(১)
মফস্বলের কোন এক অখ্যাত গ্রাম জামালপুর। সেখানেই বাস করে দিনমজুর সোরাব আলির মেয়ে কমলি-কমলি খাতুন। খুব দরিদ্র পরিবার, নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই আর কি। সংসারে খুব অভাব। মাকে সকাল হতে না হতে কাকভোরে উঠে পরের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচা, বাজার করা, রান্না করা এই সকল কাজ করতে হয়। তা দিয়ে যা যৎসামান্য পায়, মেয়ের পড়াশোনা চলে যায়। বাবা দিনমজুর। সেই কমলিই সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবারের মাধ্যমিকে জামালপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথম হয়েছে।সকলে অবাক হয়। দিনমজুরের মেয়ে কিনা মাধ্যমিকে স্কুলের সেরা! নেই কোন প্রাইভেট টিউশনি, বাড়িতে না আছে কেউ সাহায্য করার, তাকে দেখে সকলের গর্ব হয়, বুকটা বেড়ে ওঠে। কমলি এই গ্রামের আদর্শ। পাড়ার লোকেরা ওকে মিষ্টিমুখ করায়। হঠাৎ কমলি যেন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। যে কমলিকে গ্রামের লোকেরা একদিন অবজ্ঞার চোখে দেখত, অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রেখেছিল তারাই আজ গর্ব করে বলে ,'বাহ কমলির মত মেয়েই হয় না। তুই বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করেছিস। অনেক বড় হ কমলি,অনেক বড় হ।' কমলি কোন কথা বলে না। আনন্দে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই ছবিটা হঠাৎ যেন বদলে যায়। জয়ের আনন্দ যেন পলকে ফিঁকে হয়ে যায় কমলির কাছে।কমলির বাবা তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে আসে।
সোরাব আলি।। শুনছো গো কমলির মা, আমাদের কমলির এবার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। অনেক তো বড়ো হল। এমন সোমত্ত মেয়েকে ঘরে রেখে আমার মাঝে মাঝে খুব দুশ্চিন্তা হয়।না জানি কখন কী হয়।দিনকাল যা পড়েছে! দেখছো না খবরের কাগজে কী সব ঘটনা বেরোচ্ছে। ভয়ে যে আমার প্রাণটা উড়ে যায়। যদি একটা অঘটন ঘটে যায়, আমার মরণ ছাড়া আর কোন গতি থাকবে না।
দরিয়া বিবি।। কী গো, সকাল বেলায় এত চেঁচামেঁচি করছো কেন? কী হল বলো দেকি? তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কী বিড়বিড় করছো?
সোরাব।। কেন শুনলে না?
দরিয়া।। না,আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই!
সোরাব।। তোমার না থাকলেও আমার তো থাকতে পারে।
দরিয়া।। আ, মরণ!
সোরাব।। বলি কী আমাদের কমলির এবার একটা বিয়ে দেওয়া দরকার।
দরিয়া।। বল কী? এত অল্প বয়সে বিয়ে? সবে তো ওর ১৫ হল। তোমার কি ভীমরতিতে ধরল? সবে মাধ্যমিক পাশ করল,এখন কি ওর বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?
সোরাব।। তাতে কী হয়েছে? আমরা গরিব মানুষ, মেয়েকে কি আর পড়াতে পারব? আর পড়েও বা কী হবে?
দরিয়া।। কেন পারবে না? ওকে পড়াতে কী আর এমন খরচ! তাছাড়া কন্যাশ্রী তো আছে। ওর পড়ার খরচ ও নিজেই চালিয়ে নেবে। এত ভালো নম্বর পেয়ে ও মাধ্যমিক পাশ করল, আর ওকে তুমি পড়ার সুযোগ দেবে না?
সোরাব।। না গো দরিয়া, আমার ভয় করে। পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে।ওরকম সোমত্ত মেয়েকে ঘরে রাখা ভালো হবে না। দিনকাল যা পড়েছে!
দরিয়া।। তুমি কেন বুঝতে পারছো না, এখন মেয়েদের ১৮ র নীচে বিয়ে দেওয়া মানা।
সোরাব।। হচ্ছে না আঠেরোর নীচে বিয়ে? ভুরি ভুরি হচ্ছে।তাহলে আমার মেয়েটাই বা কি দোষ করল?
