[১৯২৬ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখে কবি সপরিবার কৃষ্ণনগর এসেছিলেন, এনেছিলেন হেমন্তকুমার সরকার। কবিকে কেন এনেছিলেন তিনি? শুধুই বন্ধু বলে? প্রতিভাবান কবি বলে? মাস ছয়-সাতেক গোলাপট্টিতে থেকে কবি গ্রেস কটেজে আসেন। ঠিক কবে আসেন তিনি? জুলাই, নাকি আগস্ট? কেনই বা এলেন এই বাড়িতে? ভীষণ দারিদ্র্যের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে নির্জন এক প্রান্তে? অনেক কিছুই আমরা জানি না, জানাও যায় না। এখান-ওখান থেকে জোগাড় করা তথ্য আর তার সাথে খানিক অনুমান মিশিয়ে টুকরো কথার কিছু দৃশ্য সাজিয়ে তোলার চেষ্টা এই কাহিনীতে।]
পর্ব - ৬
কৃষ্ণনগরে শীতের দুপুর বলে বোধহয় কিছু হয় না। এমনিতে খ'ড়ে নদীর কুয়াশা সারা সকাল গোয়াড়ি বাজারকে চাদরের মতো ঢেকে থাকে। একটু বেলা হলে সূর্যদেব মুচকি হেসে রাজবাড়ির উপর খানিক আলো বিছিয়ে টুক করে চার্চের দিকে হেলে পড়েন। স্নান-খাওয়া সেরে আয়েশ করে রোদ পোহানোর জন্য ছাদে উঠতে না উঠতেই দুপুরটা বিকেল হয়ে যায়।
নজরুলের নতুন বাসায় অবশ্য ছাদে ওঠার সুযোগ নেই। ঘর বারান্দা উঠোন নিয়ে জায়গা অনেকটা, কিন্তু উপরের অংশে গৃহকর্তা হেমন্ত সরকারের দাদা জ্ঞান সরকারের সংসার। ভিতর বারান্দা দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি আছে, কিন্তু খুব দরকার ছাড়া ব্যবহার হয় না। রাস্তার দিকে জ্ঞান সরকারের হোমিওপ্যাথি চেম্বার আর তার পাশ দিয়ে সরাসরি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। অবশ্য কাল থেকে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে জ্ঞান সরকারের স্ত্রী তিন-চার বার ওঠানামা করেছেন। দাঁড়িয়ে থেকে কাজের মেয়েকে দিয়ে কলতলা, উঠোন, রান্নাঘর সব পরিষ্কার করে দিয়েছেন। শিবেনকে দিয়ে গোয়াড়ি বাজার থেকে তেল-নুন, তরি-তরকারির পাশাপাশি একটা উনুন আর কয়লাও আনিয়ে দিয়েছেন। হাই স্ট্রিটে তারক দাসের নিজের কয়লার দোকান আছে, খবর দিলেই কয়লা পৌঁছে দিয়ে যাবে।
নজরুল বিস্ময়ের চোখে গিরিবালা দেবীকে দেখছিলেন। কী আশ্চর্য দক্ষতায় একদিনের মধ্যে উপরের বৌদি, তাঁর কাজের মেয়ে, আর শিবেনকে নিয়ে সংসারটিকে গুছিয়ে ফেলেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে আশপাশের মানুষজনের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতে পারা, তাদের দিয়ে সংসারের দরকারি টুকটাক কাজ করিয়ে নেবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে মাসিমার। বিয়ের পর থেকে সংসারের যাবতীয় হাল তিনিই ধরে রেখেছেন। অভাব অনটন আর সংসারের পারিপার্শ্বিক ঝামেলার প্রায় পুরোটাই তিনি একা হাতে সামলেছেন - দোলনের গায়ে আঁচ লাগতে দেননি।
বিয়ের পরেই বা কেন? তার আগে থেকেই যা কিছু সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়েছেন। বহরমপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ঘন ঘন কান্দিরপাড় যাওয়া, শহর জুড়ে তির্যক কানাকানি, গুঞ্জন - তার সঙ্গে দোলনের প্রায় হিতাহিত জ্ঞান-শূন্য প্রেম, মুগ্ধতা - এসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে সরাসরি নজরুলকে জিগ্যেস করেছিলেন - "নুরু, তুমি কি সত্যিই অন্তর থেকে দুলিকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত আছ"?
