বিবিধ

এ পৃথিবী একবার পায় তারে...



দেবাশিস সেনগুপ্ত


"কুড়ি কুড়ি বছরের পার"-এর ওডিআই বিশ্বকাপের একটি মেগা ম্যাচের এবং সেই ম্যাচের এক সুপার ব্যাটারের কথা দিয়ে গাঁথা এ লেখা। সেই ম্যাচের স্থান - সুপারস্পোর্ট পার্ক স্টেডিয়াম, সেঞ্চুরিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাল - ১ মার্চ ২০০৩ আর পাত্র - ভারত ও পাকিস্তান।

(১)

সঈদ আনোয়ারের ১০১য়ে (১২৬ বল) আর ইউনিস খানের ৩২য়ে (৩৬ বলে) ভর দিয়ে ৭/২৭৩ তুলে দিয়েছে প্রথমে ব্যাট করা পাকিস্তান।তবে ৬ রানে ইনজামাম রান আউট না হলে আর ৭ বলে ৯ রান করা আজকের বার্থডে বয় শাহিদ আফ্রিদি অনিয়মিত বোলার দীনেশ মোঙ্গিয়ার বলে ফিরে না গেলে ২৭৩ রানটা নিঃসন্দেহে চলে যেত ৩০০ রানের কাছাকাছি বা ওপারে।

একে বিশ্বকাপে ভারত-পাক ম্যাচ, তার উপর বিপক্ষে পেস বোলিংয়ের ত্রিফলা চাটনি আক্রাম-শোয়েব-ওয়াকার এবং সর্বোপরি তখনকার দিনে বেশ ভালো ৫.৪৬ গড়ের বিরুদ্ধে "জিততে হবে"র প্রাণান্তকর চাপ। এই অবস্থায় ঝড়ের বেগে শুরু করে ভারত ৫.৫ ওভারে ২/৫৩ হয়ে যায় সেহবাগ (১৪ বলে ২১) আর সৌরভকে (প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট) হারিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেহবাগের সঙ্গী ওপেনারের চাপ কাটানো ধুন্ধুমার ইনিংসের (১৩০.৬৭ গড়ে ৭৫ বলে ৯৮ রান) সৌজন্যে এসক্যালেটরে চড়ে থাকা ভারত তিনি আউট হবার সময়ে যখন ৪/১৭৭ হয়, তখন ভারতের ইনিংসের বয়স ২৭.৪ ওভার। এবং টার্গেট একদম "হাত বাড়ালেই বন্ধু"র মত কাছাকাছি এসে যাওয়া - ১৩৪ বলে ৯৭ রান। হাসতে হাসতেই এবং হাঁটি হাঁটি পা পা খেলেও সেটা ছুঁয়ে ফেলেছিলেন রাহুল-যুবরাজ জুটি।

কতটা ধুন্ধুমার ছিল সেদিন সেহবাগের সঙ্গী ওপেনারের ইনিংস? দু’টি উদাহরণই যথেষ্ট। তার ও সেহবাগের প্রথম উইকেটের জুটিতে উঠেছিল ৩৪ বলে ৫৩ রান, যার মধ্যে মারকুটে ব্যাটার বলে খ্যাত সেহবাগের রান ছিল ১৪ বলে ২১। এবং সেহবাগের সঙ্গী ওপেনার ও কাইফের তৃতীয় উইকেটের জুটিতে উঠেছিল ৯৫ বলে ১০২ রান, যার মধ্যে চনমনে ব্যাটার কাইফের রান ছিল ৬০ বলে ৩৫। সেদিন সেঞ্চুরিয়নে তার নিজের "সেঞ্চুরি অন" না করতে পারলেও দলের জয়ে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিলেন সেদিন সেহবাগের সঙ্গী ওপেনার। সেহবাগের সঙ্গী ওপেনারের এই ইনিংসটার পশ্চাৎপট লিখে রাখতে পারে না কোন স্কোরবোর্ড, ধরে রাখতে পারে না কোন গ্রাফ বা ডাটা। কারণ সম্ভব না সেটা। সেই ইনিংসটা তৈরী হওয়ার টুকরো টাকরা অনুষঙ্গও লিখে রাখতে পারে না কোন স্কোরার, ধরে রাখতে পারেন না কোন ডাটা বা গ্রাফবিশেষজ্ঞ। কারণ সেটা হতেই পারেনা।