দরিয়া।। দেখছো না চারিদিকে সরকার থেকে পোষ্টার টাঙিয়েছে, তনিমাদের টিভিতে এত বিজ্ঞাপণ দেয়, শোনোনি বুঝি! মেয়েদের আঠেরোর নীচে ও ছেলেদের একুশের নীচে বিয়ে কখনোই নয়। তোমাদের কি হুঁশ ফিরবে না? কত অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের বিয়ে রুখে দিচ্ছে প্রশাসন থেকে?
সোরাব।। কী হবে গো না মানলে? কী হবেটা কী?
দরিয়া।। অনেক কিছু হবে গো, অনেক কিছু হবে। প্রশাসন জানলে মেয়ের বিয়ে তো বন্ধ হবেই, তাছাড়া আমরাও বিপদে পড়তে পারি।
সোরাব।। আর কী হবে, অ্যাঁ?
দরিয়া।। আরো অনেক কিছু হবে। অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে তার শরীর ভেঙে পড়বে, অপুষ্ট সন্তান জন্ম নেবে, নয়তো রক্তাল্পতায় ভুগবে।
সোরাব।। মেলা বকিও না তো, যত্তসব। আমাকে শেখাচ্ছে! খুব তো পণ্ডিত হয়েছো, বলি তোমার বাবা-মাও তো তোমাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তখন মনে ছিল না?
দরিয়া।। ভুল করেছিলেন, ভুল। তখন তো আর আমি বুঝতাম না, বুঝলে হয়তো বাধা দিতাম। এখন তো আমি বুঝেছি। আমার মেয়েটাকে তো আর আমি অগাধ জলে ফেলে দিতে পারি না! তাছাড়া আঠেরো বছর বয়সের পর যদি মেয়ে অবিবাহিতা অবস্থায় পড়াশোনা চালিয়ে যায়, তাহলেও এককালীন ২৫,০০০ টাকা পাবে। দেখছ না, যাতায়াতের সুবিধার জন্য ইস্কুল থেকে সাইকেল দিয়েছে। ১৮ বছরের পর মেয়েদের বিয়ে দিলে সরকার রূপশ্রীতে ২৫,০০০ টাকা দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষা ঋণ দিচ্ছে। ওর পড়ার কথা সরকার ভাবছে, আমরা আমাদের মেয়ের কথা ভাবব না?
সোরাব।। ওসব কন্যাশ্রী, দেবশ্রী, শুভশ্রীর কথা রাখো। পড়ে কী হবে গো? কী হবে পড়ে? কোন লাভ হবে না। ও কি কোন চাকরি-বাকরি করবে? শিক্ষিত বেকার তৈরি হবে গো, শিক্ষিত বেকার। তার চেয়ে না পড়াই ভালো। মেয়ে তো ভালো রেজাল্ট করল, তাতে আমাদের কী লাভ হল বল তো?
দরিয়া।। লাভ-লোকসানের কথা মাথায় রেখে কেউ পড়াশোনা করে না গো। পড়াশোনা মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে।আত্মনির্ভর হতে শেখায়। দেশ ও দশকে চিনতে শেখায়। তাহলে আমার মেয়েটা কী দোষ করল বল তো?
(২)
কমলি।। মা, মা, কোথায় গেলে সব?
