কার্তিক মাসের প্রথম থেকেই বিলের জমিতে সারাদিন পড়ে থাকতে হয় দামোদর তীরবর্তীর বাসিন্দাদের।। হাঁটু সমান জলের কচুরিপানা, আগাছা, শেওলা টেনে এনে গাঁদা মেরে রাখে বিলের পাড়ে ও আল বরাবর। পায়ের পাতা ডোবা জলে কাদা করে বোরো ধান রোপন করার কাজ শুরু হয় অগ্রহায়ন মাস থেকে। কাদা করার কাজটা কঠোর পরিশ্রমের। চারবার চাষ দেওয়ার পর বিদে যাবে একবার। তারপর মই টানা। মই টানার কাজটা মণিকুমার নিজেরাই করে। মই-এর উপর গাছের মোটা ডাল চাপিয়ে মই-এ বাঁধা দড়ি কোমরে কষে বেঁধে হাটুর নীচ অবধি কাদার মধ্যে সর্বশক্তি দিয়ে পা টেনে তুলে জমির এমাথা-ওমাথা করে। শরীরে কাদার একটা প্রলেপ পড়ে যায়। শুকিয়ে উঠলে চামড়ায় টান ধরে। হাত-পা কুটকুট করে। ফুলটুসি মই টেনে হাঁফিয়ে গেছে। জিড়িয়ে নিচ্ছে কচুরিপানার স্তূপের উপর বসে। ছোটো সরকারবাবুর একদিন মই-চড়ার সখ হয়েছে। এদিকেই এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। এসেই বায়না করবে, 'রাঙাঠাম্মি আমি মই-এ উঠব'।
'আহা-রে, দুধের ছেলে মা হারা হল! ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায় ফুলটুসির। এই সেদিন ওদের বাড়ি বিদে আনতে গিয়ে দেখে, অপুর ওলের তরকারিতে গলা কুটকুট করছে, সেকথা কাকি, নতুন মাকে সাহস করে বলতে পারছে না, বকুনি খাওয়ার ভয়ে। এক এক গরাস করে গিলছে আর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
'কী অপু তরকারিতে খুব ঝাল বুঝি? ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে'।
'গলা চুলকাচ্ছে'?
'ও বৌমা - তোমরা ছেলেটাকে মোটেই খেয়াল কর না। গলা ধরেছে, সে কথা মুখ ফুটে বলতে পর্যন্ত বলতে পারছে। কেমন ধারা মা-কাকিমা তোমরা? দাঁড়া ভাই, দাঁড়া তেঁতুল নিয়ে আসি। তেঁতুল খেলে সেরে যাবে।'
ফুলটুসি ঘর থেকে তেঁতুল এনে অপুর হাতে দিয়ে বলল, 'খা দাদা, গলা ধরা সেরে যাবে'।
ফুলটুসিদের বিলে কাজের সময় অপু এসে হানা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। কতরকমের বায়না করে। কাদা-মাটি নিয়ে খেলা করে। ফুলটুসির নিষেধ মানে না। নিষেধ বেশি করলে কাদা জলে নেমে গিয়ে খলখল করে হাসে। এমন শিশুকে ভালো না বেসে পারা যায়?
