বিবিধ

খাল-বিলের আখ্যান (চতুর্থ পর্ব) [ধারাবাহিক]



মমতা বিশ্বাস


আগাম অতি বৃষ্টি না হলে গভীর জলা জায়গাটা ছাড়া চারপাশে পাট, আউশ ধান হয়। আমন ধানের বীজ ও ছড়িয়ে রাখে কেউ কেউ। শীতে জল থাকে না। সোনার ফসল ফলে। সার জলের খরচ হয় না বললেই চলে। এবার নিম্নচাপের বৃষ্টির ফলে জল জমে আছে। কোমরের উপরে জল। সে জল বেরিয়ে পলদা খালে বা খালবোয়ালিয়ার খাল দিয়ে বেরিয়ে যাবার রাস্তা বন্ধ। পলদার মুখে বাঁধাল দেওয়া। খালের মুখেও তাই। অল্প জলে পানা আর আবর্জনার স্তুপ মাঝে মাঝে। একটু উঁচুতে কিছুটা জায়গায় ধানের বীজতলা। আর বৃষ্টি না হলে হয়তো রোপন করতে পারবে চাষীরা।

সকাল হলেই এখানকার নারী-পুরুষেরা দল বেঁধে কাঁটাতারের বেড়ার গেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওপাশের জমিতে চাষ-আবাদ করতে যাবার জন্য। কাঁটাতার আর দাঁড়গাছা বিলের মধ্যবর্তী মাঠে চাষ করে ফসল তুলে আনতে বেড়ার এ-পাশের মানুষের হয়রানির শেষ থাকে না। দাঁড়গাছা বিলের ধার দিয়ে বেশ কয়েক ঘর মুসলিম পরিবারের বাস। ঘরবাড়ির কাঠামো তাদের দারিদ্রতার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাড়ার যুবকরা ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন কাজে। কাদা প্যাচপ্যাচানি। মাটির মেঝের ডোয়া রসে ড্যাবড্যাবে হয়ে আছে। খালের পাশ দিয়ে বিএসএফ জোয়ানরা টহল দিচ্ছে। একই খালের জলে পাট জাগ দেওয়া আর ছাড়ানোর কাজ করে। এপারে ভারতের মানুষ আর ওপারে বাংলাদেশিরা। পয়লা বৈশাখের দিন দুই দেশের মানুষ একসঙ্গে মাছ ধরে। ওই একটা দিনই। দাঁড়গাছা খালের ধারের অধিবাসীরা অতিথি পরায়ণ। কাদা প্যাচপ্যাচানি উঠোনে চেয়ার এগিয়ে দেয়। কুন্তি বসে পড়ে। বৃদ্ধা ফরিদাবিবি নকসী কাঁথা সেলাই করছে একহাত ঘোমটা দিয়ে। ঘোমটায় ঢাকা মুখ নাড়িয়ে শোনালো তাদের সুখ-দুঃখের গাঁথা। দরিদ্র ভিন্ ধর্মী মানুষদের এমন আপ্যায়নে কুন্তি অবাক। আরও অবাক হল এ-পাড়ার ছেলে-মেয়েরা ওদেশের স্কুলে পড়তে যায় শুনে। ফরিদা, আকবর, রুকসানা, আজমল, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। টহলদারি বিএসএফ-দের চোখে ফাঁকি দিয়ে যাওয়া-আসা করে। ওদের বিয়েও হয় ও-দেশে। অনেকে ও-দেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসছে হামেশায়!

'বিয়ে কেমন করে হয়?' প্রশ্ন করে কুন্তি।

'অসুবিদে নেই। হয়ে যায়। খালের পাড়ে সব কুটুম রয়েচে। ছেলে ক্যান? ছেলের বাপকে পর্যন্ত বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসতে পারে করিম চাচা।'

হাসতে হাসতে বলল ফজর আলী।

সঙ্গী ফুলটুসি পাড়ার সবাইকে বলল, "তোমরা সবাই আমাদের পাড়ায় নাচ, গান- বাজনা হবে দেখতে যেও।"

ফুলটুসির ভাষা মার্জিত। সাত বছর বয়স থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত দমদমে দুর্সম্পর্কের পিসির বাড়ি ছিল। অক্ষর জ্ঞান ওই সময়ে হয়।

