ভ্রমনপিপাসু বাঙালির বেড়ানোর তালিকায় কোনওদিন ত্রিপুরা স্থান পায়নি, তার প্রধান কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। আজ ট্রেন যোগাযোগ হলেও দীর্ঘ সময় ধরে তার যাত্রাপথ অনেককেই ক্লান্ত করে তোলে। তবুও মা ত্রিপুরেশ্বরী দর্শনে কলকাতা থেকে বিমানে চড়ে বসলাম। মাত্র চল্লিশ মিনিটের উড়ান। ত্রিপুরার মাটি ছুঁয়ে বিমান অবতরনের পর (২৬/১১/২৩) Prepaid Taxi Booth-এ যখন 230/- টাকা দিয়ে Taxi Stand কোথায় জানতে চাইলাম, তখন জানালেন, বাইরে তিনচাকা Auto দাঁড়িয়ে আছে, এখানে ওটাই 'Taxi' চলে যান কোন অসুবিধা নেই। ভাবছিলাম কেন মানুষ এখানে আসতে উৎসাহ পায় না। ভারতবর্ষের কোনো শহরে বিমান বন্দরের বাইরে Taxi থাকে না। এটা প্রথম অভিজ্ঞতা। যাই হোক সেই Auto করে Government of Tripura পরিচালিত 'গীতাঞ্জলি গেস্ট হাউস' (Geetanjali Guest House)-এ এলাম। ঠিকানা 'কুঞ্জবন', আগরতলা, ত্রিপুরা। ভারী সুন্দর জায়গা। যেন পাহাড়ের একটা টিলায়।
রবীন্দ্রনাথের সেই 'কুঞ্জবন' এখন বিয়ে বাড়ীতে পরিনত হয়েছে।
১৮৮৩ সালে রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য প্রিয় মহিষী ভানুমতীর মৃত্যুতে শোকাকুল হয়ে রবীন্দ্রনাথের গীতিকাব্য 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্ৰন্থটি পড়ে মনে এতটাই শান্তি পেয়েছিলেন যে তিনি কবিকে ত্রিপুরা আসতে অনুরোধ করেছিলেন এবং তিনি যে অসামান্য রচনা করেছেন তা একদিন সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত হবে বলে ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলেন। বিদগ্ধ বাঙালিরা তখন বাংলায় এটি 'একটি লঘু ভাবনা' বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। রবীন্দ্রনাথ এই স্বীকৃতির কথা কোনওদিন ভোলেননি। তাই ত্রিপুরার ইতিহাস সাহিত্য মিশিয়ে সৃষ্টি করলেন 'রাজর্ষী' নাটক 'বিসর্জন'! ছোটদের জন্য 'মুকুট'।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি, মহারাজ বীরচন্দ্র আমার মধ্যে সেই অস্পষ্টকে আগেই দেখেছিলেন"। এর তিন দশক পর কবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। সেই ত্রিপুরাতে আজ এসে পৌঁছেছি।
একদিকে 'সোনারতরী' সরকারী আমলাদের জন্য, অপরদিকে 'গীতাঞ্জলি' সর্বসাধারণের জন্য। দুটি রাস্তা দুদিক দিয়ে উঁচুতে উঠে গেছে।
ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের কথা আমরা জানি, শুনেছি কিন্তু কাসবেশ্বরী মন্দিরের সাথে আমরা তেমন পরিচিত নই। আজ সকালে পুজো দিয়ে 'নীরমহল' ও 'সিপাহীজলা ন্যাশনাল পার্ক' দেখে কাসবেশ্বরী মন্দিরে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পুব আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ থালার মত উঠছে। একটা কাঁটাতারের বেড়া - এপাশে ভারত ওদিকে বাংলাদেশ। ওদের লোকজন, আলোকিত পথঘাট সব দেখতে পাচ্ছি।
অনেকগুলো মাইকে সন্ধ্যার নামাজের আওয়াজ বিভিন্ন মসজিদ থেকে ভেসে আসতে থাকলো। বিচিত্র এক মেলবন্ধন। এপারে কাসবেশ্বরী মন্দিরে তখন সন্ধ্যারতি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরেও বহুদিন কোনো বেড়া লাগানো হয়নি, এমনকি পাকিস্তান দু'টুকরো হয়ে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পরেও। এপাশের মানুষের ওপাশে যাতায়াত, মেলামেশা অবাধ ছিল বলা যেতে পারে। কোভিডের সময় কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার আলোকে ওটা আর একটা দেশ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এত কাছে মনে হয় হাত বাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাই বা সালাম আলেইকুম বলি। কিন্তু রাজনীতি আমাদের শত্রু বানিয়ে দিয়েছে। কোনও চেকপোস্ট চোখে পড়েনি। আগে জায়গাটির নাম ছিল 'কৈলারগড় কমলাসাগর'।
১৪৩৭ খৃষ্টাব্দে মহারাজ ধন মানিক্য বাংলার নবাব হুশেন শাহর সেনাপতি হৈতন খাঁর কাছে পরাজিত হন। মুসলমান শাসনকালে কৈলাসগড়ের নামটি পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় 'কসবা'। মহারাজা বিজয় মানিক্য (১৪৫০-১৪৯২) একটি খড়ের ঘরে এই বিগ্ৰহটি স্থাপন করেছিলেন। পরে মহারাজা কল্যাণ মানিক্য ৪x৪ হাত পরিসরের বিশেষ প্রকোষ্টে সিংহবাহিনী দশভূজার মূর্তি স্থাপন করেন। মহারাজ ধন মানিক্যের মহিষী কমলা, মহাদেবী মন্দিরের সামনে বিশাল দীঘিটি খনন করান। যা পরে 'কমলাসাগর' নামে পরিচিতি পায়। পশ্চিমপাড়টি এখন বাংলাদেশ সীমানায় পড়েছে। ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে মন্দিরের অনতিদূরে কমলাসাগর স্টেশন তৈরী করে, যা বহিঃজগতের সাথে একমাত্র যোগাযোগের পথ ছিল। মন্দিরটি একটি উঁচু টিলার উপরে। বাংলাদেশ ত্রিপুরার তিনদিকে কিন্তু এখানে সীমান্ত বলে কিছু নেই। একে অপরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে গাছপালা দীঘির সাথে। মাত্র একজন ভারতীয় জওয়ানকে বন্দুক নিয়ে কমলাসাগরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।
মা রয়েছেন সবার উঁচুতে তার দুই সন্তান ভারত এবং বাংলাদেশকে বুকে জড়িয়ে। অবশ্যই দর্শনীয় স্থান। কসবার নাম নিয়ে মা আজ কাসবেশ্বরী। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া এক শান্তির বাতাবরণে পরিবেশটি পরিপূর্ণ। এমন জায়গায় আসতে বারবার মন ছুটে যায়।
আলোকচিত্রঃ লেখক।