মা পাখিটা তখনও চিৎকার করছে একনাগাড়ে। অঃ ঈশানকোণে মেঘের দল। ঝড়ো বাতাসে ভেঙ্গে পড়ছে শিরিষ গাছের বৃদ্ধ ডাল। পাক খেয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে পলিথিনের প্যাকেট। রাস্তার ধূলো গুলো উড়ে আসছে জানালায়। পাশের বাসার বউটা তড়িঘড়ি করে লাগাচ্ছে খিড়কি। একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। তাই হয়তো মা শালিক পাখিটার এতো তাড়াহুড়ো। ছানাটা ভয়ার্থ দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। ওর গায়ে ছোট ছোট লোম। ওড়ার মতো উপযোগী হয়নি এখন অব্দি। তারপরেও হয়তো উড়তে চেয়েছিল। বাতাসই বোধহয় ভারসাম্য রাখতে দেয়নি তাই আর উড়তে পারেনি। যে বাতাস ভারসাম্য রক্ষা করে সেই বাতাসই আবার বিঘ্ন ঘটায়।
মরা লাউ গাছের মাচার উপর থেকে ওড়ার চেষ্টা করছে ছানাটি। আর মা শালিকটা কামরাঙ্গা গাছের ডালে বসে করুণ ভাবে ডেকে চলেছে।
বাইরে এখন ঝুম বৃষ্টি। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি। বিকট শব্দে যখন বজ্রপাত হলো পুলক তখন ছাদে। ছাদের সাথে লাগোয়া খেজুর গাছ। সেই গাছে খেজুর পেকেছে। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে খেজুর পেড়ে চলেছে। বজ্রপাতের শব্দশুনে ঘর থেকে চিলেকোঠায় দৌড়ে এসেছে ওর তিন মাসের পোয়াতি বউ।
একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বললো - আর লাগবেনা। এবার চলে আসো জলদি।
বউ এর ডাক শুনে চলে আসে পুলক। কাক ভিজা ভিজেছে একদম। হাতে পাকা খেজুর। শালিক ছানা পাকা খেজুর খায়। ছোটবেলায় পুলক একটি শালিক পুষেছিল। তখন থেকে জানা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বউটা কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল। হয়তো পুলকের হাত। পুলক ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে এসেছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি তলে চাপা পড়ে গেল পোয়াতির ভারি নিঃশ্বাস।
পায়ের তলায় কোনো প্রাণী চাপা পড়ে যায়, সেই ভয়ে বা ভালোবাসায় পা সরায়ে নেয় মানুষ। সেই মানুষই আবার ছুরি চালায়। আজব মনের কিনারা কোথায় জানেনা কেউ।
বাইরে তখনও বৃষ্টি। পিপাসায় কাতর বউটা শূন্য কলসির দিকে তাকিয়ে বললো, কলসিতে পানি নেই গো। যদি কলপাড়ে যেতে। মাথাটা ধরেছে কেমন জানি।
পুলক তখন পাকা খেজুরের আঁশ খুলে শালিক ছানাকে খাওয়াতে ব্যস্ত।
চেঁচিয়ে বউকে বললো - এখন পারছিনে। দেখছিস তো কেমন খিদেয় কাতরাচ্ছে ছানাটা।
একটু পরেই কলপাড় থেকে ভেসে আসে কল চাপার ক্যাঁচ- ক্যাঁচ শব্দ। বউ পানি নিয়ে আসে। হাঁ করা শালিক ছানার গালে পানি দেয় পুলক।
বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে থাই গ্লাসে। দূরে দৃষ্টি দিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে বউটা। হঠাৎ কীসের যেন একটা স্পন্দনে হাতটা তার পেটের কাছে চলে যায়। "মা" শব্দটা বলতে যতটুকু সময় লাগে- ততোটুক সময় নিয়ে কেউ নড়ে ওঠে ভেতরে। ভেতরের এই হালকা নরম অনুভূতি প্রতিটি নারীকে ঐশ্বর্য দেয়। মনের সমস্ত মলিণতা সরে যায় সবিতার। ভোরের নরম আলোর মতো উজ্জ্বল আলোয় ভরে ওঠে মুখ। আজ রবিবার। এই দিনেই তো মহাবীর হারকিউলিস জন্মেছিল। গর্ব আর দীপ্তি নিয়ে ছুটে যায় ব্যালকনিতে। এই দ্যাখো আমার অস্তিত্ব। হাত দেও। এইখানে ঠিক নাভির উপরে নড়ে উঠেছিল। তুমি নাভির উপরে হাত দেও। বলতে বলতে কেঁদে ফ্যালে সবিতা। পাশে শূন্য ব্যালকনিতে শালিক ছানাটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কী যেন দ্যাখে।
বৃষ্টির ভেতরেই বেরিয়ে পড়েছিল পুলক। একটা শক্ত লোহার তৈরি খাঁচা নিয়ে ঘরে যতক্ষণে ঘরে ফিরেছে ততক্ষণে বৃষ্টি কমেছে। ঘরে ঢুকেই সবিতাকে বলে। এই দ্যাখো কতসুন্দর খাঁচা। শালিক ছানাটাকে বড় করব। কথা বলতে শিখলে তোমার নাম ধরে ডাকবে। সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে। তুমি ওর একটা নাম দিয়ে দিও। সবিতা ঘাড় নাড়ে। চাপা একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে কেবল। পূর্বের মতো ঘনকালো মেঘে ঢাকা পড়ে যায় ওর সমস্ত অনুভূতি।
বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ। মেঘলা দিনের পরে চাঁদ যেন তার ঐশ্বর্য ঢেলে দিচ্ছে নারকেল পাতায়। পাতায় যে বৃষ্টি পড়েছিল এখনো হারায় নি সেটা। বিন্দু- বিন্দু জল দেখে মনে হচ্ছে মায়ের নোলক। পুলকের ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে সবিতার গলায়। ওর ভরাট গলায় যে ভাঁজ ছিল সেটা খুঁজে চলেছে। পোয়াতি চাঁদের উপর দিয়ে চলে যাওয়া একফালি শুভ্র মেঘের দিকে অপলক চেয়ে আছে সবিতা। গলায় মুখ ঘষতে ঘষতে পুলক বললো - তোমার গলার সেই ভাজটা এখন আর নেই কেন? সবিতা অন্য দিকে ফিরে বললো - বন্যা এসে ধুয়ে নিয়ে গেছে বোধহয়। পুলক রেগে মুখটা সরিয়ে নিয়ে বললো- বুঝলাম না। কী সব ফালতু বলো। তুমি আগের মতো নেই।মেঘে ঢাকা পড়ে গেল চাঁদ। আষাঢ়ের মেঘ এমনই খামখেয়ালি। কখন মেঘ আবার কখনো মেঘমুক্ত আকাশ।
শালিক ছানাটা বড় হয়েছে। কান ফুটেছে। কান ফোটার সময় শালিক ছানা নাকি মরে যায়। যেটা বেঁচে থাকে সেটা পোষ মানে। গায়ে সাদা-কালো পশমে ছেয়ে গেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন আসে। শালিক ছানার খোঁজ নেয় - ওর মা-বোন-ভাই সকলে জানতে চায় শালিক ছানাটা কত বড় হয়েছে। রোগাটে আছে নাকি স্বাস্থ্য হয়েছে। গলায় হিরের মুক্তোর মতো হার হয়েছে কীনা সেটাও জিজ্ঞেসা করে। এইতো ভোরেই ভাবি ফোন করেছিল। তিনি নাকি শালিক ছানার জন্য একটা নাম রেখেছে। নামটা সুন্দর।
হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের নামে নাম। 'নি' উপন্যাস থেকে নেয়া নামটা বেশ পছন্দের। গলা উঁচু করে পুলক বললো - একটা নামতো দিতে পারলে না আজ অব্দি। দ্যাখো কতো সুন্দর নাম দিয়েছে বড় ভাবি। সবিতা শুয়ে ছিল। শরীররটা ফ্যাকাসে হলুদ বর্ণ। শুষ্ক ঠোঁট। পেটের আকারের সাথে শরীরে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান। কিছুটা শুটকো লাউয়ের মতো দেখাচ্ছে...