেলায় দু'দেশের সীমাসুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানরা দেশের পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। উপস্থিত থাকেন ভারত-বাংলাদেশের পর্যটকেরা। বাংলাদেশকে দেখা যায় খুব কাছ থেকে। ওপারে চলছে যানবাহন, দোকানপাট ঘিরে মানুষজন। এখান থেকে ঢাকার দূরত্ব খুব বেশি নয়। এখান দিয়ে ঢাকা যাওয়া যায় খুব সহজেই।

ত্রিপুরার অন্যতম আকর্ষণ হেরিটেজ পার্ক। এই পার্কটি দেখবার মতো। যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় সেটি হল সমগ্র ত্রিপুরাকে জানতে গেলে এই হেরিটেজ পার্কে আপনাকে আসতেই হবে। আপনি যদি পুরো ত্রিপুরা ঘুরতে না পারেন তাহলে ত্রিপুরার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানগুলির ছোট সংস্করণ এই পার্কে এলেই দেখতে পাবেন। শিল্পীদের শিল্প-নৈপুণ্য আপনাকে আপ্লুত করবেই।

একদিন খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে ঊনকোটির উদ্দেশ্যে। আগরতলা থেকে দূরত্ব অনেকটাই। আঁকাবাঁকা চড়াই-উৎরাই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে তবে পৌঁছানো যায় ঊনকোটিতে। পথের ক্লান্তি আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। ঊনকোটিতে পৌঁছানোর পর আপনার সমস্ত শারীরিক ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যাবে। ৪৫ মিটার উঁচু রঘুনন্দন পাহাড় কেটে খোদিত ও প্রোথিত মূর্তিময় পুণ্য হিন্দুতীর্থ ঊনকোটি। এই শৈবতীর্থে এসে আপনি দেখতে পাবেন পুরো পাহাড়টাই ভাস্কর্যময়। মূর্তি রয়েছে শিব, হরগৌরী, সিংহবাহিনী দুর্গা, পঞ্চমুখী শিব ইত্যাদির। কাল ভৈরব বাসুদেব, রাম-লক্ষ্ণণ-হনুমান এদেরও মূর্তি রয়েছে সারা পাহাড়জুড়ে। বিশেষ করে রয়েছে বিশাল আকারের কালভৈরব বাসুদেব মূর্তিও চোখে পড়বে। লোকজনের মুখে শুনলাম আরও একটু উপরে উঠে গেলে কেদারনাথের একটি ছোট সংস্করণ চোখে পড়বে। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। অনেকেই সেখানে যান। ছোট্ট একটি পাথরকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। সেখান থেকে চারপাশের দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। সেই পাথরে প্রণাম করে নেমে এলাম নিচে। একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, কিংবদন্তি আছে কৈলাস থেকে কাশী যাওয়ার পথে পারিষদের অনুরোধে শিব এখানে বিশ্রাম নেন। পরদিন সমস্ত দেবতারা ক্লান্ত থাকলেও সেই পথে রওনা হয়ে যান একা শিব। সুতরাং এই স্থানটির আলাদা মাহাত্ম্য আছে।

ত্রিপুরার অন্যতম আকর্ষণ উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। অতীতের রাজপ্রাসাদটি ধ্বংস হয়ে গেছে। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে ১৯০১ সালে মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের হাতে তৈরি হয় উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। অসাধারণ স্থাপত্য। দুই পাশে রয়েছে জলাশয়, যা প্রাসাদের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে, বাগিচাটাও দেখবার মতো। চারপাশে আছে বেশ কিছু মন্দির।

এখানেই আছে ত্রিপুরা স্টেট মিউজিয়াম। ঘুরে দেখতে দেখতে আপনি পৌঁছে যাবেন অতীত ইতিহাসের পাতায়। সংগ্রহশালাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অবশ্যই দেখবেন মহারাজা বীর বিক্রম কলেজ

চতুর্দশ দেবতার মন্দির দেখতে ভুলবেন না। চতুর্দশ দেবতাদের মধ্যে রয়েছেন শিব-দুর্গা, হরি, বিষ্ণু, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, ব্রহ্মা, পৃথ্বী, অবধি, গঙ্গা, অগ্নি, কামদেব ও হিমাদ্রি। 'চোদ্দ দেবতার দেশ' বলে পরিচিতি আছে ত্রিপুরার।

এরপর শুধু ত্রিপুরা ভ্রমণের মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসা।
 

কিভাবে যাবেনঃ কলকাতা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি নামুন আগরতলা বিমানবন্দর। সেখান থেকে আগরতলা শহরে হোটেল থেকে ছোট গাড়িতে চার-পাঁচ দিনে ঘুরে নিন ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গা।

কোথায় থাকবেনঃ আগরতলা শহরে প্রচুর হোটেল রয়েছে। আগরতলাকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আসুন। থাকুন আগরতলাতেই।

কখন যাবেনঃ ত্রিপুরা যাওয়ার আদর্শ সময় অবশ্যই শীতকাল। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে গেলেই ভালো।

আলোকচিত্রঃ লেখক।