দরিয়া।। এই তো মা।
কমলি।। কী শুনছি এসব মা? বাবা নাকি আমার বিয়ের জন্য দেখাশোনা করছে। একটা কথা শুনে রাখো মা, আমি কিন্তু এখন বিয়ে করছি না।
দরিয়া।। কী করব বল মা, তোর বাবা যে শুনছে না। আমি অনেক বুঝিয়েছি তোর বাবাকে। কিন্তু তুই তো জানিস মা, তোর বাবা কীরকম একরোখা। আমি অসহায় মা, আমি অসহায়।
কমলি।। কেন মা কেন? আমাদের এই সমাজ কি এখনও পুরুষশাসিত হয়ে থাকবে? আমরা কি একটুও তাদের উপর আঙুল উঁচিয়ে কথা বলতে পারব না? আমরা কি চিরদিন পদানত থাকব? কেন আমরা মুখ বুঝে অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করব? কেন একটু আমরা গর্জে উঠতে পারি না? কেন পারি না পুরুষশাসিত সমাজের বেড়াজাল ভেঙে দিতে? মনে পড়ে নজরুলের সেই বাণী - "এই পৃথিবীতে আছে যা চিরকল্যাণকর,/ অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।"
তাহলে কেন আমরা মেনে নিতে পারি না? নারী কেন নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবে না? আমি আমার শেষ কথা তোমায় বললাম মা, আমি কিন্তু এখন বিয়ে করছি না। তুমি একটু বাবাকে বোঝাও মা। আমার যে অনেক স্বপ্ন। নীল স্বপ্নগুলো আমাকে যে বড্ড টানে। আমি হারিয়ে যাই দূরের কোন সীমানায়। আমার স্বপ্নগুলোকে এভাবে ভেঙে দিও না মা। প্লিজ তুমি বাবাকে বোঝাও।
(নেপথ্যে গান)
"যখন সময় থমকে দাঁড়ায়,
নিরাশার পাখি দু'হাত বাড়ায়,
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোণ,
কী আর করে তখন -
স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে মন।"
(- নচিকেতা)
দরিয়া।। আমি তোর কষ্টটা বুঝি রে মা।
কমলি।। বোঝই যখন তুমি, যেভাবেই পারো আমার বিয়ে বন্ধ কোরো মা। দেখো মা, যে স্বপ্ন আমি দেখেছি তা পূর্ণ করবই। আমার আত্মবিশ্বাস, আমি পারব। আমাদের সমাজে মেয়েদের খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আমি তা বন্ধ করবই মা, আমি তা বন্ধ করবই। সমাজের সকল মানুষের চোখ আমি খুলে দেব। আমার স্বপ্নগুলোকে এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে দিও না মা।তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি মা, তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি।
(সোরাবের প্রবেশ)
সোরাব।। কী হল কী? এত কান্নাকাটি কীসের? কাঁদছিস কেন রে কমলি? তুমিই বা চেঁচামেচি করছো কেন?
কমলি।। তোমার দুটি পায়ে পড়ি বাবা,এখন আমার বিয়ে দিও না বাবা। আমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে দিও না বাবা।
সোরাব।। কী এমন স্বপ্ন আছে তোর? আমরা গরীব মানুষ, তোর বিয়ে হয়ে গেলেই আমার সব চিন্তা দূর হবে রে পাগলী।
কমলি।। আচ্ছা বাবা, আমার বিয়েতে তুমি কত টাকা খরচ করবে বল তো?
সোরাব।। সব মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশ।
কমলি।। তাহলে ওই হাজার পঞ্চাশ টাকা তুমি আমায় দিকে দাও, আর জেনো তোমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
সোরাব।। কী বলছিস তুই? তুই কি পাগল হয়েছিস?
কমলি।। আমি ঠিকই বলছি বাবা। আমাকে আর একটা সুযোগ দাও না বাবা!
"কন্যা হয়ে জন্ম নিয়ে এসেছি এই ধরায়,
তাই বলে কি অবহেলার পাত্রী আমরা সবাই?
আমাদেরও আছে স্বপ্ন নতুন ভারত গড়ার,
এসো আমরা সবাই মিলে শপথ করি আজ।"
মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা বলেছিল। আমাকে অনেক, অনেক পড়তে হবে।
সোরাব।। তাহলে ওই মাস্টার দিদিমণিরাই তোর মাথাটা খেয়েছে বল?
দরিয়া।। কী বলছো তুমি?
সোরাব।। হ্যাঁ, হ্যাঁ , ঠিকই বলছি আমি। ওরাই ওর মাথাটা খেয়েছে।
কমলি।। তুমি কাদের দোষ দিচ্ছি বাবা? মাস্টার দিদিমণিরাই আমাকে সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছেন। আমি কিছুতেই আমার ভবিষ্যতকে নষ্ট হতে দেব না।
সোরাব।। আমি তোর বাবা কমলি, তোর থেকে একটু হলেও আমি বেশি বুঝি। তোর এখনও গাল টিপলে দুধ বেরোয়, তুই শেখাচ্ছিস আমাকে! আমার এখন একটাই কাজ, তোর বিয়ে দেওয়া।
কমলি।। বাবা, এত নিষ্ঠুর হয়ো না আমার উপর। আমি কি তোমার এতটাই বোঝা? বাবা তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো। স্বপ্নগুলো যে আমাকে কুরেকুরে খাচ্ছে বাবা!