২০১২ সালের দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিন কুন্তি হুদোয় ছিল। তখন ফুলটুসির সঙ্গে পরিচয় হয়। করোনার সময়ে সীমান্তের লোকেরা কেমন আছে জানার জন্য আবার এসেছে। ফুলটুসিদের কাছাকাছি হতেই বুঝল এই সেই বউটি। ধুনুচি নাচ নেচে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিল। তখন এসেছিল সীমান্তের দুর্গাপুজো দেখতে। বিলপাড়ে শরিকানা উঠোনে পুজোর ব্যবস্থা হয়েছিল। ছোট্ট প্যাণ্ডেল। পাশে স্টেজ। দুপুরবেলা থেকে উঠোনে, খামারে চুড়িমালা, খেলনা, মিষ্টিমিঠাই, তেলেভাজা, ফুচকা, বাদাম, হরেক রকম জিনিসের দোকান বসে গেল। সন্ধ্যে নামার আগেই জমজমাট হয়ে উঠল পুজো খোলা। তারস্বরে মাইক বেজে যাচ্ছে। একটা গানই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। 'ও টুনির মা তোমার টুনি কথা বলে না...' ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসো জন, বস জন প্রত্যেকটি বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজন এসেছে। এসেছে মেয়ে-জামাই। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট এবং দিল্লিতে হাতুড়ে ডাক্তারি আর খোয়াক ডাক্তারি করতে যাওয়া ছেলেরা সপরিবারে। আর্মিতে দু'চারজন চাকরি করে তারাও এসেছে। উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চপদস্থ চাকুরে এই গ্রামে কেউ নেই। এরা সবাই বছরে একবারই আসে। প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠেছে উৎসব মুখর। শহর থেকে আসবে নাচ গানের দল। ৫ ঘণ্টা নেচে, গেয়ে মাতিয়ে দেবে ৩০ হাজার টাকায়। রঙিন জলের ফোয়ারা ছুটবে বাঁ-হাতের পয়সায়। রাতের অন্ধকারের দরকার পড়বে না রঙিন পানীয় পানে। সন্ধ্যারতির ঢাকের বাদ্যিকে পাল্লা দিতে হয় 'টুনির মা' গানের সঙ্গে। সন্ধ্যারতি হচ্ছে, সঙ্গে টুনির মা গান। কুন্তি দুই একজনকে বলেছিল গানটা বন্ধ করতে। উত্তর এল, "ওদের মাইকটা বাজছে; আমাদেরটা বন্ধ করা যাবে না।"

গ্রাম্য মহিলাদের ধুনুচি নাচ শুরু হল একটু পরেই। ঘোমটা দেওয়া রমণীরা ঢাকের তালে তালে দু'হাতের তালুতে ধুনুচি নিয়ে এক ঘণ্টা ধরে কী নাচটায় না নাচল, তবে ফুলটুসির সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। গলগলে ধোঁয়া ওঠা ধুনুচি মুখে ফুলটুসির সেকি নাচ! ধুনুচি নাচের সময় মাইক ক্ষ্যান্ত দিয়েছিল। বৌদের কোমর দুলুনির টানে পুরুষ মানুষের ভিড়! নির্মেদ একহারা চেহারার ফুলটুসির নাচের ভক্ত পুরুষেরা চোখ দিয়ে গিলছিল। নাচ শেষে হাত তালিতে ফেটে পড়ল পুজো খোলা। অন্য নারীরা হিংসে করে টুসিকে। ভ্রু কুঁচকে ওঠে তাদের! তাকে সবকিছুই ভালো করতে হবে? "সব পুরুষমানষির মন ভুলাতি হবে"?

