গল্প ও অণুগল্প

সঙ্গমে আমার অভিজ্ঞতা [রম্যরচনা]



সজল রায়চৌধুরী


দোহাই ঘাবড়াবেন না। আমি এমন পাপাত্মা ন‌ই যে porno-কুটিরের ঝাপ খুলে বসব। দুঃখের সঙ্গে জানাই এমন পুণ্যাত্মাও ন‌ই যে সাগর বা ত্রিবেণী সঙ্গমে পুণ্য স্নানের অভিজ্ঞতা জানাব।

সঙ্গম একটা সেলুনের নাম। আমাদের বিশাল পাড়ার একমাত্র চুলকাটা, দাড়িছাটার দোকান। নিতান্ত‌ই ছোটো। ৩ ফুট বাই ৮ ফুট একটা চিলতে। কোনো জানালা নেই। তিন দিকে নিরেট দেওয়াল। একটা লম্বা বারান্দায় সারি দিয়ে তিনটে দোকান। সঙ্গম সেলুন ছাড়া একটা মোবাইলের দোকান, একটা শাড়ি ইত্যাদির।

দুটো দোকান‌ই আড়ে দিঘে প্রমাণ‌ আকারের। অথচ যত খদ্দের ওই লিকলিকে সেলুনে।

সেলুনে আসবাব বলতে দুটো চেয়ার। দেওয়ালে লটকানো দু'খানা আয়না। তাতে খদ্দেরের মুখ হরর স্টোরির আগন্তুকের মতো দেখাত।তাতে অবশ্য কেউ কোনোদিন উচ্চবাচ্য করেনি। সবাই চোখ বুজে থাকত। ভয়ে। আর সেলুনের মালিক বিহারের পরিযায়ী অশোক থাকত আরামে। সে আর তার দুই তরুণ জামাতা সেলুন সামলায়। শ্বশুর ও দুই জামাই-এর মধ্যে পালা করে একজন দেশে থাকে। দুজন থাকে দোকানে। ছোটো জামাই বোধহয় নববিবাহিত। তার বিরহ যন্ত্রণায় সে অবশ্য‌ই মেঘদূত লেখেনি। কিন্তু সেলুনের রেডিওতে ভোজপুরী লোকগীতির তালে তালে সে যখন খদ্দেরের চুলে কাঁচিবদ্য অথবা টাকে তবলা বাজাত, তখন বোঝা যেত তার দেশে যাওয়ার হুকুম মিলেছে।

তারপর থেকে তাকে আর দেখিনা। বড়ো জামাইকে একা পেয়ে সাড়ু ভাই-এর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। শুনলাম সে এখন শ্বশুরের গোরু চরায়। এটা প্রমোশন না ডিমোশন বোঝা গেল না। বেশি এগোলাম না। বিহারের গোরু নিয়ে কলকাতায় বসে আলোচনা করা রিসকি।দিনকাল খারাপ তো।

মাথা সঁপে দিয়ে চোখ বুজে অনেকদিন ভেবেছি, অশোক সঙ্গম সেলুনের শোষক মালিক? না, স্নেহশীল শ্বশুর, না সর্দার শ্রমিক? দুই তরুণ শোষিত শ্রমিক, bonded labour, না আদরের জামাই।

এবার খদ্দেরদের কথা ভাবা যাক। একটি মাত্র সেলুনের ওপর নির্ভরশীল এই প্রাণিরা এক মাথা উদ্বেগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। অপেক্ষা অবশ্য অনেকেই করে না।

এসে জিজ্ঞাসা করে ক'জন? অশোক হয়তো বলল, চারজন। ঠিক আছে তারপর আছি, বলে সাইকেল ঘুরিয়ে একটা টিউশনি সারতে বেরিয়ে গেল।

সঙ্গম সেলুনের এজমালি বারান্দায় একটা সিমেন্টের বেঞ্চি বিরাজ করছে। তার পিঠটা এত বেশি পেছনে, প্রায় অর্ধ বৃত্তাকারে বাঁকানো যে তাতে না যায় সোজা হয়ে বসা, না যায় হেলান দেওয়া। এই শাস্তিমূলক বেঞ্চিটার এক কোনায় সন্মার্গ পত্রিকা রাখা থাকে। খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্য মহৎ। সন্দেহ নেই। কী আশ্চর্য প্রতিভাবলে অন্তত তিন সপ্তাহের পুরোনো কাগজ রোজ জোগাড় করে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আমি তাই-ই ওলটাতাম।

বসার আর একটা জায়গা ছিল। থামের গায়ে ইলেকট্রিক মিস্তিরিদের একটা উচু টুল। আমার মতো লম্বা লোক বসলেও পা মাটিতে ঠেকত না। আর একটা সামান্য অসুবিধা ছিল। টুলটার একটা পায়া কোনো এক দুর্ঘটনায় ছোটো। সেই দুর্ঘটনার গণ বণ্টনের উদ্দেশ্যে টুলের টঙে যখন‌ই বসেছি, টুলটা দুলতে থাকে। শিশুরা ঘোর অনিচ্ছা নিয়ে মায়ের সঙ্গে সেলুনে আসে। তাদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্খী কেউ কেউ টুলবেয়ে শীর্ষ জয়ের চেষ্টা করতেই মা তার নড়া ধরে টেনে নামান।

আমার চুল কাটার পালা এলে চেয়ারে বসে আয়নায় যে লোকটাকে দেখি মনে হয় খবরের কাগজে তাকে দেখেছি। নিরুদ্দিষ্ট বৃদ্ধের খোঁজ পেলে নিকটতম থানায় জানান। সভয়ে চোখ বুজে ফেলি। আধ ঘণ্টা পরে ঝেড়ে ঝুড়ে দেওয়ার পর চোখ খুলে দেখি আর একটা লোক। বে-আইনি মাদক পাচারের দায়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়া এই লোকটার ছবিই যেন কাগজে দেখেছিলাম।