সোরাব।। স্বপ্নটপ্ন তো বড়লোকেরা দেখে। আমাদের মত গরীব লোকেদের যে স্বপ্ন দেখাও মানা। তাছাড়া তুই মেয়ে মানুষ, তোর স্বপ্ন দেখে লাভ কী? পরের বাড়িতে একদিন না একদিন তো যেতেই হবে মা, আমাদের মত গরীব মানুষের মেয়েদের পরের বাড়িতে হেঁসেল ঠেলা ছাড়া আর গতি কি বল?
কমলি।। কেন আমি মেয়ে বলে স্বপ্ন দেখা মানা? না গরীব মানুষ বলে?
সোরাব।। দেখ কমলি, তোর আমি বিয়ে দেবই। এটাই আমার সাফ কথা। আর এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একটাও কথা বলবি না। আমি এক কথার মানুষ। বেশি কথা বাড়াবি না।
কমলি।। ঠিক আছে বাবা, আমিও দেখছি তুমি কীভাবে আমার বিয়ে দাও।
দরিয়া।। কমলি!
সোরাব।। (সপাটে কমলির গালে এক চড় কষিয়ে) ফের যদি একবার...
কমলি।। (কাঁদতে কাঁদতে) বাবা, তুমি আমায় মারলে বাবা?
সোরাব।। হ্যাঁ হ্যাঁ, মারলাম, তোকে মারলাম। ফের যদি অবাধ্য হস, তো আবার মারব। আমার মুখের উপর কথা! খুব বড় হয়ে গেছিস তুই, তাই না? পড়াশোনা করে তো ভারি শিক্ষিত হয়েছিস, এখন মুখে চুনকালি দিতে চাস?
কমলি।। (কাঁদতে কাঁদতে) বাবা, তুমি আমাকে যতই মারো, যতই আঘাত করো, আমার কথারও কিন্তু নড়চড় হবে না। আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, বাবা, কিছুতেই না।
(দৌড়ে প্রস্থান)
দরিয়া।। কিগো, তোমার কি ভীমরতিতে ধরেছে? মেয়েটাকে কাঁদালে তো! এত বড় সোমত্ত মেয়ের গায়ে হাত তুললে!
সোরাব।। হ্যাঁ হ্যাঁ, দিলাম; প্রয়োজনে আবারও দেব। আমার কথাই শেষ কথা। তোমার মেয়েকে একটু বোঝাও। নইলে মেয়ের সঙ্গে তোমাকেও বাড়ি থেকে বের করে দেবো। আমি কিন্তু সম্বন্ধ পাকা করে এসেছি। ছেলের বাড়ি শাহিনপুরে। বাবা মার একটাই ছেলে। ছেলে আবার সরকারি চাকুরে। মোটা টাকা মাইনে পায়। বাড়িতে বাবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। সুখী পরিবার। কিছুতেই আমি এ সুযোগ হাতছাড়া করবো না। শোনো কমলির মা, মেয়েকে একটু বোঝাও। তাছাড়া আমাদের কমলিও সুন্দরী। ওর সঙ্গে মানাবেও বেশ।
দরিয়া।। তুমি আর একবার ভেবে দেখো গো কমলির বাবা। মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট করে দিও না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
সোরাব।। আমি বাবা হয়ে মেয়ের জীবন নষ্ট করে দেবো?
দরিয়া।। তুমি ভালো করে খোঁজ নিয়েছো? ছেলেটা কেমন, পরিবারের লোকজন কেমন? বিবাহ একটা বন্ধন, দুটি মনের, দুটি পরিবারের বন্ধন।
সোরাব।। ওরা লোক ভালো। আমার পরিচিতও বটে। ওরকম ছেলে এ তল্লাটে আর কেউ নেই। ও সুখে থাকবে দরিয়া, ও সুখে থাকবে।
(৩)
(পুলিশ স্টেশন)
কমলি।। স্যার, আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে স্যার। আমি খুব অসহায়।
ইন্সপেক্টর।। কে... কে তুমি? কোথা থেকে আসছ?
