।। এক ।।
গত চব্বিশ ঘন্টায় শিখেছি অনেক সম্পর্কের নতুন নতুন ভাষা। ক্রিয়েটিনিনের সঙ্গে হিমোগ্লোবিনের সেই বন্ধুত্ব যা কিনা আরেকটা সম্পর্ককে ছায়াহীন করে তুলতে পারে। হৃদস্পন্দনের অনিয়মিত গতিতে ওঠা আর নামা, ওষুধের সাইড-এফেক্ট আর ক্রমাগত অবস্থার অবনতির ধারাবিবরণী। নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি কি রক্তে শর্করা বাড়িয়ে তুলবে? আমি কি ঘুমিয়ে পড়ব নাকি সেই সম্পর্কটা যার বয়স হাফ সেঞ্চুরি পার করে হাঁফাচ্ছে হাসপাতালের করিডোরে? মতের অমিল নিয়ে যত কানাঘুষো সব কি হারিয়ে যাবে হাসপাতালের বিলে? এত এত ভুলের বেনামী সম্পর্কের কাছে কত স্মৃতি অপেক্ষার ঘাম ঝরিয়ে সদ্য ফুলপ্যাডেল শেখা আমার কাছে ছুটে আসবে অসময়ে তা শুধু আজ বুঝেছি।
অযোগ্য ছেলেটা কি আরও আরও ভুলের সম্পর্ক চিনে নিতে আইসিইউ থেকে বের করে আনতে পারবে সম্পর্কের চিকিৎসাগুলোকে?
ঝাপসা হয়ে আসা সম্পর্কের ঘ্রাণগুলোকে কুড়িয়ে নিতে নিতে চোখ বুজে আসে ক্লান্তিতে। আইসিইউ-র ঠান্ডায় তখনও বুড়ো বাপের চোখে ঘুম নেই।
।। দুই ।।
অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে ঘুম ভাঙে। খোলা জানালার আলো হেসে বলে, এত দেরি? ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে। সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোর চারটেয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
...বাড়ির লোক বলছেন? মিষ্টি কন্ঠ প্রশ্ন করল ফোনে। অনুমতি চেয়ে নিল বিশেষ কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা রোগীর।
রক্তের ডোনার খোঁজার কাজ শুরু হবে রিকুইজিশান পেলে। আজ দশটায় পাবার কথা তার আগে ভিজিটিং আওয়ারস।
লোকটার মুখোমুখি দাঁড়ালে ইদানিং সমস্ত কথা ভুলে যাচ্ছি। অবসাদ, শোক আর যন্ত্রণার স্বর ভুলে যাচ্ছি। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু ব্যর্থতার যন্ত্রসঙ্গীত বাজিয়ে চলেছি নীরবে। সে সুর শোনার কারো সময় নেই। সকলেই যে যার মতো রিকুইজিশান স্লিপ হাতে করে আমার সামনে উপস্থিত।
আমার সাইকেলের পিছনে দৌড়তে থাকা মানুষটাকে হাসপাতালের বেডে শূন্যদৃষ্টিতে শুয়ে থাকতে দেখে আমি ছন্দের মাত্রা ভুল করছি, কীবোর্ডের আঙুল ভুল করছি, কাগজের হিসাব ভুল করছি আর সমস্ত দায় আর দায়িত্বের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায় কাটিয়ে দিচ্ছি প্রতিটি মুহূর্ত।
।। তিন ।।
নিজস্ব নিয়মে সব হবে, তবুও বাস্তবে নিয়তির সাথে বিজ্ঞানের যুদ্ধ। যুদ্ধ নাকি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা! অর্থনীতি ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর চিকিৎসাবিজ্ঞান। হৃদয় সুস্থ রাখার নিয়মিত ওষুধে বাড়িয়ে তোলা ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ে কতটা সচেতন থাকা যায়? রক্তের রিকুইজিশন স্লিপ পকেটে নিয়ে ডোনার আর কার্ডের ট্রাপিজে ঝুলতে ঝুলতে ব্রেকফাস্ট, সুগার আর প্রেসারের হাততালি পকেটে নিয়ে শব্দ বুনে চলছি। কোনও কারণ নেই, কোনও উদ্দেশ্য নেই শুধু অস্থিরতা কমানোর প্রচেষ্টায় এইসব নেশা করা। এতে ওষুধের দাম কমবে না, হাসপাতালের বিল দিতে আসবে না কেউ। শুধু কথার সান্ত্বনা উড়ে আসবার আগে নিজেকে স্বগতোক্তি দিয়ে ভুলিয়ে রাখা। যন্ত্রণা কমানোর নিষিদ্ধ ড্রাগের হদিস যখন জানা আছে তখন নিজের জন্য ডাক্তার, প্যাথলজি সব দরজা বন্ধ রেখে শব্দের ভিতরে সূচ ঢুকিয়ে বের করে আনি রক্ত, আর ধমনীর ভিতর দিয়ে সেই রক্ত ঢুকিয়ে আমি চ্যালেঞ্জ জানাই শরীরের হিমোগ্লোবিনের মাত্রাকে। কিন্তু বাবা? এই রক্তে তো বাবার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানোর কৌশল জানেন না দুনিয়ার কোনও ডাক্তার! এও এক ফাঁকিবাজি। ফাঁকিবাজ ছেলের বাবা যেন ফাঁকি না পড়ে যায় তার জন্য অসহায় হয়ে দৌড়... নার্সিংহোম থেকে ব্লাড ব্যাঙ্ক আর তারপর অপেক্ষা...