অপু বিলের পাড় ধরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে একজন শহুরে মহিলা। গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। ফটাফট ছবি তুলে যাচ্ছে। অপু কাছে এসে বলল, 'এ হল কুন্তি দিদিমণি। আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সকালবেলায় বিলের শালুকফুলের অনেক ছবি তুলেছে। আগে কখনও এত শালুকফুল দেখেনি কিনা! পাখির ছবি তুলবে তাই ওই দিকে নিয়ে যাচ্ছি'।
'মণিকুমার বলে, এখনও তেমন একটা পাখি আসেনি। জাকিয়ে শীত পড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি নামে, উড়ে যায়। বাতাসে শ' শ' আওয়াজ হয়'।
বেশ কয়েকটি শামুক খোল এই বিলেই আস্তানা গেড়েছে সারাবছরের জন্য। কয়েকদিন আগে ভাণ্ডি শামুক খোল ধরে রান্না করে খেয়েছে। একটুকরো মাংস বিষ মাখিয়ে বর্শীতে গেঁথে দিয়েছিল। বিষ মাখানো মাংসের টুকরো গিলতে গিয়ে গলায় আটকে সে কী আছাড়ি বিছাড়ি। অপু খুব কেঁদেছিল। মাকে হারানোর কান্নার তোড়ের মতো। রাঙাঠাম্মি অনেক বুঝিয়ে, ভালোবেসে কান্না থামিয়ে ছিল। শামুকখোলের দল ঝুপ করে বিলের জলে নেমে খুঁটে খুঁটে খায়। সারাদিনের এক এক সময় জলে ছায়া পড়ে এক এক রকমের.. অপু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। নিজের ছায়াও দেখে কাদাজলে। গরু, মোষ,ছাগল চরে বেড়ায় পাড় দিয়ে। বক, ফিঙে, শালিকপাখি- গরুর পিঠে উঠে ঘুরে বেড়ায়। অপুর খুব ইচ্ছে করে গরু- মোষের পিঠে উঠে চরে বেড়াতে - কী মজাটায় না হত।'
পড়ন্ত বিকেলের সূর্যরশ্মি বিলের জলে রং গুলে দেয়। ডোঙার খোলের জলটুকু পর্যন্ত রঙিন হয়ে ওঠে। লাল টুকটুকে সূর্যিমামা তালগাছের মাথার ওপাশে ডুব দেয়। জল - যে কে সেই হয়ে যায়। অপু তার ডাগর চোখ মেলে বিশ্বপ্রকৃতির অপূর্ব রূপের বদল দেখে। সকালে নীল-সাদা মেঘের ছায়া তার মন ভালো করে দেয়। মায়ের উপর অভিমান হয়। কেন যে মা তাকে একা রেখে চলে গেল? কত কষ্ট হয় তার। মা কেন আবার ফিরে আসে না? দুগ্গা ঠাকুরের মতো তার মাকে চওড়া করে সিঁথিত সিঁদুর পরিয়ে, পায়ে আলতা পরিয়ে, নতুন কাপড়ে ঢেকে কাঁধে করে নিয়ে গেল। কতগুলো লোক। ... দুগ্গাঠাকুরকে মায়ের মতো করে সিঁদুর পরালো কত মানুষ। ঠাকুরের মুখে সন্দেশ দিয়ে কানে কানে কী যেন বলছিল সবাই। অপু জিজ্ঞেস করছিল রাঙাঠাম্মিকে, ঠাকুরের কানে কী বলছে সবাই?'
উত্তর দিল,' মা -তুমি আবার এসো। সেইজন্য ঠাকুর প্রতিবছর আসে।'
'আমার মাকে কেউ বলে দেয়নি বলে আসে না - তাই না ঠাম্মি?'
