গল্প ও অণুগল্প

কপাল



মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি


সাইমার কপালটাই মন্দ। নইলে কুড়িটা বসন্ত স্বামীর সাথে কাটিয়ে এসেও সেই স্বামীর আনা ডিভোর্স পেপারে সই করতে হবে কেন? অবশ্য সাইমা ঝামেলা একটা পাকাতে চাইলে পাকাতেই পারত। কিন্তু সেই ঝামেলার পথে গেল না সে। গেলেও খুব যে একটা লাভ হত তাও না। সবচেয়ে বড়ো কথা স্বামীর মন তো আর সে পেত না। আর মন যেখানে নেই সেখানে ভালোবাসা তো থাকতেই পারে না। সাইমার নিজের দোষই আছে বলতে হবে। কেন সে স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারেনি? কেন সে থাকতে তার স্বামী অন্য মেয়েমানুষে আসক্ত হল? সাইমা তার নিজের কপালকেই দোষ দেয়।

সাইমার স্বামী গিয়াসুদ্দিন একজন গরুব্যাপারি। গরু কেনা-বেচা করেই তার দিন চলে। এ গাঁ, সে গাঁ ঘুরে ঘুরে গরু কিনে আনে আর হাটের দিন হাটে গিয়ে তা বেচে আসে। শুধু যে হাটে গিয়েই বেচে তা না। এক গাঁ থেকে গরু কিনে এনে অন্য গাঁয়ে গিয়েও বেচে। এতে করে রোজগারপাতি তার ভালোই হয়। গরু কেনা-বেচা করেই সে চার-পাঁচ বিঘার মতো জমি করেছে, তিন কামরার একটা পাকা বাড়িও বানিয়েছে। যখন তার বয়স কুড়ি বছর পাশের গ্রামের মেয়ে সাইমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। একটা সন্তানও রয়েছে তাদের। স্বামী-সন্তান নিয়ে সাইমার দিনগুলো বেশ সুখেই কাটছিল। কিন্তু সে সুখ আর বেশিদিন কপালে তার সইল না।

স্বামী গিয়াসুদ্দিন প্রায় দিনই গরু যেমন কিনতে যায় তেমনই গরু কিনতে বের হয়েছিল। সেদিন তার গ্রাম থেকে সাইকেলে করে অনেক একটা দূরের গ্রামে চলে গিয়েছিল। জঙ্গলের ধারে একটা গ্রাম। নাম মোহনপুর। গ্রাম তো নয়, যেন পটে আঁকা একখানা মুক্তোর ছবি। গ্রামের শেষপ্রান্তে হপন মুর্মুর বাড়ি। হপন খুব সহজ, সরল, সাদাসিধে মানুষ। মনের মধ্যে সামান্যতমও মারপ্যাচ নেই। বছর দুই হল বিয়ে করেছে। বাসন্তী তার স্ত্রী। বাসন্তী দেখতে-শুনতে অপূর্ব। আদিবাসী সমাজে যা হয়-হপন জঙ্গলে চলে যায় কাঠ-কুটো আনতে। কখনো বা মাটি কাটতে চলে যায় দূর গাঁয়ে। সেরকমই একদিন কাজের সন্ধানে চলে গেছে বাইরে। গিয়াসুদ্দিন এল তাদের ঘরে। হপনের স্ত্রী বাসন্তী সেইসময় একটা গাইগরুকে জাব খাওয়াচ্ছিল। বেশ হৃষ্ট-পুস্ট গাইগরু। তার চেহারাই বলে দিচ্ছিল গরুটাকে খুব যত্ন-আত্তি করা হয়। গাইগরুটা ছাড়াও পাশে একটা বাছুর বাঁধা আছে। অদূরেই দু’টো জমকালো চেহারার বলদ গরু। গিয়াসুদ্দিনের চোখ চলে গেল সে দুটোর দিকে। সাইকেল থেকে নেমেই সে হাঁক পাড়ল - ‘গরু বিক্রি আছে, গরু।’