সন্ধ্যে সাতটায় দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বঙ্গজননী বন্দনা দিয়ে। সুন্দর পরিবেশনা। শেষ হতেই "নাচের গান হোক... নাচের গান হোক" বলে চিল চিৎকার।

জনতার রায়ই শেষ কথা। ছ'টি বাড়ির ঘরের বারান্দা, উঠোন কোথাও এক ফোঁটা পা ফেলার জায়গা নেই। নিমন্ত্রিত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পদস্থ কর্তা ব্যক্তিদের বসার এবং আপ্যায়নের আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে। উঠোনে পাতা তাঁবুতে বসে কুন্তি সেদিনের অনুষ্ঠান দেখেছিল। একের পর এক নাচের গান হচ্ছে - সিটি আর উল্লাসে ফেটে পড়ছে তরুণ-যুবকের দল। সুন্দরী মেয়েদের নাচে স্টেজে টাকা উড়ে আসছে? গ্রাম্য সংস্কৃতিতে টাকা উড়ছে? কুন্তির মামাবাড়ি ছিল গ্রামে। ছোটোবেলায় খুব আসত। সেখানে টাকা দিতে দেখেছে অষ্টকগান, যাত্রা, নাটকের সেরা কুশীলবদের। সেপটিপিন দিয়ে শাড়ি/জামায় আটকে দিয়েছে দশ/বিশ টাকা। ও তো বাণ্ডিল বাণ্ডিল! গুজরাটি ভাংড়া গানের নাচনেওয়ালী মুখের মধ্যে আঙুল দিয়ে সিটি দিতেই টাকার বাণ্ডিল ছুড়ে দিলেন একজন কমাণ্ডার। অধিকাংশ যুবকদের পা টলছে। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় স্টেজের সামনেটা আবসা আবরণ। মায়েদের, বৌদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। কোন অঘটন ঘটিয়ে না বসে। গতবছর ফুলটুসির ছোটোজামাই মেজ সরকারের ছাদ থেকে টাল সামলাতে না পেরে নীচে পড়ে গিয়েছিল। ইটের কোনায় চোখে লেগে সেকি বিপদ! দুই পাড়ার তরুণ যুবকদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে পুজোর কয়দিন। গণ্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনায় বাড়ির কর্তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। লাল-সবুজের পুজো। দুইদলের একটায় লক্ষ্য নিজেদের সেরা প্রমাণ করা। দুশ্চিন্তা সেইকারণে অনেক বেশি। দু'চারজন বিলের পাড়ে কাদা-মাটি মেখে পড়ে রইল সারারাত। পরের দিন সকালে খালি বোতলের ছড়াছড়ি বিলের পাড় দিয়ে। এ উন্মাদনা যেন সারা বছরেরটা উসুল করে নেওয়া। শহরের আলো ঝলমলে জাঁকজমকপূর্ণ পুজো দেখার সৌভাগ্য হয় না তাদের। সদর মফঃস্বলের পুজো দেখতে হলে দুপুরে বেরিয়ে সন্ধ্যেয় ফিরে আসতে হবে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব এই ভাবেই পালন করে সীমান্তের মানুষ। গ্রামবাসীদের আতিথেয়তা তুলনাহীন। মাথা গুনে রান্না হয় না কোনো পরিবারে যদিও চিড়ে, মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, নাড়ুকে পাল্লা দিতে হচ্ছে লুচি, ঘুগনি, সুজি, ফ্রাইড রাইস, পোলাও, চিকেন, মাটনের সঙ্গে। শহুরে হাওয়া লেগে গেছে পল্লির দ্বারে দ্বারে।

হুদো দিগম্বরপুরের সব পরিবার ওপার বাংলা থেকে এসে ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করে বাস করতে শুরু করে। পতিত জমি আবাদ যোগ্য করে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আশপাশের গ্রামে ঘোষ, মাহিষ্য ও মুসলমানদের বাস। বিলের অপর পাশে একচেটিয়া ব্রাহ্মণদের বাস ছিল অতীতে। তাঁরা ও-পার বাংলার নিম্নবর্ণের মানুষদের, মানুষ বলেই গণ্য করত না। দীঘির ও-পারের গ্রাম দিগম্বরপুরের রায়বাড়ির বর্তমান বংশধর একটু বিনয়ের সঙ্গেই সেজো সরকারকে বললেন "কাকা, কিছু মনে কোরো না; তোমরা বলেই পেরোচো ঝোপ-জঙ্গলে বাস করতে। আমরা হলে কিছুতেই পারতাম না। বাবা গল্প করত বন্য জীবজন্তুর আখড়া ছিল তোমাদের হুদো"।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারেন যারা (যদিও কথাগুলো বলার মধ্যে যথেষ্ট বিনয় ছিল); তাহলে ওপার বাংলা থেকে সদ্য আসা মানুষদের স্থানীয় মানুষ; বিশেষ করে উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে কত হেনস্থা হতে হয়েছে? এসব বাড়িতে সকল বাঙালদের অন্দরমহলে প্রবেশের ছাড়পত্র মেলেনি এখনও। গ্রামবাসী এক যুবক বলেই বসল, "আরে বাপরে ঐ ঠাকুর বাড়ির চাতালে বসে কথা বলেছো? বসতে দিল? চেয়ার দিয়েছে? বিশাল ব্যাপার। মন্দিরে দোল উৎসব খুব ভালো হয়। কাছে যেতেই দেয় না আমাদের। কলে হাত ধুতে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেব"।

