।। ১ ।।
নবদ্বীপ শ্মশানে মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে যখন বাড়ি ফিরছি তখন সবেমাত্র পুবের আকাশ রক্তিম হয়ে উঠছে। হাতে গোনা কয়েকজন শ্মশানযাত্রী মায়ের শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়েছিলেন। ফেরার পথে ওঁরা আবদার করলো কিছু খাওয়া দাওয়া করবে। এ ব্যাপারে আমার মন কখনও সায় দেয় না। তবুও না করতে পারলাম না। ওদের পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে টেবিলের একপাশে বসে ভাবতে লাগলাম মায়ের জীবনের নানান ওঠাপড়ার কাহিনি। জীবনের শেষ পনেরো যোলোটা বছর আমার কাছে কাটিয়ে গেলেন। এ যে তাঁর থাকা নয়, কিছুটা নিরুপায় হয়ে অবসর যাসন। চোখের জলে, অন্তরের তীব্র যন্ত্রণায়, দুঃখের গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে বাস করা। তিনি মুথে কিছু না বললেও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারতাম তার অন্তরের তীব্র যন্ত্রণা তাঁকে কীভাবে জীবনের অপর পারে নিয়ে যাচ্ছে। আজ বড্ড মনে পড়ছে তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর করুণ ও বেদনায় ভারাক্রান্ত অভিব্যক্তির ছবিগুলো -
বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। ন্যুব্জ শরীরটাকে আশ্রয় করে কোনোভাবে তাঁর বেঁচে থাকা। অনেকগুলো সন্তান-সন্তভিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে আজ নিজেই আছেন অন্ধকারে। এখনো জেগে আছে তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রূপকথা। আমি পাশে আছি বটে, কিন্তু এটা তাঁর কাছে থাকা নয়। যাদেরকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল গগনচুম্বী তারা প্রায় কেউই তাঁর খবর রাখে না। হয়তো তারা মনে করে আসলে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া মানুষটি আজ তাদের কাছে একটা বোঝা ব্যতীত আর কিছুই নয়। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সদস্যরা তাই প্রহর গোনে কবে শেষ খবর পাবো, কেবল এইজন্যই তারা বছরের পর বছর জমিয়ে রেখেছে তাদের চোখের জল। যথন শেষ খবর ওদের কাছে পৌঁছাবে তখন চোখের জলটা কাজে আসবে। প্রতিদিন প্রতিরাতে এই মানুষটির দুঃস্বপ্নের জীবন কাটে, বারবার নিজেকে প্রশ্ন করে আজ এখানে যে আদর যত্নে লালিত হচ্ছি সেটা আমৃত্যু থাকবে তো? তাঁর একমাত্র কন্যা, যার কাছে কিছু সময়ের জন্য সান্ত্বনা পান, তিনি অথর্ব হলে কী তারা আর তাঁর দায়িত্ব নেবে?
আমার বাবা চলে গেছেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। তাঁর চলে যাবার পর মায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁর দেখভাল করতেন। কিন্তু কোনো এক অশুভ মুহূর্তে সহায়সম্বলহীন এই মানুষটিকে মিথ্যা চোর অপবাদ দিয়ে আমাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে তাঁকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলেন। তখন আমার মায়ের শরীর শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা প্রায় লুপ্ত, সারা শরীর খরখর করে কাঁদে। এমতাবস্থায় তাঁকে আশ্রয় দিতে কার মনই বা সাড়া দেয়? তবুও সান্ত্বনা দিদি ছিলেন। আমি তখন সবেমাত্র নতুন বাড়ি করে তাকে বসবাসের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করছি।
সত্যি বলতে কী বাবা চলে যাবার পর মায়ের খেয়াল রাখার মতো কেউ ছিলো না। আমার বয়স তখন সাত-আট বছর, বাবার মৃত্যুর খবর যখন আমার কাছে পৌঁছায় তখন আমি বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে। তাই তাঁকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি। আমি দেখতেও চাইনি, আমি চেয়েছিলাম বাবা আমার মনের মধ্যে চিরকাল জীবিত হয়েই থাকুন। তাঁর মৃত মুখটা আমাকে বড্ড পীড়া দেবে। কিন্তু তাঁর জীবন্ত রূপটা আমার মনে চিরস্থায়ী আসন করে নেবে। বড়দা চিরকালই একটু অলস প্রকৃতির, সংসারের দায় দায়িত্ব যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। যতদিন বাবা ছিলেন সংসার চালানোর সিংহভাগ দায়িত্ব ভিনিই পালন করে গেছেন। সাত সাতটি সন্তানকে যতটা সম্ভব শিক্ষার আলো দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। আমার পিতামহ অর্থাৎ ঠাকুরদা তেমন একটা সম্পত্তি রেখে যাননি যা থেকে সংসারের কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয়। তবু আমার পিতৃদেব কোনোদিন সে ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেন নি। বরং হাসিমুখে সবটাই মেনে নিয়েছেন। পিতৃদেবের মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি চলে আমি শহরে, আমার অগ্রজদের অনুরোধের ওপর ভরসা করে। এখানে এসে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে সবার সাথে সহজেই মিশে গেলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন সংগ্রাম। দাদা হাতে ধরে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জগন্নাথ বাবু খুব ভালো মানুষ ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর সাখে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠলো। মাঝে মধ্যে ওনার বাড়ি নিয়ে যেতেন। কাকিমার সাথে গড়ে উঠলো এক অদৃশ্য মাতৃত্বের সম্পর্ক। শৈশবে পিতা-মাতার সাহচর্য থেকে বঞ্চিত এক শিশু অযাচিতভাবে পেয়ে গেল স্নেহময় একজন শিক্ষক এবং স্নেহময়ী এক জননীকে।