কথাটা বাসন্তীর কানে যেতেই সচকিত হল সে। বাসন্তী ও তার স্বামী হপনের মধ্যে ক’দিন আগে কথাবার্তা হচ্ছিল সেরকম পাইকার পেলে বলদদু’টোকে বিক্রি করে দেবে। তাদের তো আর চাষবাস নেই-যে বলদ রাখার প্রয়োজন আছে। এই সময়ে বিক্রি করে দিলে একটা মোটা টাকা আসবে ঘরে। সেই টাকা দিয়ে বাড়ির চারপাশটায় একটা বেড়া দিয়ে দেবে। জঙ্গলের একেবারে কাছে বাড়ি। যখন-তখন এখানে হাতি চলে আসে। তাই নিরাপত্তার খাতিরেই একটা বেড়ার প্রয়োজন আছে। স্বামীর কথাটা মনে হতেই সে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘোমটাটা টেনে নিয়ে বলল - ‘তুমি কি গরু-কেনাবেচা করো?’

গিয়াসুদ্দিন সাইকেল থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল - ‘হ্যাঁগো, গরু কেনা-বেচা করি। তোমরা কি গরু বিক্রি করবে?’

- ‘আমার স্বামী সেদিন বলছিল আমাকে বলদদু’টো বিক্রি করে দেবে। কিন্তু ও তো এখন বাড়িতে নেই।’

- ‘কোথায় গেছে?’

-‘ওই কাজে বেরিয়েছে। গরিব মানুষ, বুঝতেই তো পারছো।’

গিয়াসুদ্দিন ততক্ষণে একেবারে গরুগুলোর কাছে চলে এসেছে। এসেই বলদদুটোকে বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষন করল। তাদের লেজ ধরে কয়েকটা চাপড় দিল। গরু পাইকাররা যেমন করে আর কি। গরু দেখা হয়ে গেলে গিয়াসুদ্দিন সামনেই একটা খড়ের ছোট গাদা ছিল সেটার উপরে বসে পকেট থেকে দেশলাই আর একটা বিড়ি বের করে ধরাল। একটা টান দিয়ে বলল - ‘তোমার স্বামী কখন ফিরবে?’

- ‘সে ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি বরং কাল বিকেলে এসো।’

বিড়িতে আর একটা টান দিয়ে বলল - ‘ঠিক আছে কালই আসব, তোমার স্বামীকে কিন্তু আমার কথাটা বলে রেখো।’

- ‘অবশ্যই বলবো।’ বাসন্তী ঘাড় নাড়ল।

গিয়াসুদ্দিন একবার গরুগুলোর দিকে তাকিয়ে আর একবার বাসন্তীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল।

পরের দিন বিকালবেলা গিয়াসুদ্দিন যথারীতি বাসন্তীদের বাড়ি এল। বাসন্তী বাড়িতেই ছিল। গিয়াসুদ্দিনকে আসতে দেখেই বলল - ‘তুমি চলে এসেছো? কিন্তু আমার স্বামী তো বাড়ি নেই। ওই বাজারের দিকে চলে গেছে।’

- ‘সে কি গো? তুমি তোমার স্বামীকে গরু বিক্রির কথাটা বলোনি?’ গিয়াসুদ্দিন জিজ্ঞেস করে।

বাসন্তী বলল - ‘বলেছিলাম গো। কিন্তু জরুরি একটা কাজ পড়ায় বাজারে চলে গেছে। তবে তাড়াতাড়িই ফিরবে বলে গেছে। তুমি একটুখানি বোস-’ বলে বাসন্তী দাওয়ায় একটা মাদুর পেতে দিল।

গিয়াসুদ্দিন বসল তাতে। অল্পক্ষণ পরেই বলল - ‘এক গ্লাস জল দাও দিখিনি, খাই।’

বাসন্তী গ্লাসে করে জল এনে দিল। গিয়াসুদ্দিন পান করল তা ঢক ঢক করে। বাসন্তী হঠাত্‍ কী মনে করে জিজ্ঞেস করে ফেলল - ‘হ্যাঁগো, তোমার নাম কী?’

গিয়াসুদ্দিন বলল - ‘গিয়াসুদ্দিন।’

বাসন্তী অবাক হয়ে বলল - ‘গিয়াসুদ্দিন! তার মানে তুমি মুসলমান?’

