গল্প ও অণুগল্প

পিপাসা



অচিন্ত্য সাহা


ভোর চারটে নাগাদ টলতে টলতে সুহানির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সুজাতা। সারারাত ধরে আকণ্ঠ মদ্যপান করে, বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা মেরে, নাচনকোঁদন করে, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আনন্দ ফূর্তি করে, শরীরে শরীরে ঘর্ষণ করে যখন শরীরের পারদ খুব চড়ে গেছে তখন বুঝতে পেরেছে - না, অনেক হয়েছে আর নয়। এবার বাড়ি ফেরার পালা।

মুকুন্দপুরে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট নিয়ে সুহানি একাই থাকে। বছর পাঁচেক আগে কম্পিউটার সায়েন্সে পোস্ট গ্রাজুয়েট করে টি সি এস-এ কাজ করে। ব্যাঙ্গালোরে একটা কোম্পানি ভালো প্যাকেজ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ও অ্যাকসেপ্ট করেনি। মা-বাবার একমাত্র সন্তান সে, নদিয়ার আসাননগরে ওদের নিজস্ব বাড়ি। জায়গাজমি, পুকুর বাগান, সবই আছে, মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার। কাকু জ্যেঠু এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততি মিলিয়ে বাড়িতে প্রায় জনা পঁচিশেক সদস্য।

