(১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।)
পর্ব - ৫
সকালে শীতের আমেজটা না কাটতেই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বেশ হাড়-কাঁপানো কনকনে উত্তুরে হাওয়া। শালটা জড়িয়ে নজরুল বেরিয়ে এলেন। সৌম্যদর্শন এক যুবক, হয়ত তাঁরই সমবয়সী হবে, কিছু জিগ্যেস করার আগেই বলে উঠলেন, "কাজীদা, আমার নাম তারকদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমন্তদা আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পাঠালেন"। - বলেই নজরুলকে প্রণাম করতে এগিয়ে এলেন। তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে ফেললেন নজরুল - "সেকি হে! বামুনের ছেলে হয়ে আমাকে প্রণাম করছ, তোমার জাত যাবে না"? উত্তরে তিনি নাটকীয় কায়দায় বললেন - "আপনি তো আমাদের বামুন। সুতরাং জাত যাবার কোনও চান্স নেই"!
"তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলো হে তারকদাস" - হো হো করে হেসে উঠলেন নজরুল। "আর 'কাজীদা' বলার পরে আপনি আজ্ঞে করার কোনও দরকার নাই। চলো কোথায় যেতে হবে"।
লাগোয়া বারান্দা মিলে বৈঠকখানায় বেশ অনেকটা জায়গা। আট-দশ জন অল্পবয়সী যুবক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। শীতের সকালেও বেশ মানুষজনের ভিড়। গ্রাম থেকে আসা কিছু মানুষজন ঘিরে কথা বলছে হেমন্তদার সাথে। কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করা নেতা, তাঁর কাছে গ্রামের সাধারণ মানুষ ভিড় করে থাকবে - সেটাই তো স্বাভাবিক। ভালো লাগলো নজরুলের।
- "দাদা এই সাত সকালেই বেশ জমাটি আসর দেখছি"!
নজরুল না ঢুকতে ছেলে-ছোকরাদের মধ্যে একটা শোরগোল উঠলো ‘কাজীদা এসেছে'!
বিদ্রোহী কবি শহরের এসেছে, সুতরাং আসর তো জমবেই! তাতে হিম পড়ুক আর বরফ পড়ুক।
হেমন্ত সরকার কথা শেষ করার আগেই ছেলেদের একজন নজরুলের জন্য তাঁর পাশে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।
- "দেখো, তোমার ব্যাটেলিয়ান দল তৈরি। এই হচ্ছে তারক..."
- "হ্যাঁ, তারকদাস বন্দোপাধ্যায়"।
- "এরই মধ্যে পরিচয় হয়ে গিয়েছে"? বিস্ময়ের সুরে বললেন হেমন্ত সরকার।
- "শুধু পরিচয় নয়, বেশ চমক দিয়ে কথা বলতে পারে তারও পরিচয় পাওয়া গেছে! সাতসকালে সেই-ই তো আমাকে ডাকতে গিয়েছিল"। এই বলে নজরুল তারকদাসের প্রণামের বিবরণ দিলেন। বলার ভঙ্গিতে বৈঠকখানায় একটা হাসির ঢেউ বয়ে গেল।
হেমন্ত সরকার বললেন - "বুঝলে কাজী, লোকে বলে কেশনগরে কথার চাষ হয়। এখানকার মানুষ সোজা কথাটাও বাঁকিয়ে বলে। যাইহোক, এখানে তারকই হচ্ছে তোমার লোকাল গার্জেন। তোমার যাবতীয় প্রয়োজন আর দরকারি কাজকর্মের কথা ওকেই বলবে, বুঝলে তো? বাকিগুলোর ভরসা নাই, সব টোটো কোম্পানি"।
হেমন্তদার বলার ভঙ্গিতে নজরুল যা বোঝার বুঝে ফেললেন। কৃষ্ণনগর এমনিতেই স্বদেশীদের ঘাঁটি। এর মধ্যে অনন্তহরি মিত্র গ্রেপ্তার হবার ফলে শহরজুড়ে একটা চাপা উত্তেজনা চলছে। তার উপর নজরুলের উপস্থিতি মানেই আশেপাশে নির্ঘাৎ পুলিশের টিকটিকি ঘোরাঘুরি করবে।