ফুলটুসি বোবা হয়ে যায়। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। অপুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। এ - দৃশ্য দেখে অন্যরা অবাক হয়ে যায়। ছোটো সরকারবাবুকে কোলে তুলে নেয় সে। ডাগর চোখের ছেলেটির জন্য বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠে। পৃথিবীর আলো দেখার দিন ফুলটুসি ছিল হাসপাতালে। ভগবানের বিচার নাই ! এমন ছেলের; এমন কপাল! ভালোবাসে সবাই; কিন্তু মায়ের ওম? কেউ দিতে পারে না। কেউ না। বাবা তার নতুনমাকে নিয়ে ব্যস্ত! অপুকে এই বিল পাঁচমাসে অনেক আপন করে নিয়েছে।
ডোঙাদাদু প্রতিদিন আটি বেঁধে শালুক তুলে আনে। অপু সঙ্গী হয়। বেলা হয়ে গেলেও হেমন্তের হিম ধানের চারার উপর টলমল করে। অপু বড়ো একটা পাটকাঠি দিয়ে শিশির বিন্দু সরিয়ে দেয়। ঠাকুরদাদার কাছে শুনেছে বেশি শিশির পড়লে ধানের চারা নষ্ট হয়ে যায়। মাতৃহীন ছয় বছরের অপু বিলের বুকে ঘটে চলা ঘটনার মস্তবড়ো দর্শক। ডাগর চোখ মেলে দেখে। বিস্মিত হয়। কখনও তাদের একজন হয়ে ওঠে। অঙ্কুরিত ধান কাদার উপর ছড়িয়ে দিলে সকালে-বিকালে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি চলে আসে। দল বেঁধে নামে। পাখিদের শা করে নামা শা করে উড়ে যাওয়া অপুর ভীষণ ভালো লাগে। দিন দশেক পাখিদের তাড়াতে হয়। অপু যেচে সাথ দিয়েছে দাদুর। সবুজ পাতা বেরিয়ে গেলে পাখির উৎপাত কমে আসে। ধান থেকে ধানগাছ হওয়া ওকে বেশ কয়েকদিন মাতিয়ে রেখেছিল। ধান রোদে দেওয়া, জলে দুই দিন ভিজিয়ে রাখার পর জল ঝরানো, বিচুলি বিছিয়ে তার উপর তাবু,কলাপাতা বিছিয়ে জল ঝরানো ধান ছড়িয়ে দিল। কলাপাতা দিয়ে ঢেকে বিচুলি বিছিয়ে আবার তাবু দিয়ে ঢেকে দিল। অপু রোজ কোনার কলাপাতা উঁচু করে গাছ বেরিয়ে আসা দেখার লোভ সামলাতে পারেনি। বকুনি দুই-একবার খেতে হয়েছে। আট/দশ দিন পর মুখ ফেটে সাদা অঙ্কুর বেরিয়ে এলে কাদার উপর ছিটিয়ে দিলেই ধানগাছ হয়ে গেল। বীজ থেকে চারা হয় জানে,কিন্ত এমন বাস্তব অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। মা করোনায় মারা না গেলে; অজানায় থেকে যেত। রাজস্থানের ছোট্টো শহরে দু-কামরার ঘরে মা-বেটার সময় কেটে যেত, স্কুলের সময়টুকু ছাড়া। বাবা রুগী নিয়েই ব্যস্ত। ঠিক সময় মতো চিকিৎসা করলে তার মা মারা যেত না... ঠাকুরমার মুখে শোনে ...বাবার উপর রাগ হয়। তাইতো ডাকলেও কাছে যায় না।
অপুর নোয়া ঠাম্মি সর্ষে, ছোলা, মটর, মুসুরি,মুগ, তিল, তিসি, পালং শাকের বীজ, লাল শাকের বীজ উঠোনে পাটি বিছিয়ে রোদ দেয়। রঙ্গলি মনে হয় অপুর। রাজস্থানে কত রঙ্গলি দেখেছে দেওয়ালির সময়।
এই সব বীজ ছড়িয়ে দিলেই মাস খানেকের মধ্যে বিলের বুক ফসলে ভরে ওঠবে। চাষের দরকার নেই কাদা মাটিতে ছড়িয়ে দিলেই হল। পড়ন্ত বিকেলে রঙ-বাহারি বিলের অপরূপ সৌন্দর্যে ফুলটুসি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিশোরীবেলায় তার বাপের গাঁয়ের শীতকালের মাঠ আর এই বিলের সাজ একাকার হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় রাখাল পরিকে। মণিকুমারের প্রতি টানে কোনো ফাঁক নেই, কিন্তু পরিদাদাকে ভুলতে পারেনি আজও। বিয়ের পরে তাদের দেখা হয়নি কত যুগ!
(ক্রমশ)