কমলি।। আমি কমলি - কমলি খাতুন। জামালপুর গ্রাম থেকে আসছি। আমার বাবার নাম সোরাব আলী শেখ।
ইন্সপেক্টর।। বল মেয়ে, তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?
কমলি।। আচ্ছা স্যার, আপনারও তো একটা মেয়ে আছে, যতদূর জানি সে ক্লাস টেনে পড়ে। টেন পাশ করলে আপনি কি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন?
ইন্সপেক্টর।। What do you mean? তুমি কি বলতে চাও?
কমলি।। হ্যাঁ স্যার, আপনি কি করবেন বলুন না স্যার?
ইন্সপেক্টর।। অবশ্যই তাকে পড়াবো। যতদূর সে চায়, পড়াবো। তারপর চাকরি বাকরির যদি সুযোগ পায় অবশ্যই করবে। আমি তাকে সাহায্য করবো।
কমলি।। কিন্তু আমার বাবাকে কোনমতেই আমি রাজি করাতে পারছি না। বাবা আমাকে বিয়ে দেবে। আমি সব এ মাধ্যমিক দিয়েছি। ভালো রেজাল্টও করেছি। এরপর আমি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু আমার স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই থেকে যাবে। কি জানি সফল হবে কি না? কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। যেভাবেই হোক আমার বিয়েটা আটকান স্যার।
ইন্সপেক্টর।। আমি তোমার সব কথা বুঝতে পেরেছি কমলি। তুমি ঠিক করেছো। তোমার মত শত কমলি গর্জে উঠুক। তাহলেই সকলে সাবধান হবে। "মেয়েদের আঠেরোর নীচে ও ছেলেদের একুশের নিচে বিয়ে নয়।" তুমি চিন্তা করো না কমলি। আমি আছি তোমার পাশে। আমি তোমার বাবার কাছে যাব, তোমার বাবাকে বোঝাবো।
(৪)
(কমলিদের বাড়ি)
ইন্সপেক্টর।। সোরাব,সোরাব, বাড়ি আছো? আমরা থানা থেকে আসছি, দরজাটা খোলো।
সোরাব।। দারোগাবাবু! আপনারা! কী ব্যাপার? আমার বাড়িতে পুলিশ! কিন্তু আমি তো কোন অপরাধ করিনি দারোগাবাবু।
ইন্সপেক্টর।। কিন্তু পুলিশ কি শুধু অপরাধী ধরতেই বেরোয়? অপরাধী ধরা ছাড়া কি পুলিশের আর কোন কাজ নেই?
সোরাব।। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না দারোগাবাবু। আমি তো কোন অপরাধ করিনি।
ইন্সপেক্টর।। অপরাধ তো করেছোই। ঘোরতর অপরাধ। সেটা বলার জন্যই তো তোমার বাড়িতে ছুটে এলাম।
সোরাব।। কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, কি অপরাধ করেছি? দয়া করে যদি একটু জানান।
ইন্সপেক্টর।। অবশ্যই জানাবো। তুমি নাকি জোর করে কমলির বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ? তুমি কি জানো আঠেরোর নিচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মানা?
সোরাব।। আমরা গরীব মানুষ হুজুর। আমাদের সাধ্য নেই মেয়েকে পড়াবার। বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ। কি করব বলুন?
ইন্সপেক্টর।। তাই বলে আঠেরোর নীচে? জানো তোমার সাজা হতে পারে। মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনোই তুমি ওকে জোর করে বিয়ে দিতে পারো না। ওর কথাটা ভাবো একবার। ওর স্বপ্নটাকে ভেঙে দিও না। দেখো একদিন ও বড় মানুষ হয়ে উঠবে। তাছাড়া সরকার থেকে কন্যাশ্রীর টাকা দিচ্ছে বছরে ৭৫০ টাকা করে। আবার আঠারোর ঊর্ধ্বে অবিবাহিত মেয়েদের পড়াশোনার খরচ হিসেবে এককালীন ২৫ হাজার টাকা দিচ্ছে, রূপশ্রী আছে, সবুজ সাথীর সাইকেল। এর চেয়ে আর বেশি কি চাও তোমরা? তোমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে বল দেখি?
