দীঘল বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে তনুশ্যাম দেখল সুধণ্য কাকা আপনমনে সর্ষে খেতে নিড়ানি দিচ্ছে। শীতের সকালে শিশিরের জলে ভিজে রাইসর্ষে গাছের হলুদ ফুলগুলিকে একদম হলুদ গালিচার মতন মনে হচ্ছে। পুব আকাশে রুপোলি রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে ঝিকমিকিয়ে।
দূর থেকে তনুশ্যামকে দেখতে পেয়ে সুধণ্য কাকা পায়ে পায়ে এসে শুধাল - কাল রাইতে আইলা বুঝি ছোট খোকা।
হ্যাঁ - কাকা, তুমি ভাল আছো ? তোমার বাড়ির সবাই ভাল আছে?
- নারে বাবা মনডা একদম ভাল নাই। শুনতাছি তোমরা এই জমি জায়গা সব কিছু বিক্রি কইরা দিয়া চইলা যাইবা।
তয় আমরা খামু কী? ঘরে দুইটা সোমথ্য মাইয়া। এখনও বিয়া দিতে পারি নাই। তোমাগো এই জমিনটুকুন ভাগ চাষ কইরা কোনওমতে দিনগুজরান করি। তোমার মা খুব ভাল মানুষ ছিল।
চিনি বউদি কইছিল ভাই সুধণ্য এই জমিন তুমি যতকাল পারবা ততকাল চাষ করবা। কোনও সমস্যা হইলে আমার ছোট পোলা তনুরে কইবা। ওর বড় মন। ও তোমারে বঞ্চিত করবো না কোনওদিন।
সুধণ্য কাকার কথা শুনে হকচকিয়ে যায় তনুশ্যাম।
কীভাবে জমি বিক্রির এই খবরটা জানতে পারল কাকা। তনুশ্যাম ভেবে পায় না।
তবে একথা ঠিক। ওদের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে গ্রামের এই দোতলা বাড়ি আর বিঘে দশেক জমি রয়েছে। শিক্ষক বাবা চুনীলাল চক্রবর্তী উদ্বাস্তু হয়ে এই বঙ্গে এসেছিল ভাগের সময়ে। বাবা চল্লিশ বছর বয়সে মারা যায় হঠাৎ। তখন মা অথৈ জলে পড়ে যায়। চারপাশে সাহায্য করবার মতো একজনও ছিল না।
মা ছিল পূর্ববঙ্গের জমিদার বাড়ির মেয়ে। বিয়েতে পাওয়া প্রায় একশো ভরি সোনার গয়না বিক্রি করে এই বাড়ি, জমি কিনেছিল। দুই ছেলেকে কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছিল মা। তাই মায়ের হাতে কেনা এই বাড়ি জমি বিক্রি করতে মন কিছুতেই সায় দেয় না তনুশ্যামের।
কিন্তু দিল্লিতে থাকা দাদা, বৌদি একদম নাছোড়বান্দা। ওরা বিক্রি করবেই।
ছোট খোকা কিডা ভাবতাছো?
না কাকা আমাগো এই জমি বিক্রি করুম না।
তুমি আমারে আর দাদারে কোলে পিঠে কইরা মানুষ করছো। তোমারে কোনওমতেই পথে বসামু না কাকা।
সাইকেলে চেপে বাড়ির পথে ফিরছিল তনুশ্যাম। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল হঠাৎ।
দাদা, বৌদি দুজনেই দিল্লিতে বড় পদে কাজ করে। তবু এই জমিটুকুর ভাগ ওদের চাই। মায়ের কষ্টের কথা, বাড়িতে কাজ করা দরিদ্র সুধণ্য কাকার কথা একবারও ভাবল না।
বাড়ি ফিরে তনুশ্যাম দেখতে পেল - কয়েকটা জমির দালালের সাথে দাদা কথা বলছে বারান্দায় বসে।
ওরা চলে যাবার পরে তনুশ্যাম বলল - দাদা আমার জমির ভাগটুকু আমি বিক্রি করবো না। আর তোমার ভাগটুকুও আমি কিনে নেবো।
মায়ের স্মৃতি আমি কিছুতেই বাইরের লোকের কাছে বিক্রি করবো না।
দাদা কিছু না বলে চুপ করে থাকল।
বিকেল বেলায় সাইকেল চালিয়ে তনুশ্যাম সুধণ্য কাকার বাড়ি গিয়ে বলল - কাকা তুমি নিশ্চিন্তে জমি চাষ করবা।
এই শুনে সুধণ্যর দু'চোখ ভিজে গেল জলে।
নিজেদের জমির পাশ দিয়ে সাইকেলে চেপে ফিরছিল তনুশ্যাম। সর্ষে ফুলের নরম গন্ধ পেল নাকে। মনে মনে ভাবল - আর বছর দশেক চাকরি করবে বড়জোর। ব্যাঙ্গালুরুতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক জীবন হয়ে গেছে। কোনও প্রাণ নেই। এই কাজ করতে আর ভালও লাগছে না ইদানীং।
বিয়ে থাও করা হল না খানিকটা জেদের বসে আর দুঃখে। এই গ্রামের তনিমাকে প্রাণ দিয়ে ভাল বেসেছিল তনুশ্যাম। মা বলেছিল - তনিমাকে বাড়ির ছোট বউ করে নিয়ে আসবে। এই শুনে কিশোরী তনিমা তনুশ্যামের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে কতদিন।
হঠাৎই তনিমার বিয়ে হয়ে গেল রাজস্থানে। সেইজন্য মনের দুঃখে আর বিয়েই করল না তনুশ্যাম। এখনও তনিমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে দুঃখে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।
তনুশ্যাম ভাবল - গ্রামের বাড়িতেই ফিরে আসবে মায়ের জন্য। মায়ের নামে একটা ইস্কুল তৈরি করবে। রাস্তায় যেতে যেতে মনে মনে এই সব হাবিযাবি ভাবছিল তনুশ্যাম।
শীতের ছোটবেলা ফুরিয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। পুকুর পাড়ে এসে সাইকেল থেকে নেমে সবুজ ঘাসের উপর বসল তনুশ্যাম। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। জোনাকি পোকা কুয়াশার ভিতর সবুজ আলোর লণ্ঠন জ্বেলে হারিয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক। তনুশ্যামের সামনে হঠাৎই শৈশবের মুহূর্ত ফিরে এল। জোছনা মাখা হলুদ চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখল - আকাশ বাড়িতে বসে মা দু'হাত তুলে ওকে আশীর্বাদ করছে। এই দেখে তনুশ্যামের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
আবার সাইকেলে চেপে বাড়ির পথ ধরল তনুশ্যাম। একটা চোখ গেল পাখি চোখ গেল চোখ গেল বলে উড়ে গেল জোছনাআলো ভরা আকাশের দিকে।
গ্রাম ওকে টানছে। এখনই কী ফিরে আসবে। না কী আসবে না। এই নিয়ে দোলাচলে পড়ে ভাবতে থাকে তনুশ্যাম। সাইকেলের প্যাডেলে পা চেপে এগোতে থাকে বাড়ির দিকে।