শিক্ষার সাধারণত দুটি ভূমিকা আছে, প্রথমতঃ মনুষ্যত্বের বিকাশ দ্বিতীয়তঃ সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতা। অবশ্য আর একটি বাহ্যিক দিকও আছে, সেটি হল জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্য। তবে শিক্ষার ব্যবহারিক বা বাহ্যিক লক্ষ্যকে রবীন্দ্রনাথ অবজ্ঞা করেননি, কিন্তু তিনি অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার উচ্চতর লক্ষ্যের দিকে। সমাজকে বিদ্যা শেখানোর জন্য আমাদের দেশ কোনোদিন বিদেশি রাজার আইনে ধরা দেয় নি।কারণ ভারতের নালন্দা, তক্ষশীলা, কাশী, নবদ্বীপ, মিথিলা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় ও উল্লেখযোগ্য টোলগুলি গড়ে উঠেছিল। যে দেশ স্থায়ী মঙ্গলের লক্ষ্য ও আকস্মিক উৎপাতকে নিজের সহায় করতে আশঙ্কা বোধ করে, সে দেশের উন্নতি চিরকালই ব্যাহত হয়। আজ তারা ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে বলছেন আংশিক সময়ের শিক্ষকদের পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা চাই, অথবা শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ চাই না, তারা আসলে প্রবল ক্ষমতাশালী প্রতিপক্ষের উপর রাগ ও নিজের প্রতি জেদবশত এসব কথা বলছেন। তাই ধৈর্য্য রক্ষাই হল যথার্থ প্রীতির লক্ষণ। সেইজন্যই শিশুকে মানুষ করে তুলতে পিতামাতার ধৈর্য্য থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন।
রাজনীতি আমাদের স্বার্থপূরণ করতে না পারলে, আমরা সহজেই অধৈর্য্য হয়ে পড়ি। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে। কথায় কথায় চলে আন্দোলন, ভাঙচুর, অবরোধ ও আটক প্রণালী। আজ শিক্ষার বিচার হয় অর্থের দ্বারা। ফলত আমরা ভুলে যাই, জীবনের গতির সঙ্গে মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আবিষ্ট হয়ে শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন জনসমাজে। আমাদের সমাজে শহর ও গ্রামের শ্রেণি বিভাজন থাকায় শিক্ষার ক্ষেত্রেও সেই বিভাজন ঘটে। শহরবাসীরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকে, গ্রামবাসীদের মধ্যে তার বৈষম্য দেখা যায়। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রেও তৈরি হয় বৈষম্য। আমাদের দেশের স্কুলগুলি হলো শিক্ষাদানের কল। শিক্ষক মহাশয় সেই কারাখানার একটি অংশ মাত্র। সাড়ে দশটার সময় ঘন্টা বাজিয়ে কারখানা খোলে, আর শিক্ষক মহাশয়ের মুখ ও চলতে আরম্ভ করে। আর সাড়ে চারটায় ঘন্টা বাজিয়ে আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ঘন্টা শুরু আর সমাপ্তির মাঝে সময়টুকুতে চলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ। মিড ডে মিল বিতরণ, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, ওয়েসিস, সবুজ সাথী, বস্ত্র, খাতা, বই আরো কত কি বিতরণ। কিন্তু পাখিদের শিক্ষা নিয়ে কেউ ভাবে না। সংসারে কৃত্রিম জীবন যাত্রায় হাজার রকমের অসত্য ও বিকৃতি যেখানে প্রতিমুহূর্তে রুচি নষ্ট করে দেয়, সেখানে স্কুলে সাড়ে দশটা সাড়ে চারটের মধ্যে গোটাকতক পুঁথির বচন সবকিছুকে সংশোধন করে দেবে, এমনটা ভাবা সত্যিই ভুল। আর সেই ভুলটাই এখন শিক্ষার বীজমন্ত্রে পরিণত হয়েছে।