কল্লোলিনী গঙ্গা, আমার ছোটবেলার সাথী। গঙ্গার তীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে কত গল্প। উপরে বাঁধানো চাতালে কত খেলা, বট অশ্বত্থ গাছ ঘিরে বেদী। সেখানে রবিপ্রনাম, আগমনী গান, বিজয়া সম্মীলনী কত কিছু। গঙ্গার ওপারে হাওড়া জেলা।দেখা যায় ঘর, বাড়ি, কল- কারখানা গঙ্গার তীর বরাবর।আমরা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার। আমাদের গঙ্গার তীর বরাবর বাটা কারখানা, বজবজের বিভিন্ন জুটমিল। আমার ছোটবেলার গঙ্গার তিরতির বয়ে যাওয়া জলের সঙ্গে কথা বলা, খেলা করা, চারপাশে অবর্ণনীয় সৌন্দর্য, গঙ্গার পাশে ইঁটভাটা, শ্রমিক বসতি। পাড়ার মেয়ে বৌদের পূজা পার্বণ, গঙ্গা আরতি।
ছোট ছোট নৌকা পারাপার, মাঝে মাঝে বড়ো জাহাজের আনাগোনা। নদী পাড়ে পুরানো বাড়ির ভগ্নাংশ। জোয়ারে ভেসে আসে ফুল, লতা পাতা, পোড়া চিতাকাঠ, কখনো, মানুষ বা পশুর মৃতদেহ।
আমার প্রিয় বন্ধু এখন বিপন্ন, বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রের ভুল নীতি, কর্পোরেট আগ্রাসনের ফলে দূষিত হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। বিভিন্ন কারখানার দূষিত বর্জ্য, কেমিক্যালস, মানুষের ফেলে দেওয়া অহেতুক বর্জ্য গঙ্গার জলকে অব্যবহার্য করে ফেলেছে। 'থার্ড প্ল্যানেট' পরিবেশ বাঁচাও সংস্থা আমাদের এই অঞ্চলে নদী এবং গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম মুখ। তারা গঙ্গা কে বাঁচানোর দাবিতে সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে প্রচার করে। তাদের বক্তব্য রাষ্ট্র কর্তৃক এদেশের নদীগুলোর উপরে বাঁধ নির্মাণ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করাটা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় তেহরি বাঁধ সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ।
আর এর ঠিক উল্টোদিকে এক আলোর রেখা - হরিদ্বারের মাতৃসদনের সন্ন্যাসীদের গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন। এই ধারাবাহিক আন্দোলন গত পঁচিশ বছর ধরে চলছে। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসে স্বামী গোকুলানন্দ সরস্বতী, স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী অনশন সত্যাগ্রহের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। এই আশ্রমের প্রায় সাতষট্টি জন সন্ন্যাসীর আন্দোলন সরকারকে চ্যালঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আজও সেই আন্দোলন স্বামী আত্মবোধানন্দজী চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় স্তরে সুপরিচিত নদী বিশেষজ্ঞ তাপস দাস বিভিন্ন পরিবেশ এবং নদী কর্মীদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা ও এই আন্দোলনে সামিল হয়েছি। নদী বাঁচাও, জীবন বাঁচাও আন্দোলন, জলঙ্গী নদী সমাজ, কুশকর্ণী নদী সমাজ, থার্ড প্ল্যানেট সব সংস্থাগুলো প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছে গঙ্গা বাঁচাও, নদী বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও আন্দোলন কে সফল করতে।
আমরা শহরবাসী বুঝতে চাইনা। প্রতি মুহূর্তে নদী নালা বুজিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে সুখে থাকতে চাইছে। জলই জীবন এটাতো ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসছি। কি করে ভুলে যাই আমরা। কি করে অকারণ জলখরচ জলচুরি করে নিজেদের স্বার্থ মেটাই। প্রকৃতি পরিবেশ নষ্ট করে কিভাবে বেঁচে আছি আমরা। জলস্তর নামতে নামতে আর্সেনিক বিষে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে যে মানুষ জন, একটুও কেন ভাবছি না তাদের জন্য? আমরা পড়াশোনা করে শুধু আগ্রাসী হলাম, সুখের লোভে দুঃখ ভুলে গেলাম। আমাদের জীবনকে নিজেরাই বিপজ্জনক করে তুললাম।পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া শিখলাম।
আজ এতবছর পরে গঙ্গার দিকে চোখ মেলে তাকালে কষ্ট হয়। প্লাস্টিকের প্যাকেট, কারখানার বর্জিত তেল, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সব জলে ভেসে যাচ্ছে। মাছ মরে যাচ্ছে, ব্যবহৃত জলে শরীরের ত্বকে নানা রকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
আর কতটা ক্ষতি হলে মানুষ বুঝবে,
আর কত মানুষ মরলে মানুষ ভাববে,
আর কত জীব বৈচিত্র্য হারালে মানুষ থামবে।
আমরা তো অপেক্ষায় আছি,
আমরা লড়াইয়ে আছি,
আমরা ভালোবাসায় আছি,
আমরা সকলের সাথে আছি।
একবার হাতটা বাড়াও,
পড়ে যাওয়া হাতটা একবার ধরো,
হয়তো আবার বেঁচে উঠতে পারি নতুন করে,
আবার সুখে থাকতে পারি নতুন করে।
সূত্রঃ থার্ড প্ল্যানেট