সোরাব।। আপনি ঠিক বলেছেন দারোগাবাবু। আমি মেয়েকে এখন আর বিয়ে দেবো না। ওকে পড়াবো, ওকে আমি পড়াবো। ওর জন্য আমি আরো পরিশ্রম করব, পয়সা উপার্জন করবো। আমি আগে বুঝতে পারিনি। আসলে আমাদের সমাজ মেয়ে আর ছেলে কে আলাদা চোখে দেখে। ছেলেকে পড়ায় কিন্তু মেয়েদের পড়াশোনার দিকে তেমন নজর দেয় না। অনেকেই ছেলেদের ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে কিন্তু মেয়েকে ভর্তি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছেলে আর মেয়েকে একই চোখে কেন দেখতে পারিনা!
ইন্সপেক্টর।। ঠিক বলেছো সোরাব। আমাদের সমাজ একটা পাখির মত। এই পাখির একটা ডানা ছেলে আর একটা মেয়ে। একটা ডানা ছাড়া পাখি যেমন উড়তে পারে না, ঠিক তেমনি এদের একজনকে ছাড়া অন্য জন অচল। উভয়েই সমাজের অঙ্গ। তাই মেয়েদের বিয়ে কখনোই আঠারোর নীচে নয়। তাদেরও সুযোগ দেওয়া দরকার। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের বিয়ে দেওয়া কখনই উচিত নয়। আমাদের সমাজে বিবাহ একটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। বিবাহ মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করে দেয়, চার দেওয়ালের মাঝে তার জীবন আটকে যায়। তার চারিদিকে তৈরি হয়ে যায় একটা অদৃশ্য বন্ধন। তাই মনে রাখা উচিত শুধুমাত্র বিবাহ আর সন্তানের জন্ম দেওয়াটাই মেয়েদের একমাত্র কর্তব্য নয়। তাদের অনেক কর্তব্য আছে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে মেয়েরা শুধুমাত্র কূপমন্ডুক নয়। আগে খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার যেমন তাদের যাতায়াত ছিল, কিন্তু সর্বত্রই আজ যথেষ্ট দায়িত্ব পালন করছে নারী। তাহলে কেন আমরা মেয়েদের গুরুত্ব দিই না? মনে রাখা উচিত মনুসংহিতার সেই উক্তি - "যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যতে রম্যতে তত্র দেবতা।" যেখানে নারীদের পুজো করা হয় সেখানে দেবতা বিরাজ করে। তাই কমলির মত অসংখ্য কমলি জেগে উঠুক, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখুক, তারা মানুষের মতো মানুষ হোক, তারা গর্জে উঠুক।
"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা -"
সোরাব।। (দারোগা বাবুর কথা শুনে চোখের জল ফেলে) আপনি ঠিক বলেছেন দারোগাবাবু, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ভুল করেছিলাম। মেয়েকে আমি পড়াবো, অনেকদূর পড়াবো। ও যা চায় তাই হবে। আমরা গরীব মানুষ বলে স্বপ্ন দেখবো না? আপনি নিশ্চিত থাকুন দারোগাবাবু।
ইন্সপেক্টর।। আজ তাহলে আসি সোরাব। খুব ভালো লাগলো তোমার সঙ্গে আলাপ করে। কমলি... কমলি...
