টুবাই উদাস চোখে বসে বসে নদীর ঢেউ গুনছে। আজকে ওর মন খুব খারাপ! নিত্য দিনের মত আজও মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে, বলছিল, কেন যে টুবাই এর মত সন্তান পেটে ধরল! মায়ের চোখে জল দেখলে, টুবাই এর ও ভীষণ কান্না পায়! টুবাই তখন মা'কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে! বাবা, টুবাই কে কোনও দিনই সহ্য করতে পারে না! প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বাবা যখন হাড়িয়া খেয়ে ঘরে ফেরে তখন সামান্য কোনও ছুতোয় টুবাই কে ধরে প্রচুর মারধোর করে, আর তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
আজও বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে, মা ছেলের এমন কান্নার দৃশ্য দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মা, বিলাপ করে চলে, "কেন তোকে জন্ম দিলাম, আঁতুরেই কেন মেরে ফেললাম না! ভগবান তোকে কেন আমার কাছেই পাঠালো? বাছা রে, তোর ও কত কষ্ট! আমি তো বুঝি!"
টুবাই এর মরমী মন বিষাদে ভরে যায়, ভগবানের অবিচারে ক্ষুব্ধ হয় সে! তখন গলায় একটা গামছা ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
তাদের গ্রামের একটা ছেলে ও তার বন্ধু নয়, ওরা সবাই তাকে নিয়ে মজা করে! টুবাই এর মেয়েলী কথার ঢঙ নকল করে, ওরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে! ছোট বেলায় যখন টুবাই, তার মায়ের শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে পাড়ার পরবে নাচ করত তখনও সে উপহাসের পাত্রই ছিল!
একমাত্র পাড়ার মেনকা দিদি ওকে খুব ভালবাসত! মেনকা দিদি ছিল এই পাড়ারই মেয়ে, ওর বাবা তাদের গ্রামের ছোটখাট জোতদার, ঘর জামাই করে নিয়ে এল পাশের গ্রামের চালাক চতুর ছেলে অজয় মাহাতো কে! দিদির এক এক করে চারটে ছেলে হল, কিন্ত মেয়ের খুব শখ ছিল, মেনকার! টুবাই কে সে মেয়েদের মত সাজাত! টুসু পরবের সময় যখন মেলা লাগত তখন মেনকা ছোট টুবাই এর জন্য মেয়েদের ফ্রক জামা কিনে এনে তাকে পরাতো।মা খুব রাগ করত, কিন্ত মেনকার ছেলেমানুষীতে বাধাও দিতনা। গতবছরে তার পাঁচ নম্বর বাচ্চা হতে গিয়ে মেনকা দিদি মরে গেল! তার এই সতেরো বছরের জীবনের মনের কথা বলার সঙ্গীটি হারিয়ে গেল! তার বন্ধু আর কেউ থাকল না! এবারে একটা মৃত কন্যার জন্ম ও দিয়েছিল মেনকা, কিন্ত দূর্বল শরীরে তার এত ধকল সহ্য হলনা! তাই মৃত্যুর কাছে তাকেও ধরা দিতে হল! খুব কেঁদেছিল টুবাই! অজয় কে সে কোনও দিন পছন্দ করত না, তার রুক্ষ ব্যবহারের জন্য।
তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এই বামনী নদী, সেখানে একটা বিশাল বট গাছের তলায় এসে বসেছিল টুবাই! এই গাছতলাটা তার খুব প্রিয়! টুবাই যখন নিজের কষ্টের কথা ভাবে একমনে, তখন এই বটগাছটা যেন চুপ করে থাকে, ওর কথা বুঝতে চেষ্টা করে! দেখতে তাকে ছেলের মত হলেও মনে মনে সে তো একজন মেয়ে! তার ও তো কাউকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে! সে অবশ্যই কোনও ছেলে! একবার তাদের গ্রামের জোয়ান ছেলে চরন মূর্মু কে সে চোখের ইশারা করে হাত ধরেছিল, কিন্ত সে তখন তাকে এমন দূর ছাই করল আর সবার সামনে অপমান করল যে আর কোনও দিন সে কিছু চেষ্টাও করেনি! মনমরা হয়ে থাকত কেবল আর পড়াশুনোটা করত সাধ্য মতো!