এরকম একটা সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনও ক্ষোভ প্রকাশ নয়, হা-হুতাশ নয়, লজ্জায় মুষড়ে পড়া নয় - স্পষ্ট করে নজরুলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, ইচ্ছেটা জানলেন। বলা ভালো স্বীকারোক্তির সাথে একপ্রকার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন। তারপর আর দ্বিতীয় বার না ভেবে ঘোষণা করে দিলেন সিদ্ধান্ত - "ঠিক আছে, তুমি ব্যবস্থা কর, আমি বিয়ে দেব। দুলির কথা ভেবে আমরা দু'জনেই সাগরে ঝাঁপ দিচ্ছি - এই কথাটা শুধু তুমি মনে রেখো"।
দৃঢ় এবং স্পষ্ট উচ্চারণ। যেমন জেদ, তেমনি সাহস। কুমিল্লা জুড়ে সেনগুপ্ত পরিবারকে কে না চেনে! ভাসুরের পরিবারে আশ্রিতা বিধবা ভ্রাতৃবধূ - সেই পরিবারেরই আভিজাত্য আর মান-সম্মানের উপর কলঙ্ক লেপন করার অপরাধ মাথায় নিয়েও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে মেয়েকে নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন - একাই - চালচুলোহীন বাউন্ডুলে এক কবির ভরসায়। শ্রদ্ধার সাথে একরকম অপরাধবোধে গিরিবালা দেবীর সামনে মাথাটা নত হয়ে আসে নজরুলের। ঘরে সদ্য সন্তানহারা কন্যা, তার সঙ্গে ম্যালেরিয়া প্রকোপে মরণাপন্ন অভাবী জামাতা - এরকম অবস্থায় অচেনা এক শহরে কোথা থেকে ধার-দেনা করে কিভাবে যে তিনি সংসার চালাতেন - ভেবে অবাক হওয়া ছাড়া কিছু মাথায় আসত না। প্রাণতোষ মইনুদ্দীনেরা বাধ্য ছেলের মত মাসিমার এটা-সেটা সব ফাই-ফরমাস শুনে যেত। এখানে যাওয়া, ওখানে যাওয়া, ওষুধ নিয়ে আসা, বরফ জোগাড় করা - বিনা বাক্যে তারা মাসিমার সব নির্দেশ পালন করে যেত। কৃষ্ণনগরে ওদেরকে আর কাছাকাছি পাওয়া যাবে না - কথাটা মনে হতে একটা শূন্যতা ভেসে উঠল।
কিন্তু সেই শূন্যতাকে ছাপিয়ে উঠোন জুড়ে নতুন সংসারের কলরব ভেসে এলো। উপরের কাজের মেয়েটিকে দিয়ে মাসিমা অনেক কাজই করিয়ে নিচ্ছেন। কথা গল্পের ফাঁকে ফাঁকে এপাশ ওপাশ ঝাড়ু দেওয়া, ইঁদারা থেকে জল তুলে দেওয়া - মেয়েটি করেও দিচ্ছে বেশ। হয়ত উপর থেকে বলাও হয়েছে সেরকম। নতুন জায়গায় সংসার পাতা - প্রথম প্রথম কত কী দরকার হবে। মাঝবয়সী, ভারি চেহারা, কাজকর্মে হাতও চলে ভালো। তবে হাতের চেয়ে তার মুখ চলে দ্বিগুণ দ্রুতগতিতে। উঠোন থেকে বারান্দা পেরিয়ে তার উচ্চকণ্ঠ আত্মবিবরণী নির্দ্বিধায় ঘরের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে - স্বামী কলকাতার খিদিরপুরে কাজ করতে গিয়ে দ্বিতীয় সংসার পেতেছে, ঘরের খবর নেয় না, দুটো বাচ্চা আর সোমত্ত বউ রেখে বড়ো ছেলে মরে গিয়েছে, তিওরখালিতে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার, প্রায়ই এসে মায়ের কাছে থাকে, ছোটো ছেলে জোগাড়ের কাজ করে কিন্তু বাউণ্ডুলে, পুরো সংসার তাকেই সামলাতে হয়, তাই বলে কারো কাছে ফেৎরা চাইতে যায় না, কাজের বাড়ি থেকে না বলে কোনোদিন একমুঠো চাল নিয়ে গিয়েছে - পচার মাকে এই বদনাম কেউ দিতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