সুহানি একটু একা থাকতে ভালোবাসে তাই বাড়ি যাওয়ার নাম মুখে আনে না। ন’মাসে ছ'মাসে একবার বাড়ি যায়। বাড়ির হৈ-হুল্লোড় ওর একেবারেই পছন্দ হয় না। মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প গুজব করা , ওদের সাথে সময় কাটানো পর্যন্ত ঠিক আছে। সেটাও যে সব সময় ভালো লাগে তাও না। যখন নিজেকে খুব একা মনে হয় তখন ওর ফ্ল্যাটে সবাইকে ডেকে নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে সেলিব্রেট করে। পরিণত হবার পর মনে ধরার মতো কেউ ওর চোখে পড়েনি তাই একাই থাকে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে একজনকে ভালো লেগেছিল। তখন সুহানি নবম শ্রেণির ছাত্রী। ওদের স্কুল কো-এড হওয়ায় ছেলে-মেয়েরা সহজেই পরস্পরের সাথে গল্পগুজব করতে পারতো। স্কুলের গণ্ডীর বাইরেও ওরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। সেবার সরস্বতী পুজোর সময় পুজোর সাজসজ্জা, আলপনা দেওয়া, ফলমূল কেটে দেওয়া সহ সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে দেওয়ার দায়িত্ব নবম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা পায়। একাদশ শ্রেণির ছাত্রদের উপর বাইরের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় - প্রতিমা আনা, বাজার করা, পুরোহিত মশাইকে ধরে আনা, দই-মিষ্টির ব্যবস্থা করা এবং পুজোর শেষে সেগুলো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখিয়েছে একাদশ শ্রেণির ছাত্র সৌরদীপ মিত্র। ওর দায়িত্ব জ্ঞান ও কর্তব্যনিষ্ঠা সকলের মন জয় করে নেয়। সরস্বতী পুজোর খাওয়া-দাওয়ার পর্বে সৌরদীপ আরও কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। সুহানির অপরিণত হৃদয়ে সৌরদীপ যেন আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। বাড়ি ফিরে সুহানির মনে হয় কখন রাত শেষ হয়ে সকাল হবে, কখন স্কুলে যাবার সময় হবে, কখন সৌরদীপের শিখায় ওর অন্তরটা স্নাত হবে। যত দিন যায় সৌরদীপের প্রতি ওর দুর্বলতা ক্রমশ বেড়ে যায়। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারে না। স্কুলে সুহানি একটু লাজুক প্রকৃতির। লুকিয়ে লুকিয়ে আড়াল থেকে সৌরদীপকে দেখে। সুহানির এই লুকোচুরি ধরা পড়ে ওদের স্কুলের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক বিমল বাবুর কাছে। বিমল বাবুর শকুনের চোখ, তাঁকে এড়িয়ে স্কুলের ছেলেমেয়েরা কোনো গর্হিত কাজ করতে পারে না। তাঁর চোখে ঠিক ধরা পড়বেই। বিমল বাবু সুহানিকে ডেকে নিয়ে বিষয়টি জানতে চান। সুহানি ভয়ে অস্থির হয়ে যায়, বিমল বাবু ওকে অভয় দেন। সুহানি বিমল বাবুর কাছে সব খুলে বলে। বিমল বাবু বুঝতে পারেন যে, জল বেশিদূর গড়াইনি। তবে এটা এভাবে চলতে দেওয়া যায় না, বড়ো কিছু ঘটার আগেই এটাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে নচেৎ স্কুলের রেকর্ড বুকে কালোদাগ পড়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে করা যায়? ওর মা-বাবাকে কী জানানো ঠিক হবে? সম্ভবত না। স্কুলের কোনো স্টাফের সঙ্গে আলোচনা করাও ঠিক হবে না। বেশি জানাজানি হলে উভয়েরই ক্ষতি। ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে - সৌরদীপের বাবা হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে যান। একটা লঝঝড়ে সাইকেল ছিলো সৌরদীপের বাবার নিত্যসঙ্গী । ওই সাইকেল নিয়ে আরও দু'চার জনকে সাথী করে গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে যান এবং তাদের খবরাখবর নেন। ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার মহেশপুর, মহাখোলা, ফুলকলমি, মধুপুর প্রভৃতি গ্রামে বেশি যান। ওখানেই সীমান্ত এলাকার মানুষের মাঝে তিনি প্রায়শই হারিয়ে যান। সৌরদীপের মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। দুটো জলভরা চোখের চাহনি কেবল অপেক্ষা করে থাকে বছরের পর বছর। শুধু এই অপেক্ষায় যে, একদিন হয়তো মানুষটি সবকিছু বুঝতে পারবেন। কিন্তু কোথায় কী, একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি উধাও হয়ে যান। সৌরদীপ বড়ো হয়েছে, সংসারের প্রতি বাবার উদাসীনতা বুঝতে পারে। বাবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কারণও ওর কাছে চাপা থাকে না। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ও কিছু বলতে পারে না। মা মনে ব্যথা পাবেন ভেবে সৌরদীপ নীরবে দিনযাপন করে। খুব বেশি কষ্ট পেলে নির্জনে বসে একা একা রবীন্দ্রনাথ পড়ে অথবা রবিঠাকুরের গান শোনে। এটাই ওর সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনা। পিতৃমাতৃস্নেহের অনন্ত পিপাসা বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে। রবীন্দ্রনাথের লেখা গান এবং কবিতার জলছবিতে খুঁজে পায় অব্যক্ত স্নেহের পরশ। তবুও পিপাসার হিমশীতল হিমশৈল ওর বুকের গোপন কুঠুরিতে বন্দী হয়ে থাকে।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন পনেরো আগে একদিন সৌরদীপকে হঠাৎ প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের অফিসে দেখা যায়। সুহানি তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কী একটা বিশেষ প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষক মহাশয় সুহানিকে তলব করেছিলেন। অফিস রুমে ঢুকে সুহানি একটু ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ সৌরদীপ এতদিন পর, কোথা থেকে? সৌরদীপের মুখ থেকে শোনা যায় ওর বাবার খোঁজে ওকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে, অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাড়ি, বাড়ি আর হাসপাতাল - এসব করতে করতেই পুরো একটা বছর চলে গেছে। বাবা নিরুদ্দেশ আর মা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে। এতবড় পৃথিবীতে সে আজ বড়ো একা। বিজয়ওয়াড়াতে একটি কারখানায় কাজ পেয়েছে সৌরদীপ। ওখানে চলে যেতে হবে আগামী সপ্তাহে। ওরা একটা চারিত্রিক শংসাপত্র চেয়েছে। সেটা নিতেই ওর আজ স্কুলে আসা। হেডমাস্টারমশাই পুরোটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সুহানির চোখে জলের ধারা, কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। মাস্টারমশাই বললেন - পড়াশোনা ছেড়ে এই অল্প বয়সে...