প্রতিদিন কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে গরু-ছাগল বাংলাদেশে চ'রে বিকালে ফিরে আসে।

বিএসএফ কমাণ্ডের কানে যেতেই কড়া নির্দেশ জারি হয়েছে। জনসাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ। তার উপরে চলছে ওমিক্রন।

হুদো দিগম্বরপুরের গ্রামবাসীদের দুর্গতি বেড়েছে আরও এক ধাপ। খালবোয়ালিয়া ছেড়ে বিষ্ণুপুরের রাস্তায় গাড়ি উঠতেই একটা গা ছমছমে পরিবেশ। কোন বসতি নেই। রাস্তার দুধার দিয়ে আম-কাঁঠাল ও সেগুন বাগান। আগাছার ঝোপ-জঙ্গল। দিনের বেলায় একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। বিএসএফ-দের রোড়ের উপর দিয়ে কিছুটা যেতে হবে। গ্রামের মেম্বার বলে রাখায় কোন বাধা এল না। খড়ের ছাউনির নীচে রাইফেল হাতে পাহারারত জোয়ান হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন। রাস্তার ডানদিক দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার ওপাশে দাঁড়গাছা বিলের পাশ দিয়ে হলুদফুলে সর্ষেক্ষেত আলো হয়ে আছে। এই সময়ে অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি জল আছে বিলে। বিলটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় মানুষদের মুখে শোনা বাংলা দেশের ১০৫টা খাল-বিলের জল দাঁড়গাছা বিল দিয়ে নেমে আসে দামোদরের বিলে। অতীতে দাঁড়গাছা বিলের সঙ্গে গোবিন্দপুরের পরে তালদহের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর জেগে ওঠা চরে চাষ হয়। দাঁড়গাছা বিলের ওপাশে বাংলাদেশের বড়ো বুন্দেলিয়া এবং ছোটো বুন্দেলিয়া। বিলের ডান দিকের গ্রাম হুঁদো দিগম্বরপুর,কাদিপুর, কাঁদাঘাটা। পলদা তীরবর্তী গ্রামগুলো হল কাদাঘাটা মহেশপুর, বোয়ালিয়া, হুদো বোয়ালিয়া, কড়ুইগাছি, কুলতলা, গাটরা, শাকদা, ভগবানপুর, ট্যাংরা, পিঁপড়ে গাছি, ময়দানপুর, মুড়াগাছা। দামোদর বিলের বাঁদিকে দিগম্বরপুর, প্রতাপপুর, মুকুন্দপুর। সব প্রাচীন গ্রাম। ছ'সাত পুরুষের বাস। বর্ণ-হিন্দু, মধ্যবৃত্ত শিক্ষিত বাঙালি শহরমুখি। শিক্ষা-দীক্ষায় ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্ণের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষের কোনো উন্নতি হয়নি। কেউ কাউকে মান্যি করে না। শাসনহীন পল্লিসমাজ অবক্ষয়ের চরমে! আর্থিক অনটন নেই বললেই চলে। অনন্ত দিনে দুইবার উনুন জ্বলে সব বাড়িতে।

দাঁড়গাছা বিল ও দামোদরের বিলের সংযোগ স্থলে একটা ব্রিজ তৈরি হওয়ায় হুদো দিগম্বরপুর, কাঁদিপুরের মানুষদের সুবিধা হয়েছে। বেশী উপকৃত হয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।