গ্রামের বাড়ি থেকে খবর পেলাম হঠাৎ বাবার হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই চলে গেছেন এ পৃখিবীর মায়া ত্যাগ করে। সময় পেলেও বাবাকে বাঁচানো কঠিনই ছিলো। কেননা আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে চিকিৎসা কেন্দ্র। কর্দমাক্ত ও ধূলিধূসরিত পথে ছিলো না তেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা, কষ্টেসৃষ্টে চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছালেও সেখানে ছিলো না কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ছিলো না কোনো জীবনদায়ী ওষুধ ও অত্যাধুনিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি। ফলে একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হলো আমার পরম প্রিয় পিতৃদেবকে। জীবনে নেমে এলো এক গভীর অন্ধকার। এদিকে আমার আশ্রয়দাতা অগ্রজের দৈনিক উপার্জন অতি সামান্য। ইতিপূর্বে তাঁর প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার প্রাক্কালে বৌদি ভীষনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসক জানান যে গর্ভস্থ শিশুর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে দুজনেরই বেঁচে থাকা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যে কোনো একজন কে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। দাদার সঞ্চিত সমস্ত অর্থ, এমনকি তাঁর স্বোপার্জিত অর্থে কিনে রাখা জমিটুকুও চলে যায় ওদের চিকিৎসার জন্য। প্রায় ছ-সাত মাস একটানা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নবজাতক পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ সুখলাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে অকালে ঝরে পড়ে। অভ্যন্ত দুর্বল ও শীর্ণকায় শরীরে বাড়ি ফেরেন বৌদি। চতুর্দিকে ধারদেনায় নিমজ্জিত হয়ে দাদা বড্ড অসহায় বোধ করতেন। খুবই সামান্য পারিশ্রমিকে এক কারখানায় কাজ পান তিনি। ফলে নিভান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে হয়।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীর্ণ পরিবারটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে তখন কোনো শুভানুধ্যায়ী এগিয়ে আসেননি। একক প্রচেষ্টায় তিনি ধীরে ধীরে সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে কাটিয়ে ওঠেন তাঁর দুঃস্বপ্নের দিনগুলিকে। আমি তখন দুটো একটা টিউশনি করে যতটা সম্ভব দাদাকে সাহায্য করে গিয়েছি। আমার অপর এক অগ্রজ স্কুল হোস্টেল থেকে তার খাবার পেত। এছাড়াও নিজের টিউশনির টাকা থেকে দাদার হাতে কিছু টাকা ভুলে দিত। সেটা যৎসামান্য, ভাতে আমাদের ক্ষুৎপিপাসা মেটানো সম্ভব হতো না। সেই সময় আমাদের পাড়ার অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে সংসারের আর্থিক সমস্যা মেটাতে দিল্লি অথবা আরব দেশগুলোর বিভিন্ন বাড়িতে বা দোকানে কাজ করতে চলে যেত, তারা অনেকেই কাঁচা পয়সা উপার্জন করে বাড়িতে টাকা পাঠাতো। আমার অগ্রজ একদিন আমাকে বললেন -- "তুই দিল্লী চলে যা, ওখানে গেলে অন্তত পেটভরে দুটো খেতে পাবি, তাছাড়া মাসে মাসে কিছু টাকাও পাবি, দাদাকে সাহায্যও করতে পারবি।" কথাটা আমাকে বড্ড পীড়া দেয়। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। যত কষ্টই হোক আমাকে লেখাপড়া শিখে অনেক বড়ো হতে হবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইলাম একটা সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়। এভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েকটি বছর। এর মধ্যে আমার একমাত্র দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। তারও যমজ দুটি পুত্রসন্তান। আর্থিকভাবে তারাও যে খুব স্বচ্ছল তা বলা যাবে না। তাদেরও বেশ অভাবের মধ্যে দিন কাটে। ইতিমধ্যে কোনো এক সবজান্তা পড়োশিনীর কূট চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে আমার সাখে বৌদি খুব খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেন। আমি যতই বোঝাতে চেষ্টা করি না কেন তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করেন না। আমার ওপর চালান মানসিক নির্যাতন - ঠিক সময়ে খাবার না দেওয়া, দিলেও খালাটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া, আমার এঁটো খালাবাসন না ধুয়ে ফেলে রাখা, স্কুল ইউনিফর্ম ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে ফেলে রাখা, বই-খাতা এলোমেলো করে ফেলে রাখা, আমার সঙ্গে কথা না বলা, খাবার এবং আশ্রয় দিয়েছেন বলে প্রতি মুহূর্তে খোটা দেওয়া এরকম আরও অনেক কিছু। প্রসঙ্গত জানাই আমি চিরকালই একটু স্বাধীনচেতা এবং অসম্ভব জেদি প্রকৃতির। কোনো অন্যায় না করে মিথ্যা দোষারোপ সহ্য করে, সন্দেহ, সংশয়ের মধ্যে থাকার চেয়ে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে বাঁচাটাকে বেছে নেওয়া শ্রেয় বলে মনে করলাম। ফলে যা ঘটবার তাই ঘটলো। বিনা অপরাধে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হলো।
(ক্রমশ)