- কিছু করার নেই স্যার। কার জন্য এখানে থাকবো বলতে পারেন? এখানে আমার আপন বলতে কেউই নেই। মার মুখে শুনেছি দুর্গাপুরে আমার জ্যেঠু কাকুরা আছেন। কিন্তু আমি কোনোদিন সেখানে যাইনি বা ওদের কাউকেই চিনি না। কোন ভরসায় যাবো বলুন? তার চেয়ে নিজের পথ নিজেকে খুঁজে নেওয়াই ভালো নয় কী?

হেডমাস্টারমশাই চশমার ফাঁক দিয়ে একবার সুহানিকে দেখে নিয়ে ইশারায় ওকে বসতে বলে খসখস করে সৌরদীপের কারেক্টার সার্টিফিকেট লিখতে বসলেন। সুহানির মনে হলো একবার ওকে বলি - সৌরদীপ তুমি যেওনা। আমাদের বাড়িতে চলো। অন্তত পড়াশোনাটা শেষ করো। তারপর যেখানে মন চায় যেও। তোমার আপনার জন হয়তো কেউ নেই কিন্তু আমি...

না, সুহানি বলতে পারেনি। চারিত্রিক শংসাপত্র হাতে নিয়ে সৌরদীপ যখন স্কুলের সীমানা পেরিয়ে গেল তখন একছুটে সুহানি স্কুল গেট পর্যন্ত গিয়ে থমকে গেল। প্রধান শিক্ষক হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একা একা থাকলে সৌরদীপকে বড্ড মনে পড়ে সুহানির। ওর মনের গভীরে যত হাসি-আনন্দ, ব্যথা-বেদনা ছিলো সবটাই যে সৌরদীপ শুষে নিয়েছে। রেখে গেছে এক অন্তহীন পিপাসা, যা আজও সে বহন করে চলেছে। প্রতিনিয়ত ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সেই ব্যর্থতার যন্ত্রণা। ওর চোখ দুটি খুঁজে ফেরে সেই মায়াভরা দুটি চোখকে যা একসময় ওর হৃদয়মন্দিরে আসন পেতেছিল। সুজাতা ওর কলেজ জীবনের সঙ্গী। ওর কাছে সবকিছু সহজেই বলা যায়। সৌরদীপের কথা সুজাতা জানে। সুজাতার গ্রামের বাড়ি মাজদিয়া। মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ী মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফর্সা টুকটুকে শান্ত এবং ছোটোখাটো মেয়েটিকে ক্লাসের এককোনায় বসে থাকতে দেখে সুহানিই প্রথম ওর কাছে গিয়ে কথা বলে - এই মেয়েটি, তোর নাম কীরে? ঘরের এককোণে একা একা বসে আছিস কেন?

ও বলেছিল - সুজাতা, আমার একা থাকতেই বেশি ভালো লাগে।

- দুর পাগলি কলেজে এসে একা একা থাকা যায়? চল, চল বলছি।

একরকম টেনে হিঁচড়ে ওকে বাইরে নিয়ে এসেছিল সুহানি। পরস্পর পরস্পরের মনের কথা বিনিময় করেছিল। বুঝতে পেরেছিল ওরা দুজনেই একই পথের যাত্রী।

- বোধিসত্ত্বকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল সুজাতা। শিবনিবাসে পুরনো শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছিল - কেউ কাউকে কোনোদিন ছেড়ে চলে যাবে না। সে যত বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন।

বোধিসত্ত্ব কথা রাখেনি। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলো বোধিসত্ত্ব। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শোনা গেল বোধিসত্ত্ব বড়ো বাজারের কোনো এক মারোয়াড়ী পরিবারের অপূর্ব সুন্দরী একমাত্র কন্যার প্রেমে পাগল হয়ে সুজাতাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। সুজাতা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যেদিন ও নিজের চোখে দেখলো সেদিন জীবনের প্রতি চরম ঘৃণায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সুজাতা চেষ্টা করেও ছিল, কিন্তু ওদের পাড়ার বিথীনদা ওকে সে যাত্রায় রক্ষা করে এবং নানা উপদেশ দেয়। বিথীনদার কথায় উপোষী মনকে সান্ত্বনা দিয়ে নতুন উদ্যমে আবার পড়াশোনা শুরু করে। মাঝে একটা বছর নষ্ট হলেও সুহানিকে পেয়ে ও পুরনো সব দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণাকে ভুলে যায়। তারপর আকাশের বুকে কত পূর্ণিমা অমাবস্যা আসা-যাওয়া করেছে, কত বসন্ত নিঃশব্দে চলে গেছে। ফুলেরা পাপড়ি মেলে ধরেছে, কতশত ভ্রমর-ভ্রমরী মধুপান করেছে, কপোত-কপোতী মেঘমুক্ত আকাশে ডানা মেলে পরস্পরকে পূর্ণতা দিয়েছে। কিন্তু এই দুটি তৃষাতুর চাতকিনীর আন্তর পিপাসার নিরসনে কেউ এগিয়ে আসেনি।