তারপর তো এইসব করোনার অসুখের সময় স্কুল ও বন্ধ হয়ে গেল! একটা স্মার্ট ফোন মা তাকে কষ্ট করে কিনে দিল, তাতেই, দু বছর কোনরকমে পড়া চলল!
ড্যাম দেখতে মাঝে মাঝে ট্যুরিস্টরা আসে! ব্রিজের ওপর থেকে নদী দেখে তারা! টুবাই তাদের দেখে আর ভাবে, এই সব শহরের শিক্ষিত মানুষগুলো হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারে!
তার জীবনের এই সমস্যার কোনও সমাধান বের করে দিতে পারে!
একটা বড় গাড়ী এসে দাঁড়াল ড্যামের ব্রিজের ওপরে।
দুজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা নামলেন। টুবাই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়! মিষ্টি করে তার মেয়েলী গলায় জিজ্ঞেস করে,
"আপনারা কি কলকাতায় থাকেন?" দুজন মহিলাই হেসে বলে, "হ্যাঁ! তুমি কলকাতায় গেছ?"
"কলকাতার গড়িয়া বলে যে জায়গা আছে, আমি ওখানে মনামী চক্রবর্তীর বাড়ী গেছিলাম, উনি তো transgender-দের নিয়ে কাজ করেন! আমাদের এখানে একবার বেড়াতে এসেছিলেন। আপনারা ওনাকে চেনেন?"
ভদ্রমহিলারা যেন নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। একজন বললেন, "ও আচ্ছা! কলকাতা তো অনেক বড় শহর, তাই সবাইকে তো চেনা সম্ভব নয়!"
বলে নদীর ব্রিজের দিকে এগিয়ে চললেন। টুবাইও চলল, নিজের কথা বলতে বলতে, "ঐ মনামী দি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, অপারেশন করবার কথাও বলেছিলেন কিন্ত আমরা তো গরীব, অপারেশন করতে অনেক টাকা লাগবে, সেসব তো আমরা দিতে পারব না।"
আরেকজন মহিলা বলেন, "তুমি কি স্কুলে পড়?" না, এখন আমি কলেজে উঠেছি, এবার অনলাইনে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হল! আমি সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছি। রোগা টুবাইকে দেখে বয়স বোঝা যায়না।
টুবাই মহিলা দুজনের কাছাকাছি ঘোরে, তার শুকনো মুখ দেখে, মহিলা দুজনের বড় মায়া হয়! তারা ওর হাতে টাকা দিতে চান! টুবাই আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়! তাকে কি ওনারা ভিখারী ভাবছেন?
একজন বলেন, "আচ্ছা আমি তোমার কথা জানাবো, আমার এক বন্ধুকে, সে ও অনেক এনজিও'র সঙ্গে যুক্ত আছে!"
টুবাই এর চোখে যেন একটু আশার আলো ফোটে!
বলে, "আমার ফোন নম্বর নিন না, আপনার বন্ধুকে দেবেন, তাকে বলবেন, বামুনডিহির, টুবাই মাহাতো, অপারেশন করে মেয়ে হতে চায়!"
মহিলা দুজন কী বলবেন, বুঝতে পারেন না, সমবেদনা বোধ করেন! পুরুষ হয়ে জন্মানো এক মানুষের মনেপ্রানে নারী হয়ে উঠতে চাওয়ার যে কী যন্ত্রনা, সেটা বুঝতে চেষ্টা করেন!
'এই গ্রাম্য ছেলেটিও এখনকার ডিজিটাল যুগে, সব খবর রাখে, অথচ সে কতখানি অসহায়! তার এই সমস্যার সমাধান আদৌ কী সম্ভব?' এই সব ভাবনা ভীড় করে দুই মহিলার মনে!
তারা কিছুটা বিব্রত ও বোধ করছিলেন, ড্যাম দেখা হয়ে গেলে, টুবাই কে হাত নেড়ে তাড়াতাড়িই গাড়ীতে উঠলেন।
কলকাতার বাবুদের গাড়ী চলে গেল, পেছনে দাঁড়িয়ে টুবাই হাত নাড়তে লাগল! কোনও দিন কি ওর এই যন্ত্রনার থেকে মুক্তি হবে? যে স্বপ্নের সন্ধান দিয়েছিল কলকাতার এক দিদিমনি, তা কি কখনও সফল হবে?
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।