একবারই মাত্র দামোদর বিলের জল দাঁড়গাছা বিলে গিয়ে পড়েছিল। সেটা ২০০০ সালের বন্যার সময়। বন্যার সময় এতদ অঞ্চলের মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল বিএসএফদের সড়ক পথের উপর। বাংলাদেশের লোকেরা পানীয় জল ও খাবার দিয়ে গেছে ভারতীয়দের।

দামোদর বিলের আয়তন ৬,০০০ একর। বিলের পাশ দিয়ে দিগম্বরপুর যাচ্ছিল কুন্তি প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে। যিনি বিলের শেষ মাথা থেকে তালদহ খালের সংস্কার করার দায়িত্ব পান। এ অঞ্চল কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের অন্তর্গত। ব্রিজের এপারের গ্রামটির নাম দিগম্বরপুর। প্রাচীন গ্রাম। রায় পরিবারের ষষ্ঠ বংশধর সৌমেন রায় তাঁর পরিবার নিয়ে আছেন। অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হয়েছে। মন্দির চাতালে এসে বসে পড়ল কুন্তি। রায় পরিবারের শেষ বংশধর এগিয়ে এল।

"কী ব্যাপার সেজদা এই ভরদুপুরে? ও মা তিনটে চেয়ার নিয়ে আয় মা। বসতে দে"।

কিশোরী তিনটি চেয়ার এনে পেতে দিল।

"আপনাদের গ্রাম দেখার জন্য এসেছি। নীলবিদ্রোহের নেতা দিগম্বর বিশ্বাসে বাড়ি দেখতে এলাম"।

"নীলবিদ্রোহী দিগম্বর বিশ্বাসের বাড়ি? এই গ্রামে তো নয় তাঁর বাড়ি? কোনো কালেই ছিল না। তাঁর বাড়ি পোড়াগাছায়। বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসের মেজঠাকুরদাদা। আরে, কারা মন্ত্রী যাদের বংশধর। লোকে বলে বসন্ত বিশ্বাসকে ওর ঠাকুর দাদায় ধরিয়ে দিয়েছিল। এখন তাঁর নাতি বসন্ত বিশ্বাসকে নিয়ে কত আদিখ্যাতা দেখাচ্ছে! থুথু ঘেন্না ধরে গেল। এই গ্রামের পত্তন করেন শ্রীপতি ব্যানার্জি। সেই বংশের লোক আমরা। 'রায়' উপাধি পাওয়া। একচেটিয়া ব্রাহ্মণদের বাস ছিল। নীলবিদ্রোহী দিগম্বর বিশ্বাস কৈবর্ত্য ছিলেন। তার নামানুসারে দিগম্বরপুর নাম হয়নি। ওই যে বিলের ধারে বটগাছ দেখলেন ওখানে একজন দিগম্বর সাধু থাকতেন। তাঁর নামানুসারে গ্রামের নাম দিগম্বরপুর নাম হয়েছে। আমার পুর্বপুরুষেরা রাজা রুদ্র রায়ের সময় লেখাপড়া শিখে অধিকাংশই শহরমুখী হয়েছেন শিক্ষা আর চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধালাভের জন্য। অবস্থা ভালো নয় আর লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকারা গ্রামে পড়ে রয়েছে। এই আমি যদি চাকরি করতাম পড়ে থাকতাম এই গ্রামে? কখনও নয়। আমার মেয়ে ওকালতি পড়ছে, পড়া শেষে ও কী থাকবে এখানে? না। থাকা সম্ভব ও না। যারা গ্রামের সামাজিক পরিবেশের উন্নতি করবে, গ্রামের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে শহুরে বাবু হয়ে যাচ্ছে। ক্যাট মালরা গ্রামে পড়ে থেকে নীচে টেনে নামাচ্ছে পল্লিগ্রামের সমাজকে"।

'প্রবীন লোকেদের মুখে শুনেছি বিলের পাশে প্রাচীন বটগাছের নীচে একজন দিগম্বর (বস্ত্রহীন) সন্ন্যাসী থাকতেন। নির্জন বটগাছের কোটরে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। সেইকারণে জনবসতি গড়ে ওঠার পর গ্রামটির নাম হয়ে যায় দিগম্বরপুর। লোকে জানে না তাই উল্টোপাল্টা বলে। বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। শিক্ষা-দীক্ষার দিক থেকেও অনেক এগিয়ে; তার সাক্ষ্য বহন করছে, দেখছেন না, ঐ যে প্রাচীন লাইব্রেরী, পোষ্ট-অফিস"।

"মন্দিরটির বয়স কত হতে পারে"?