।। চার ।।
অপেক্ষার অবসান হলে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে পড়ি। রক্তের ব্যাগ হাতে নিয়ে জীবনের ভার বুঝে নিই। বুঝে নিই পিতৃঋণের হিসাব। ভালবাসার দায়ে ত্যাজ্যপুত্র হবার ইতিহাস মুছে দিই ব্যস্তপথচারীর উদাসীনতায়। হর্ণের আওয়াজ কানে না পৌঁছানোর দায় আমার বুঝে ব্রেক ধরি কষে। চেনা মুদ্রাদোষে নিজের শব্দের কাছে ফিরি। ভিতরে ভিতরে বুনি শব্দের মায়াজাল। শব্দ সাজাই, বাক্য সাজাই। হর্ণ দিতে দিতে ভুলে যাই। আবার সাজাই। অগোছালো সম্পর্কের দায় আর দায়িত্বের জীবন। সারাক্ষণ ধরে চলে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। জেতা আর হারা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অপমান আর ভালবাসা মিশে যায়। অথচ কেন মেশে তা বুঝতে পারি না কেউই। কথা জড়িয়ে যায় স্যালাইন আর রক্তের সূচে। খাদ্যতালিকা বদলের অপছন্দটুকু ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি না জটিল চিকিৎসাশাস্ত্র। নিজেকে বিশ্বাস রাখার কথা বোঝাই। কিন্তু বিশ্বাস রাখা সম্ভব হয় না। হাসপাতালের বাতাসে আরও অনেক অবিশ্বাসের কানাকানি আমাকে দুর্বল করে তোলে। ওষুধ আর রক্তের পরীক্ষার বিল হাতে এলে ক্রিয়েটিনিন আর হিমোগ্লোবিনের সম্পর্ককে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম সম্পর্ক মনে হয়। ঘষাকাচের দরজার ভিতরে যে মানুষটা বিছানায় শুয়ে আছে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি তেমনই? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়। ক্লান্তির অবসান হলে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে কি? একটা প্রশ্নের সামনে আরেকটা প্রশ্নকে মুখোমুখি দাঁড় করালে নিজেকে কিছুটা নির্দোষ মনে হয়।
।। পাঁচ ।।
আমি তো একা আমি নই। আমার ভেতর আরও কত আমি। আমিও তাদের সবাইকে চিনি এমন নয়। তবু নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে হেরে গেলে ভয় হয়। কোন আমি'র জয় হলে জীবন মসৃণ হতো বুঝতে পারি না। কোন আমি'র আপোষ অথবা কোন আমি'র আপোষহীনতা আমাকে ক্রমশ পিছিয়ে দিচ্ছে - বুঝতে পারি না। প্রতিটি সম্পর্কের জটিল সমীকরণ যদি বাবার সাইকেলে চড়ে দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বানান শেখার মতো আনন্দদায়ক হতো তাহলে বেঁচে থাকাটাকে উদযাপন করতে ভাল লাগতো। জীবন উদযাপন অনেক বড় ব্যাপার। এত এত সম্পর্কের জটিল রসায়ন উদ্ধার করে, দায় ও দায়িত্বের তুলাযন্ত্র ঠিক রেখে আর জিরো ব্যালেন্স একাউন্টে হিরো বনে যাওয়ার পর তা আর সম্ভব নয়।
হাসপাতালের বিছানা খালি করে কিছু জীবন পুষ্পক রথে চড়ে পরজন্মের আগুনে পোড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখে আঁতকে উঠি। আমার ভিতরের ভিতু আমিটা দৌড়ে টয়লেটে যায় মুখেচোখে জল দিয়ে কান্না ধুতে। সাহসী আমিটা ব্লাড রিপোর্টের খবর নিতে দাঁড়িয়ে থাকি ঘষাকাচের দরজার এপারে। ওপারে কথা জড়িয়ে যাওয়া সাইকেল চালক, আমার বাবা, কী বলছেন জড়ানো স্বরে? ফিরে এসো চাকা?