সুজাতা সেক্টর ফাইভের একটা টু-রুম ফ্ল্যাটে একাই থাকে। বাইরের কাজের জন্য একটা মেয়ে বাদকুল্লা থেকে আসে। প্রতিদিন কাজ করে, মাঝে মধ্যে রান্নাবান্না সেরে পাঁচটা আটত্রিশের কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনগুলোতে ও কাজে আসে না। অন্যান্য দিন নিজের মতো করে কাজকর্ম সারে, খাওয়াদাওয়া করে তারপর বাড়ির জন্য খাবার নিয়ে চলে যায়। পুজোর কটা দিন সুজাতা গ্রামের বাড়িতে যায়। সাউথ ক্যালকাটার একটা শপিং মলে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে সুজাতা। কাজটাতে বেশ বৈচিত্র্য আছে - কত রকমের, কত ধরনের মানুষ এখানে আসেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বোধিসত্ত্বের মতো কাউকে দেখতে পায় না। খুব ইচ্ছে করে ওকে দেখতে। বোধিসত্ত্ব ওর মনে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তা সহজে পূর্ণ হবার নয়। এক অন্তহীন পিপাসা বুকে নিয়ে সুজাতা অপেক্ষা করে। ফুরিয়ে যায়নি ওর অনন্ত পিপাসা, ফুরোয়নি ওর প্রথম ভালোবাসার মানুষটি, হয়তো বোধিসত্ত্ব কোনো এক অচেনা জগতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে অথবা কারও অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হয়তো বা সৌরদীপও মিশে গেছে বোধিসত্ত্বের মধ্যে।

সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে প্রবল বৃষ্টি। কলকাতার রাস্তায় জল জমে গেছে, বেশির ভাগ রাস্তার মুখে নো-এন্ট্রি বোর্ড বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল খ্রীস্টমাস ডে অর্থাৎ বড়দিন। কলকাতার বহুতল বাড়িগুলোকে আলোক মালায় সজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির তীব্র শাসনে সুসজ্জিত আলোকরশ্মি ম্লান হয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপোস্টগুলিও অসহায়ের মতো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেশি নেই। দুই একটা গাড়ি তীব্র গতিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। সুহানি নিজেই ড্রাইভ করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় এগারোটা বাজে - ইস্! অনেক দেরি হয়ে গেল। সিকিউরিটি কাকু আজ নির্ঘাত বকবক করবে।

স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে বাঁকের মুখে ঢুকতেই সুহানি দেখতে পেল কে যেন বৃষ্টিতে ভিজে প্রবল ঠাণ্ডায় কাতরাচ্ছে। তখন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। সুহানি গাড়ি থেকে নেমে এলো। কাছে গিয়ে দেখতে পেল একমুখ দাড়ি গোঁফ ভর্তি একটা লোক। মোবাইলের আলোটা জ্বেলে লোকটাকে দেখে ওর বড্ড মায়া হলো। গায়ে একটা বহু পুরনো ছেঁড়া কম্বল, ভিজে একেবারে চুপসে গেছে। সুহানি অনেক চেষ্টা করে টেনে হিঁচড়ে কোনো রকমে লোকটিকে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। গায়ের কম্বলটা ফেলে দিয়ে অনেক কষ্টে টেনেটুনে লোকটাকে গাড়ির পিছনের সিটে বসিয়ে দিল। ফ্ল্যাটে পৌঁছে গাড়িটা গ্যারাজে ঢুকিয়ে লোকটিকে বার করার জন্য সিকিউরিটি কাকুকে ডাকলো। সিকিউরিটি এসে ওকে সাহায্য করে এবং সুহানির নির্দেশ অনুযায়ী একটু গরম গরম খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করে নীচের ড্রাইভার রুমে জায়গা করে দেয়। সুহানি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে উপরে নিজের ঘরে ঢুকে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। মিনিট পনেরোর মধ্যে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে আসে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় বারোটা বাজে। অর্থাৎ সুজাতা এখনো জেগে আছে। ঘটনাটা ওকে জানানো দরকার।