- আর এই যে দুই মূর্তি, মঘা, মানে প্রমোদ আর গোবিন্দ - এরা তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। বডিগার্ডও বলতে পারো। তবে একটু সাবধানে থেকো, কখন যে কোথায় ঝুটঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে তার ঠিক নাই। প্রমোদ আর গোবিন্দ সঙ্গে সঙ্গে হইচই করে উঠল। "হেমন্তদা, মিছে বদনাম দিচ্ছেন। আর তো কোনও ঝুটঝামেলা করিনি"।
- "করোনি বটে, তবে করতে কতক্ষণ! এই তো সেদিন নবদ্বীপের শ্মশানে যা কান্ড করে এসেছিস তোরা। আমি তো ভয়ে ভয়ে থাকি। বুঝলে কাজী, সৎকার সমিতি তৈরি হবার পর থেকে শহরের সব মড়া পোড়ানোর দায় যেন এই ছেলেগুলোর উপর এসে পড়েছে। আর এরাও তেমন - যেখানে যাবে সেখানেই কিছু না কিছু কাণ্ড বাধাবে"।
নজরুল উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, "ভালো ছেলে দিয়ে আর কাজ হবে না দাদা। শ্মশানে গিয়ে তান্ডব করবে - দেশে এখন এইরকম দুষ্টু ছেলেরই বেশি দরকার"। নজরুলের সমর্থন পেয়ে ছেলেরা উচ্ছ্বাসে হইহই করে উঠল। হেমন্ত সরকার দক্ষ পরিচালকের ভঙ্গিতে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, "শোনো, নতুন দল গঠন করেছি। খদ্দের চরকা আর অসহযোগ যাই বলিস, সবই ঘুরে ফিরে সেই জমিদার জোতদার আর শহরের ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু দেখে না। সাধারণ কৃষক খেতমজুরদের কথা কেউ ভাবে না। এদের ভিতর থেকেই আমাদের সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। আগামীতে কৃষ্ণনগরে বড় করে সম্মেলনের ভাবনা আছে। কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনও এবার এখানে হবার কথা। কাজী এসেছে, তাকে এসবের অনেক কিছুই সামলাতে হবে। তার জন্য তোদের ফুল সাপোর্ট দিতে হবে। তারকের উপর পুরো বিষয়টা দেখাশোনার ভার থাকবে। কিরে, ঠিক আছে তো"?
নজরুল পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা তারক দাসের পিঠে একটা থাবড়া মেরে বললেন, "দাদা তারকদাসের উপর তো গুরুভার চাপিয়ে দিলেন! অবশ্য আমার আর সেই ওজন নেই, অর্ধেক হয়ে গিয়েছে"। ছেলেদের ভিতর একজন বলে উঠল, "তারকদা আমাদের গুরুদেব, কাজীদা। ও ঠিক সামলে নেবে"।
নজরুল দেখলেন গোবিন্দকে। দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবক। দেখে মনে হলো না এরকম একটা সৌম্য যুবক শ্মশানে গিয়ে মারামারি করতে পারে।
"এবারে রাধা, তোদের সাথেও কথাবার্তাগুলো হয়ে যাক"।
গ্রাম থেকে আসা মাঝবয়সী ৬-৭ জন মানুষ এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়েই বসেছিলেন। অবশ্য চোখ মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে চলতে থাকা আলাপচারিতা ও রঙ্গ-তামাশা তারা আগ্রহ সহকারেই উপভোগ করছিলেন। তাদের দিকে ইঙ্গিত করে হেমন্ত সরকার বললেন, "বুঝলে কাজী, রাধাকান্ত আমাদের বাগআঁচড়া-শান্তিপুর এলাকার মানুষ। আমাদের আসল কাজ তো শহরে নয়, গ্রামের ভিতরে। এর মধ্যেই ওরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। তুমি আসার সংবাদে ওরা ভোর না হতেই রওনা দিয়ে চলে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। সবচেয়ে কমবয়সী, কুচকুচে কালো বলিষ্ঠ চেহারার মানুষটি তুষের চাদরখানা আরেকবার জড়িয়ে কিছু বলতে যাবার আগেই নজরুল বলে উঠলেন, "রাধাকান্ত? আমি তো ভাবছিলাম কৃষ্ণকান্ত"!