।। ছয় ।।
চাকা ফিরে আসে। বাবা ছেলে হয়, ছেলে বাবা। সময় বদলায় কিন্তু প্রজন্ম আরও দ্রুত বদলায়। মন বদলায়, মানসিকতা বদলায়। বদলায় আবেগ ও তার প্রকাশ। পরিবারের অনু, পরমাণুর ভাঙনে কীভাবে শুক্রানু আর ডিম্বাণুর স্বভাব, চরিত্র বদলায় তা শুধু পুঁজির বিকাশ জানে। পুঁজিকে ঘৃণা করতে করতে বড় হয়ে ওঠা বাবার ছেলে পুঁজির হাতছানিতে বিগলিত। এই পরাজয়ে শুভ হোক সকলের। কিন্তু হয় না। কেন? কারণ হবার কথাও ছিল না। ছিল না সবাইকে নিয়ে চলার মন্ত্র আর তাই ব্যক্তিগত আবেগ, সুখ আর ইগো ক্রমশ ভেঙে ফেলে সমাজ, সংসার। যে ছেলের বড় হবার কথা ছিল মাঠে, সে আজ তার দুনিয়া সাজিয়ে বসেছে খাটে। একপাশে মোবাইল, সামনে ল্যাপটপ আর অন্য পাশে পছন্দের ট্যাব নিয়ে সে বিশ্বভ্রমণে সদা ব্যস্ত। কানে হেডফোন থাকায় কারো কথা শোনার সুযোগ নেই তার। আর, অন্যদিকে তার দাদুর কানের নার্ভ শুকিয়ে আসায় শোনার শক্তি নেই। এক প্রজন্মের শ্রবণশক্তি কেড়ে নিয়েছে সময় আর অন্য প্রজন্মের শ্রবণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি! নাকি পুঁজিবাদ? হয়তো বা তাইই। কিন্তু প্রমাণ এখনও নেই। থাকলেও মিডিয়া সেই পুঁজিরই দাস। দাস ক্যাপিটাল এখন ক্যাপিটালের দাস হয়ে ইলেকটোরাল বন্ডের টাকার হিসাব লিখছে পরবর্তী প্রজন্মের কমিউনিস্টদের জন্য। আর আমরা ভোট মেশিনের সামনে গিয়ে বিকল্প খুঁজছি। শোষক নির্বাচনের বিকল্প।
হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কোনও মানে হয়? হয়। আপনিও বুঝবেন। যখন হাতে হাসপাতালের বিল নিয়ে বিকল্প হাসপাতালের খোঁজ করতে করতে কোনও সহানুভূতিশীল মানুষের সন্ধান পাবেন আর সে আপনাকে তার অভিজ্ঞতা শোনাবে অন্য হাসপাতালের। নতুন রক্তের প্রয়োগে বাবার হিমোগ্লোবিন আর ক্রিয়েটিনিনের সম্পর্ক কী হবে জানি না কিন্তু নার্সের অপটু হাতে সূচ ফোটানোর বিভ্রাটের দায় যথারীতি আমারই ঘাড়ে পড়ল ভিজিটিং আওয়ারসে। যদিও এই ছত্রিশ ঘন্টায় আমাদের সম্পর্ক অনেক বদলে গেছে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আমিই কখন বাবা আর বাবা কখন ছেলে হয়ে গেছে তা বোঝার অবকাশ আজ আমার নেই।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।