গিয়াসুদ্দিন জবাব দিল - ‘হ্যাঁ, মুসলমানই তো। কিন্তু তুমি আমার নাম শুনে চমকে উঠলে যে বড়ো? তুমি তো হিন্দু। ভাবছ, আমাকে জল খাওয়ালে বলে তোমার জাত গেল!’

বাসন্তী বলল - ‘না-না, একদমই তা নয়। ঠিক আছে বোস। আমি তোমার জন্যে এক কাপ চা করে আনি। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। চা খেতে খেতে না হয় সে সব কথা হবে।’ বাসন্তী চা করতে রান্নাঘরে চলে গেল।

গিয়াসুদ্দিন বসে রইল। বাসন্তীর আচরণ তাকে বেশ অবাক করেছে। সে একজন গরু পাইকারি। অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তার মেলামেশা। এই বাসন্তী নামের মাঝ বয়সী যুবতী আদিবাসী মহিলা তাকে কি বলতে চায় তা শোনার আগ্রহ নিয়ে বসে রইল। বাসন্তীকে দেখার পর থেকেই তার মনের মধ্যেও একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে।

অল্পক্ষণ পরেই বাসন্তী চা করে নিয়ে এসে গিয়াসুদ্দিনকে দিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গিয়াসুদ্দিন জিজ্ঞেস করল - ‘তুমি কি যেন একটা কথা বলবে বলেছিলে আমাকে?’

তালপাতার তৈরি একটা চাটাই টেনে নিয়ে তাতে বসে বাসন্তী বলল - ‘জানো, আমিও না একদিন তোমার মতো মুসলমান ছিলাম। আজ ভাগ্যদোষে হিন্দুর বউ হয়ে ঘরকন্না করছি।’

কথাটা শুনে গিয়াসুদ্দিন নড়েচড়ে বসল। বেশ মুখরোচক একটা ঘটনা। বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল - ‘তুমি মুসলমান ঘরের মেয়ে?’

বাসন্তী বলল - ‘তবে আর বলছি কি। আগে আমার নাম ছিল জাহানারা। এখন আমি বাসন্তী।’

- ‘এটা কি করে হল?’ গিয়াসুদ্দিন জানতে চাইল।

বাসন্তী বলল - ‘জঙ্গলের ধারে আমাদেরও বাড়ি ছিল। গরু চরাতে যেতাম। যেতাম বনে পাতা কুড়োতে। পরিচয় হল হপনের সঙ্গে। তারপরে ভাব-ভালোবাসা। একদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে হপনের সঙ্গে চলে এলাম। বিয়ে করলাম। জাহানারা নাম পাল্টে হলাম বাসন্তী।’

-‘বলো কী?’

-‘দেখো না। এখন আমাকে স্বামীর নির্দেশে শাঁখা-পলা পরতে হচ্ছে। সিঁথিতে সিঁদুর দিতে হচ্ছে। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধে দিতে হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করো এসব আমার করতে একদম ভালো লাগে না। এখন কেন জানি না শুধু মনে হচ্ছে আমি একটা বড়ো ভুল করে ফেলেছি।’ নিজের জাতির লোককে কাছে পেয়ে মনের দু:খের কথা জানায় বাসন্তী।

উত্তরে কিছু একটা বলতে যাবে গিয়াসুদ্দিন তা আর হয়ে উঠে না। হপন বাজার থেকে বাড়ি ফিরেছে। বাসন্তী তাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠে। বলে - ‘এই তো আমার স্বামী চলে এসেছে। গরু কেনার কথা বলো’

বাসন্তীর দু:খের কথা শোনার পর গরু কেনাবেচার কথা মাথা থেকে সরে গেছে গিয়াসুদ্দিনের। তাই কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে-‘আজ তো আর মোটেই বেলা নেই। সন্ধে নেমে এসেছে। আমাকেও অনেকখানি যেতে হবে। অন্য একদিন এসে না হয় গরু কেনার কথা বলা যাবে।’

