সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রবাহমান যে সকল শিল্পধারা সমাজে এখনও জীবন্ত, তার মধ্যে অভিনয় কলা অন্যতম। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে অভিনয় শিল্প এক মূল্যবান ও প্রাণবন্ত শাখা। এই অভিনয় কলারই অন্তর্গত মূকাভিনয়। মূক + অভিনয়, নৃত্যাভিনয়, নাট্যাভিনয় ইত্যাদি।
আদিম অবস্থায় মানুষ যখন তার পরিবেশের জাতি-দ্রব্য-গুণ-ক্রিয়া-কে শব্দ সংকেতে চিহ্নিত করতে পারেনি, তখন ইঙ্গিত-ভাষা বা মূকাভিনয়ই ছিল পারস্পরিক ভাব আদান-প্রদানের প্রধান উপায়। মূকাভিনয় হল জগতের আদিমতম ভাষা, যে ভাষায় যে কেউ পৃথিবীর যে কোনো স্থানে নিজেকে প্রকাশ করতে এবং যে কোনো প্রয়োজন আকার ইঙ্গিতে মুদ্রার মাধ্যমে সম্পাদন করতে পারে। অনুকরণের প্রথম সূত্রপাত মূকাভিনয়ে। মূক অর্থাৎ ভাষাবিহীন - শুধু ভাব ও ভঙ্গিমার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা আর তদ্রূপ প্রকাশের মাধ্যমে কোন অভিনয়কে আমরা মূকাভিনয় বলেই জানি।
১৯৫৫ সালে বিখ্যাত অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্র ভারতীর নাট্য বিভাগের ডিন ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম মূকাভিনয়কে নাট্যশাস্ত্রের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।
উত্তরকালে শাস্ত্রীয় কিছু নাচের মধ্যে এবং লোকনৃত্যের মধ্যে মূকাভিনয় একটা বড় অংশ জুড়ে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
আধুনিক সময়ে নির্বাক চলচ্চিত্রে মূকাভিনয়ের মাদকতায় আমরা অভিভূত হই। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার নির্বাক চলচ্চিত্রের বিশ্বগুরু চার্লি চ্যাপলিন। এ দেশে বর্তমানে যোগেশ দত্ত এই মাধ্যমের যশস্বী শিল্পী ও কারিগর। সম্প্রতি নিরঞ্জন গোস্বামী, ধ্রুব মিত্র, শান্তি রায় এবং আমি নিজে একক ও যৌথভাবে মূকাভিনয় শিল্পকে আরও প্রসারিত করতে নানা রূপে বিশেষ উদ্যোগী হই। আধুনিক এই মূকাভিনয়ে কিছু বিশেষ ধরণের মেকআপ, পোষাক, আবহ ও যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ও নাটকে নানা প্রয়োজনে মূকাভিনয়কে বিশেষভাবে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। বহুরূপীর 'বিভাব' নাটকে শম্ভু মিত্র, চেতনার 'জগন্নাথ' নাটকে অরুণ মুখার্জী, নান্দীকারের 'খড়ির গন্ডী'তে এবং বর্তমানে মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের সিনেমা 'ডি. এল. রায়'-এ দারুণভাবে প্রয়োগ করেছেন। আমি নিজেও সিনেমাতে মূকাভিনয়ে অংশ নিয়েছি।
মূকাভিনয় প্রক্রিয়ার মূল উপাদান শরীরের গতি ও ভঙ্গি, অর্থাৎ body movement। মূকাভিনয়ের ক্ষেত্রে যেখানে সংলাপ অনুপস্থিত এবং শুধুমাত্র দেহ ভঙ্গিমার দ্বারা রসসৃষ্টি করতে হবে সেখানে শরীরের পেশীগুলিকে ইচ্ছেমতো পরিচালিত করবার মত ক্ষমতা শিল্পীর থাকা দরকার।
মূকাভিনয়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হল মুদ্রা। অনেকের ধারণা মুদ্রা বোধহয় একমাত্র নাচের বিষয়। মুদ্রা মূলতঃ একটি সংকেত বা ইঙ্গিত ভাষা। সুতরাং মূকাভিনয়ে সার্থক মুদ্রা প্রয়োগ করে বক্তব্যকে আরও বেশি উপাদেয় ও অর্থবহ করে তোলা যায়, যদি আমরা শিল্পীরা একটু সচেষ্ট হই।
ফরাসী মূকাভিনয় শিল্পী মার্সেল মার্সো ভারতে এসে কলকাতায় তাঁর শিল্পকলার যে প্রদর্শন করেছিলেন তা দেখে আমাদের গুরুজী যোগেশ দত্ত অভিভূত হয়েছিলেন।
মূকাভিনয়ের প্রয়োগ নাটকেও এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। বর্তমানে আবৃত্তি ও গানের সাথেও মূকাভিনয় জনপ্রিয় হয়েছে। এ এক অনন্য শিল্প। যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো স্থানে সমসাময়িক বিষয় ভাবনাকে মঞ্চে বিনা অলংকারে পরিবেশিত করা যায়। তবুও সেই অর্থে দর্শকের মননে এই শিল্প উদ্ভাসিত হয়নি। আমাদের সবার উদ্যোগে নিশ্চয় আগামীতে পারফর্মিং আর্ট-এর জগতে মূকাভিনয় এক বিশেষ স্থান অর্জন করবে।
আলোকচিত্রঃ লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।