আরেক দফা হাসির রোল উঠল। রাধাকান্ত নিজেও বিগলিত হাসি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। চাদর সামলে একেবারে যাত্রাপালার ঢঙ্গে জোড়হাতে অর্ধনত হয়ে বললেন, "হাবিলদার কবি সাহেবকে আমাদের প্রণাম। দাদা তো সবই বলেছেন। আমরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে নতুন সংগঠনের কথা প্রচার করছি। মুখে বেশি কথা বলার দরকার হয় না, লাঙলের কপি আর সাম্যবাদীর একটা কবিতা শুনিয়ে দিলেই যথেষ্ট। আমার তো চার-পাঁচখানা কবিতা বলতে বলতেই মুখস্ত হয়ে গিয়েছে"।
বিস্মিত নজরুল বললেন, "বলো কী হে"?
রাধাকান্ত একই ভঙ্গিতে বললেন, "হেমন্তদার কাছে আমাদের নিবেদন - কাজী সাহেবকে নিয়ে একবার বাগআঁচড়ায় আসুন। আমরা তাঁকে নিয়ে গ্রামে ঘুরব। গ্রামের মানুষের সামনে কবি সাহেব তাঁর সাম্যবাদীর যে কোনো একটা কবিতা বললেই যথেষ্ট - আমাদের নতুন করে প্রচার করার দরকার হবে না। আরেকটি কথা উল্লেখ করি, কাজী সাহেব উল্লেখ করেছেন তাঁর ওজন অর্ধেক হয়ে গিয়েছে - এই কথাটা আমরা মানতে পারলাম না। আপনার ওজন কৃষ্ণনগরে এসে দ্বিগুণ বেড়ে যাবে এ আমরা নিশ্চিত, আমাদের গ্রামে এলে তার প্রমাণ আপনি পেয়ে যাবেন"।
- "দাদা ওজনের প্রমাণ কী হবে তা জানি না কিন্তু কথার চাষ এখানে যে ভালোই হয় - সে প্রমাণ আমি হাতে হাতে পেয়ে গেলাম"।
নজরুলের কথা থামিয়ে দিয়ে হেমন্ত সরকার বললেন - "সবে তো একটা দিন এসেছ। কেশনগরে আরো কত কিছু দেখতে পাবে। যাইহোক, আজ এই পর্যন্তই থাক। তোমাকে ডাক্তার দে'র কাছে আগে নিয়ে যাওয়া একটা বড় কাজ। গ্রামে-গঞ্জে ঘোরাঘুরি অনেক কাজ বাকি আছে, কিন্তু শরীরটা তো সর্বাগ্রে ঠিক করতে হবে। তারক, ডাক্তার দে'র চেম্বারে তুই বলে যাস, আমি দুপুরের পরে কাজীকে নিয়ে যাব। আর শিবেন কোথায়"?
লিকলিকে চেহারার একটি ছেলে পিছন থেকে উঁকি দিল - "এই তো দাদা আছি"!
হেমন্ত সরকার বললেন, "শিবেন, বাকিদের তো বাইরে বাইরে কাজ, তোর ডিউটি কিন্তু কাজীর অন্দরমহলে। রোজ সকালে একবার করে মাসিমার কাছে গিয়ে খোঁজ নিবি বাজারহাট ইত্যাদি কী কী দরকার। ও দায়িত্বটা তোর"।
- "ঠিক আছে দাদা"। ঘাড় নেড়ে শিবেন সায় দিল।
- "তাহলে এখনই কাজ শুরু করে দে। গিয়ে মাসিমার সাথে একবার দেখা করে আয়, নতুন জায়গা - নিশ্চয়ই অনেক কিছু দরকার হবে"।
- "ও আর একা একা যাবে কেন? আমিও আসছি দাদা, পরে আবার কথা হবে। রাধাকান্ত, দেখা হবে পরে"।
নজরুল উঠে দাঁড়ালেন। হেমন্ত সরকার বললেন, "বিকেলে ডাক্তারবাবুর কাছে যাব, রেডি থেকো"।
শিবেনকে নিয়ে নজরুল বেরিয়ে পড়লেন।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।