কমলি।। (ঘর থেকে বেরিয়ে) হ্যাঁ স্যার বলুন।
ইন্সপেক্টর।। কমলি তুমি এই গ্রামের আদর্শ। তোমার মত শত শত কমলি গর্জে উঠুক। তাহলে তোমাদের এই গ্রামটি মডেল হয়ে উঠবে সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে।
কমলি।। হ্যাঁ স্যার। আমরা দশ জন বান্ধবীকে নিয়ে একটা সমিতি তৈরি করেছি "জাগো বাংলা সমিতি"। আমাদের গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের কী অভাব, অভিযোগ তা আমরা খতিয়ে দেখব, তারপর মানবাধিকার কর্মীদের জানাব। তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের স্কুলের দিদিমণি, মাস্টারমশাইরাও আমাদের সাথে আছেন। তারাই আমাদের এই বুদ্ধি দিয়েছেন। তাছাড়া রাজ্য মহিলা কমিশন-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, তারাও আমাদের সাহস যুগিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন।
আজকাল খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখতে পাই চারিদিকে খুন-জখম, যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা। এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে আমাদের। আমাদের দুর্বল বলে ভাববার কোন কারণ নেই। সমাজকে কলুষতা থেকে মুক্তি দিতে আমাদের এই ''জাগো বাংলা সমিতি'' বিশেষভাবে পথ দেখাবে বলে আমার মনে হয়। বাংলাকে আমি জাগিয়ে তুলবোই। এটা আমার শপথ স্যার। এটাই আমার পণ। বাবা তুমি কাঁদছো বাবা? যদি আমি তোমাকে কোন আঘাত দিয়ে থাকি তোমার ছোট মেয়ে হিসেবে আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা।
এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না বাবা। না হলে তুমি আমার বিয়ে দিয়েই ছাড়তে। তাই বুদ্ধি করে আমি পুলিশের আশ্রয় নিয়েছিলাম বাবা।
সোরাব।। তুই ঠিক করেছিস রে মা, তুই ঠিক করেছিস। না হলে আমার এই ভুল ভাঙতো না যে, আমি কী ভুল করতে যাচ্ছিলাম! তুই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমার ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিস। তাই আনন্দে আমার চোখে জল এসেছে রে মা। তোর পাশে আমি আছি রে মা, তোর পাশে আমি আছি। তুই আমাদের গর্ব রে কমলি। তুই আমাদের গর্ব।
কমলি।। আমার বাবা, আমার সোনাবাবা।
(বাবার গলা চেপে ধরে দু'জনে কাঁদতে লাগল)
"আমাকে আমার মত থাকতে দাও -"
(- নচিকেতা)
(সোরাবের প্রস্থান)
(স্কুলের শিক্ষক রথীনবাবুর প্রবেশ)
রথীনবাবু।। কমলি, কমলি, বাড়িতে আছো? (বাড়ির বাইরে থেকে ডাকেন)
কমলি।। হ্যাঁ স্যার। আসুন স্যার, আসুন। ভিতরে আসুন।
রথীনবাবু।। তুমি ঠিক করেছো কমলি। তুমি তোমার বাবার নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তুমি তোমার বিয়েটা আটকেছো।
কমলি।। না না স্যার। এটা তো আপনারাই আমাকে শিখিয়েছেন। তাই আপনারাই আমার অনুপ্রেরণা। আমাকে আশীর্বাদ করুন, আমি যেন আমার মত হাজার হাজার কমলিকে অকালে ঝরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। তাদের শেখাতে পারি জীবনের মানে। আমাদেরও যে সমাজে গুরুত্ব রয়েছে, তা যেন এই সমাজকে বুঝিয়ে দিতে পারি।
"যে ফুল না ফুটিতে ঝরিছে ধরণীতে যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে জানি তাও, হয়নি হারা।"
রথীনবাবু।। তোমার মত শ'য়ে শ'য়ে আরো অনেক কমলি আছে, তাদেরকে রক্ষা কোরো কমলি। তুমি তো আমাদের স্কুলের গর্ব, আমাদের বাংলারও।
কমলি।। এই বলে আমাকে আর ছোট করবেন না মাস্টারমশাই।
রথীনবাবু।। তোমার মনেঋ পড়ে কমলি, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই উক্তি, তোমাদের যা শিখিয়েছিলাম - "আমাকে একটা ভালো মা দাও, আমি তোমাদের সুন্দর একটা দেশ উপহার দেব।" একটা দেশ গঠনে নারীর গুরুত্ব কতটা তা এই উক্তি থেকে বোঝা যায়।
কমলি।। আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন।
রথীনবাবু।। তাই দেশের আপামর অভিভাবক-অভিভাবিকা তোমরা জাগো, কন্যা সন্তানকে আর অবজ্ঞা করে দূরে ঠেলে দিও না। ছেলের পাশাপাশি মেয়েকেও পড়াশুনার প্রতি নজর দাও। আর নয় আঠারোর নীচে বিয়ে। নিয়ম মেনে চলো, সুস্থ সমাজ গড়ো।
কমলি।। দেব স্যার, আপনার এই বার্তাই চারদিকে ছড়িয়ে দেবো। একদিন না একদিন মানুষ এর সুফল পাবেই। কি তোমরা কি হবে আমার চলার পথের সঙ্গী?
"স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে মন।"
(- নচিকেতা)
(সমাপ্ত)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।