হপন বলে - ‘হ্যাঁ, সেই ভালো। কাল এসো বরং। বেলা থাকতে থাকতে। গরু বিক্রি করব বলেছি যখন বিক্রি করবোই।’

গিয়াসুদ্দিন আর কোনও কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ে। রাস্তায় আসতে আসতে গিয়াসুদ্দিনের মাথার মধ্যে বাসন্তী ওরফে জাহানারার কথাটাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কেমন যেন একটা টান অনুভব করে। তার মনে হতে থাকে মেয়েটা বুঝি সত্যিই বড়ো দু:খে আছে। রাতের বেলা স্ত্রী সাইমাকে জাহানারার কথা বলে। তার হাতে চা খেয়ে এসেছে এ কথাও গোপন রাখে না। গিয়াসুদ্দিনের ঠিকমতো ঘুম আসে না। সাইমার ফর্সা, রাঙাটুকটুক মুখটার ছবি বারবার তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে।

পরদিন সামান্য বেলা হতেই গিয়াসুদ্দিন হপনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গরু কেনার প্রতি যতটা না টান তার থেকে অনেক বেশি টানে টানছে বাসন্তী অর্থাত্‍ জাহানারা। হপনের বাড়ি পৌঁছে দেখে হপন বাড়িতে নেই। হপনের বাড়ি না থাকাটা তাকে আরো বেশি খুশি করে। এদিকে গিয়াসুদ্দিনকে দেখে বড়ো খুশি বাসন্তীও। গিয়াসুদ্দিনকে আজও চা করে খাওয়ায়। কাছে বসে গল্প করে।

এই ভাবে নানা অছিলায় গিয়াসুদ্দিন যখন তখন হপনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সেই সময়টা বেছে নেয় গিয়াসুদ্দিন যে সময়ে হপন বাড়িতে থাকে না। তার মধ্যে হপনের সঙ্গে একদিন দেখা করে বলদদুটো কিনেও নেয়। যা দাম তার থেকেও বেশি দাম দিয়ে সে কিনে নেয়। একটাই উদ্দেশ্য জাহানারাকে খুশি করা। দিনের পর দিন যাতায়াতের ফলে জাহানারার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় গিয়াসুদ্দিনের। যে সম্পর্ক ভালোবাসার, যে সম্পর্ক মন দেওয়া-নেওয়ার। একদিন জাহানারা একান্তে কাছে পেয়ে চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে গিয়াসুদ্দিনকে বলে - ‘তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে চল। আমার আর এখানে মন টিকছে না। আমি তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চাই।’

- ‘কিন্তু তোমার স্বামী হপন -’

জাহানারা বলে - ‘ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না। ওই তো ওরকম হাবা-গোবা, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো মানুষ একটা। আমি চলে গেলেও কিছু ভাববে না ও। পরে অন্য কোনো মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করে ফেলবে। আমাকে তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো এখান থেকে নিয়ে চলো, এখানে থেকে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।’

গিয়াসুদ্দিন বুঝতে পারছে কাজটা খারাপ হচ্ছে। এক পরের বৌকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা যেমন একটা অপরাধ, অন্যদিকে স্ত্রী সাইমা আছে তাকেও ঠকানো হচ্ছে। কিন্তু জাহানারাকেও সে ভুলতে পারছে না। তারও মনে হচ্ছে জাহানারাকে ছাড়া সেও বুঝি পাগল হয়ে যাবে। লজ্জার মাথা খেয়ে গিয়াসুদ্দিন সেদিন রাতেই স্ত্রী সাইমাকে বলে - ‘সাইমা, আমি মনস্থির করেছি জাহানারাকে আমি বিয়ে করবো। সতীন নিয়ে ঘর করতে পারলে ভালো। নইলে আমাকে তুমি ডিভোর্স দাও।’

কথাটা শোনামাত্রই সাইমার মনে হল তার মাথায় কে যেন সজোরে হাতুড়ির ঘা মারল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল - ‘এ ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে বলো? আমার কপালটাই তো মন্দ, আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি। তবে সতীন নিয়ে ঘর করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসো আমি সই করে দেব।’ আঁচলে মুখ ঢেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সাইমা।