সৌমেনবাবু উত্তর দিলেন, "শিব মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে প্রায় আড়াই'শ বছর আগে। নিত্য পূজারী আছে। ধুমধামের সঙ্গে দোলোৎসব হয়। ভগ্ন বাড়ি-ঘর চোখ এড়ালো না কুন্তির। জমিদারদের পতনের মূল তাদের অলসতা, বিলাস-ব্যসন এবং চারিত্রিক স্খলন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে ব্যক্ত করলেন। কয়েক হাজার বিঘে জমির মালিকদের বংশধরকে মুনিষ খাটতে হচ্ছে! একজনের হাতেই ত্রিশ বছরেই শেষ হয়ে গেছে ২০০ বিঘে জমি। নীল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের ষষ্ঠ বংশধর ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছিলেন কুন্তিকে। এ ক্ষোভ ছিল তার পিতার প্রতি। ১০০ টাকার নোট সিগারেট বানিয়ে খেয়েছে। খাজনা বাকী আছে, ৫০/১০০ টাকায় ৫/১০ বিঘে জমি লিখে দিয়েছে। বস্তা বোঝায় দলিল-দস্তাবেজ আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই জমিদার বাড়ির কিচ্ছুই অবশিষ্ট নেই; দুর্গা দালানের ভগ্ন গেট ছাড়া। যিনি এত কথা বললেন তিনি মুনিষ খাটেন। তার পরের প্রজন্ম অষ্টাদর্শী হেসেই গড়িয়ে পড়ছে; নীল বিদ্রোহের নেতা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের নাম শুনে। ভাবখানা এমন; কী আর করেছে সে, তার জন্য গর্ব অনুভব করতে হবে? তার সম্পর্কে জানার জন্য শহর থেকে ঠা ঠা রোদের মধ্যে এসে হাজির হয়েছে।

হায়! কয়েক লক্ষ কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করে, ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার নামটা কোথাও স্থান পায়নি। স্কুল, ক্লাব, পাড়া,রাস্তায় কোত্থাও না। লেখা হল 'নীলদর্পন' নাটক। খবর পৌঁছে গেল ইংল্যান্ডে। টনক নড়ল শাসকের। আইন করে বন্ধ হল নীলচাষ। ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষটি ইতিহাসে ঠায় পায়নি সেইভাবে। দেয়নি শাসকশ্রেণি। শেষ পরিণতি কী হয়েছিল সেই বিষয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশবাসী যেমন মনে রাখেনি; তেমনি মনে রাখেনি বা রাখার চেষ্টা করেনি তাঁর উত্তরসূরিরা, গ্রামবাসীরা। ব্রাত্যই থেকে গেছেন তিনি।

দিগম্বরপুরের বিলের পাড় বরাবর পাকা বাঁধালের কিছু অংশ এখনো দেখা যায়। ওদিকে দাঁড়গাছা বিলের পাশ দিয়ে নীলকুঠিতে যাতায়তের রাস্তা রয়ে গেছে গোবিন্দপুরের মধ্যে দিয়ে। দিগম্বর পুর থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে নীলকুঠির গুদাম ঘর খালবোয়ালিয়াতে। ভগ্নস্তূপের প্রতি খাঁজে কত গাঁথা গেঁথে আছে। গোবিন্দপুরের কুঠিবাড়িটি বিএসএফ-দের ক্যাম্প হয়েছে। সাহেবপুকুর রয়েছে খালবোয়ালিয়াতে। সে পুকুরের ইতিহাস মস্ত বড়ো ইতিহাস!

(ক্রমশ)

আলোকচিত্রঃ লেখিকার কাছ থেকে প্রাপ্ত।