রাস্তায় এতো জল জমেছে যে, সুজাতা যখন ঘরে ঢুকলো তখন ফ্ল্যাটের সব আলো নিভে গেছে। বাইরে ছাতা মাথায় ওয়াচ ম্যান ড্রেনের মুখ থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে জল বেরিয়ে যাবার রাস্তা করে দিচ্ছে - এই অসময়ের বৃষ্টিতে সুজাতার মেজাজটাই বিগড়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস কোম্পানির গাড়ি ওকে পৌঁছে দিয়ে গেল। নিজের গাড়িটা সার্ভিসিং-এ দেওয়া আছে। নাহলে আরও আগে বাড়ি ফিরতে পারতো। তবুও বাঁচোয়া কাল ছুটি আছে। যাক অনেক রাত হয়েছে, খিদেটাও পেয়েছে বেশ। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খাবার গরম করে খেয়ে শুতে হবে। কাল এগারোটার আগে উঠছি না বাবা। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। এত রাতে আবার কে রে বাবা?

ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে সুহানির কণ্ঠ - সুজি জেগে আছিস?

- হ্যাঁ, কেন?

- কাল সকালে আমার ফ্ল্যাটে আয়। একটা ঘটনা ঘটেছে, আয় সব বলছি।

- কী ব্যাপার, বল না, প্লিজ।

- না বন্ধু, এখন নয়। কাল সকালে।

ফোনটা কেটে দেয় সুহানি।

খুব ভোরে সিকিউরিটি কাকুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে সুহানির - দিদিমণি, দেখ না, লোকটা কেমন করছে।

সুহানি দরজা খুলে বলে - কী হয়েছে।

- কাল রাতে তুমি যাকে এনেছো, সারারাত ছটফট করেছে, একটুও ঘুমোয়নি। আর কেবলই সুজাতা দিদিমণির নাম করছে।

সুহানির ঘুমের ঘোর কেটে যায়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নীচে নেমে আসে। ভোরের আলো তখন সবেমাত্র ফুটতে শুরু করেছে। সুহানি লোকটার কাছে গিয়ে দেখলো - জীবনের মেয়াদ আর বেশিক্ষণ নেই। এখনো প্রাণটা ধরে আছে, মনে হচ্ছে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। সুহানি লক্ষ্য করলো - লোকটির ঠোঁট দুখানি কেঁপে কেঁপে উঠছে, কী যেন বলতে চাইছে। সুহানি এবার শুনতে পাচ্ছে - লোকটি অস্ফুট স্বরে বলছে - সুজাতা এ জন্মে তোমার সঙ্গে দেখা হলো না। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো।

সুহানি সুজাতাকে ফোন করে - সুজি তাড়াতাড়ি চলে আয়। তোর জন্য কেউ একজন অপেক্ষা করছে।

সকালের কলকাতা। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা নেই বললেই চলে। তবুও অনেক চেষ্টায় একটা গাড়ি জোগাড় করে সুজাতা নিজেই ড্রাইভ করে যখন সুহানির ফ্ল্যাটে এলো তখন সব শেষ। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার পরে সুহানি দেখতে পেয়েছিল - লোকটার ডান হাতের মুঠো থেকে একটা রুপোর সিঁদুর কৌটো গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।

সিঁদুর কৌটো দেখে চিনতে বাকি রইলো না সুজাতার। সেদিন শিবনিবাসে বোধিসত্ত্বের হাতে এই কৌটোটাই ছিলো। সুজাতা সেদিন সিঁথিতে সিঁদুর পরতে রাজি হয়নি।

এক অনন্ত পিপাসা বুকে নিয়ে বোধিসত্ত্ব চলে গেল। সুজাতা এবং সুহানি পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলো - ওদের পিপাসার্ত হৃদয় জুড়ে তখন এক আকাশ শূন্যতা।