পচার মায়ের উচ্চকণ্ঠ পাঁচালি শুনতে শুনতে গিরিবালা দেবী কাপড় শুকানোর দড়ি টাঙানোর ব্যবস্থা, কলতলায় কয়েকটা ইঁট পেতে দেওয়া ইত্যাদি খুচরো অথচ দরকারি কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন। দোলনের কিন্তু সেসব নিয়ে তেমন ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। আলনায় জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, তক্তপোশে তোষক, চাদর টান করে ঠিকঠাক বিছানো ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত। কাল রাতে যেমন তেমন করে ঘুমিয়ে পড়েছিল, অতটা সময় পায়নি। বড় ঘরটি দোলনের বেশ পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। জামাকাপড় বিছানাপত্র তো অল্পই - তাই দিয়েই তার ঘর সাজানোর প্রচেষ্টা দেখে নজরুলের ভালো লাগল। কান্দিরপাড়ে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের ভিতরেই বড়ো হয়েছে, অভাব কাকে বলে চোখে দেখেনি। বিয়ের পর থেকে নজরুল তাকে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া তো দূরের কথা, এখনো ভালো করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটাও করে উঠতে পারেননি। তবু এতো অনটনের ভিতরেও দোলন মুখফুটে কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেনি, কষ্টের কথা বলেনি। আজ অনেকদিন পরে প্রাণপ্রিয় প্রমীলার মুখচোখে খুশির খানিক আভাস দেখে হেমন্তদার প্রতি কৃতজ্ঞতায় নজরুলের মনটা আর্দ্র হয়ে উঠল।
হেমন্তদার কথা ভাবতে না ভাবতেই বাইরে থেকে তারক দাসের গলা ভেসে এলো - "কাজিদা, ডাক্তারের চেম্বারে যেতে হবে। হেমন্তদা অপেক্ষা করছেন"!
নজরুল মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন৷ শীতের টুপিটা মাথায় দিয়ে বেরোনোর উদ্যোগ নেবার আগেই প্রমীলা দেবী সামনে এসে দাঁড়ালেন।
শালটা টেনে ঠিক করে দিতে দিতে বললেন - "ডাক্তারকে সব কথা ঠিক করে বলবে, কোনো কথা লুকাবে না। পেটে ব্যথার কথাটাও বলবে। আমি কি যাব তোমার সঙ্গে"?
নজরুল প্রমীলাকে কাছে টেনে নিলেন। একমুহূর্ত চোখে চোখ রেখে হেসে বললেন, "চিন্তা কোরো না, সব ঠিকঠাক বলব। হেমন্তদা তো সঙ্গে আছেন। তোমাকে যেতে হবে না"।
নজরুল বারান্দার দরজা খুলে পথে বেরিয়ে এলেন। তারকদাস দাঁড়িয়েই ছিলেন। দুজনে এগিয়ে গেলে প্রমীলা নিঃশব্দে দু'হাত জড়ো করে কপালে ঠেকালেন - অদৃশ্য অদৃষ্টের উদ্দেশ্যে।
(ক্রমশ)