(২)

৩১ থেকে ৫৫ - আমার মত অনেকেরই জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমী রোদঝরা দুপুরের সময়টা যে তার ব্যাটের ঠান্ডা ছায়াতে ঢাকা আছে, তার অনেক সাক্ষীদের মধ্যে থেকে গেছেন ওয়াসিম আক্রম থেকে ওয়াকার ইউনুস হয়ে স্টিভ ওয়াগ, শেন ওয়ার্ন থেকে শোয়েব আখতার হয়ে শন পোলক, কোর্টনি ওয়ালশ থেকে কার্টলে অ্যামব্রোস হয়ে ক্রিস কেয়ার্নস, সনথ জয়সূর্য থেকে সাকলিন মুস্তাক হয়ে শেন বন্ড, মুথাইয়া মুরলীধরণ থেকে মাখায়া এনটিনি হয়ে মার্কোস ট্রেসকোথিক, হেনরি ওলোঙ্গা থেকে হিথ স্ট্রিক হয়ে হ্যানসি ক্রোনিয়ে, গ্রাহাম থর্প থেকে গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার হয়ে গ্লেন ম্যাকগ্রাথ, আকিব জাভেদ থেকে অ্যালান ডোনাল্ড হয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ এবং আরো কতজন যে! আমাদের বাঁচা সার্থক যে আমাদের সময়ে তিনি ব্যাট হাতে ভারতের ক্রিকেটকে আগলেছিলেন এবং আমাদের চোখ সেটা দেখার জন্য খোলা ছিল।

পাক্কা ২৪ বছর শুধু হেলমেটেই নয়, তার ব্যাটেও জড়ানো থাকত অদৃশ্য কিন্তু অনুভব করতে পারা ভারতের জাতীয় পতাকা আর দেশের হয়ে করা তার প্রতিটি অর্জন শোনাত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। সেই ২৪ বছর প্রতিটি ভারতবাসী তার দিকে ধেয়ে আসা প্রতিটি ডেলিভারি খেলেছে, শতরান থেকে শূন্যরান করেছে, সাফল্যে হেসেছে, ব্যর্থতায় ভেঙ্গেছে, তারই সঙ্গে সঙ্গে।

(৩)

ক্রিকেট ছাড়ার পর প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত। এখনো তার ফেলে আসা স্ট্রেট ড্রাইভগুলি সোজা রাখে ভারতবাসীকে। এখনো তার ফেলে আসা হুকগুলি মনে রেখে জীবনের বাউন্সার সামলায় ভারতীয় জনতা। তার ফেলে আসা ফ্লিকগুলি সম্বল করে দুঃখকষ্টকে বাউন্ডারীতে পাঠায় ভারতীয় আমজনতা, এখনো। ভারতকে এখনো একাত্ম রাখেন তিনি। তার ক্যারিশমায়।

এগুলো ধরতে, বুঝতে আলাদা অনুভূতি লাগে। যা কোন গ্রাফ আর ডাটার থাকেনা। তাই গ্রাফ আর ডাটা এক্ষেত্রে তার কাজ ঠিকঠাক করতে ব্যর্থ হয়ে নটআউট থেকে যায় দিনের শেষে। পরের দিন আবার নিষ্ফলা ব্যাট করতে নামবার জন্য। আর শচীন তেন্ডুলকার থেকে যান শচীন তেন্ডুলকার হয়েই।

"এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।"