বিবিধ

মনোবীক্ষণ [মুক্তগদ্য]



অভিজিৎ রায়


আমাদের ঠিক কী কী হারিয়ে গিয়েছে তার হিসাব কষতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি আরও অনেক কিছু। প্রতিদিনই এই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আপন আর পরের তকমা দিতে দিতে কবেই যেন নিজেকে আর আপন না ভেবে পর ভাবতে শুরু করেছি।

এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। অনেকেই ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না জানি। তবু, এই অগোছালো বিষয়টি গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করে দেখছি মাত্র। নিজেকে ভাল না বাসলে বোধহয় আমাদের কেউই ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে বেরোই না! অথচ এই দুঃসময়ে, যখন আমি বুঝতেই পারছি না যে আদপে আমি আমার কতটা আপন বা কতটা পর, তখন কী করে মনের মানুষ খোঁজার কাজটা চলতে পারে? আসলে পারে না। কিন্তু লোকে বিশ্বাস করে না। একজন মানুষ কি আদৌ নিজেকে পর ভাবতে পারে? ভাবতে পারে শত্রু? হয়তো পারে না অথবা পারে। আমি ঠিক জানি না। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি এরকমই একটা ভাবনার মুখোমুখি। নিজেকেই সব থেকে দূরের মানুষ মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে পর এবং শত্রুও। অথচ, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। মেনে নিতে পারছিও না। এরই মধ্যে খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজে যাচ্ছি, কথা বলছি, চুপ থাকছি এবং ভাবছি। নিজেকে আপন ভাবছি আবার পরক্ষণেই ভাবছি পর। এই আপন আর পর ভাবার অবসর আমার জুটে গেলেই, কাছের লোকজনেরা রে রে করে তেড়ে আসছে। কাছে থাকার শর্তে তারা আপন অথবা আমার অবসর তাদের কপালে না জোটার সুবাদে তারা পর - এইরকম এক তর্কের মধ্যে দিয়ে আমি বোধহীন নির্বাকের চরিত্রে অভিনয় করার চেষ্টা করলেও করে উঠতে পারছি না। নিজেকে পর বানিয়ে ফেলে নিজের অনিষ্ট করতে কাছের মানুষজনকে অনেক কথাই শোনাচ্ছি যা না শোনালে তাদের তরফে আপন, পরের দ্বন্দ্ব বলে কিছু থাকত না।

সে না থাকলেও আমার মধ্যেই এই যে নিজেকে আপন আর পর করে নেবার আলোছায়া অবিরত খেলে চলেছে তাকে নিয়ে কখনও ক্যানভাসে পড়ে তুলির আঁচড় আবার কখনও শব্দের নীরবতায় চোখের জল সুর বাঁধে। ছন্দ আর ছন্দ ভাঙার খেলার ঘুম আসে না। অথচ স্বপ্নের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার সুযোগ জুটে যায় বারবার। নিজেকে হিংসা করতে করতে স্বপ্নের বুদবুদে আলপিন দিয়ে আঘাত করি। আপনকে পর বানানোর এই উত্তেজনাপূর্ন খেলায় নিজেকে আঘাত করি। আঘাত করতে করতে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে রক্তপাত হয়। রক্তের স্বাদ পেয়ে যাওয়া আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি আমার উপর।

কাছের লোকেরা এসব বুঝতে পারে না। আপন আর পরের ফারাক বোঝার আগেই তারা অভিমানী হয়ে দূরে সরে যায়। নিজেকে আপন আর পর বানানোর দোলাচলে থাকার মুহূর্তে অনেক প্রিয় মানুষ পর হয়ে যায়। তাদের অভিমান, ঈর্ষা, চাওয়া, পাওয়ার সংঘাত আমাকে আমার শত্রু ভাবতে সাহায্য করে। আমি লিখতে থাকি এইসব। আবার কখনও এইসবের বাইরে বেরিয়ে লেখার মধ্যে দিয়েই খুঁজতে আরম্ভ করি নিজেকে। যে আপন তাকে, যে আমি পর তাকেও। যে কাছের লোক আপন তাকেও বুঝতে পারি আবার যে পর তাকেও বোঝার চেষ্টা করি। অবশ্য এইসব বুঝতে পারা আর বোঝার চেষ্টা করার ফাঁক দিয়ে মনের উপর এত বোঝা এসে জমে যে ধনী হয়ে উঠি। অনেক না বলা অনুভবের সম্পদে আমাকে ধনী হয়ে উঠতে দেখে দরিদ্র আমার হিংসা হয়। সে আমার শব্দ, বাক্য, যতিচিহ্ন কেড়ে নিতে চায়। আমাকে দারিদ্রের পার্থিব অসুখ দেখিয়ে ভয় দেখায়। আমি ভয় পাই। নিজেকে এই একটা মুহূর্তে নিজের বন্ধু মনে হয়। আমি ছুটতে শুরু করি। কাজের পিছনে ছুটি, অর্থের পিছনে ছুটি, নিজের পিছনে ছুটি, নিজের আপনার যে জন তারও পিছনে ছুটি। পিছনে ছুটতে ছুটতে বুঝি, আমি পিছনে পড়ে গেছি। আমাকে টেক্কা দিয়ে জীবন এগিয়ে গেছে অনেকটা আর আমি বেঁচে থাকা নিয়ে গর্ব করব বলে ম্যারাপ বেঁধে নাচছি। এই মুহূর্তে আমার কোনও আপনার জন থাকে না, পর থাকে না। আমি একা। সৃষ্টিকর্তার মতন একা। অথচ সৃষ্টি থেকে অনেক দূরে। একজন ভোগী, উপভোক্তা সেজে মঞ্চে উঠে ভুলে যাই নিজের সংলাপ। দর্শকাসন থেকে কিছু আমি হেসে ওঠে। কিছু আমি চিৎকার করে ব্যঙ্গ করে। কিছু আমি পচা ডিম ছুঁড়ে মারে। আমি ভুলে যাই আমার কী করা উচিত তখন। তবু তীব্র আলোর বিপরীতে দৃষ্টি ফেলে আমি সেই আমিগুলোর পার্থক্য বিচার করতে বসি। কোন আমি আপন আর কোন আমি পর। এইভাবে সমস্ত অবসর ফুরিয়ে যায়।

অবসর ফুরিয়ে গেলে বাল্যবন্ধুকে ফোন করা হয় না। প্রেমিকাকে বলা হয়ে ওঠে না তার চিঠিতে কতগুলো বানান ভুল ছিল। স্ত্রীর পাশে বসে বলা হয়ে ওঠে না "ভালবাসি"। তবে কি প্রতিটি মানুষ অবসর ফুরিয়ে ফেলে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। তার প্রতিটি কথায়, চিৎকারে সে শুধু সন্ত্রাস সৃষ্টি করে? কাছের লোকদের ভয় দেখিয়ে বেড়ায়? যাতে তাদের কাছের লোকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে না পারে?

এতগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ালে বাধ্য হই নিজেকে ভুলে যেতে। বাদী আর বিবাদীর চরিত্রে অভিনয় করতে করতে ভুলে যাই নিজের মূল চরিত্র। আত্মানুসন্ধানের ফাঁকে ঢুকে নিজেকে আপন যেমন মনে হয় তেমনই মনে হয় পর। আর তাই সবকিছু সহজ হয়ে যায়। প্রতিটি কাছের লোক আমাকে আপন ভাবতে পারে বা পর কিন্তু আমি লোকটা হারিয়ে যেতে পারি না তাদের কাছে। কখনও আপন হয়ে বেঁচে থাকি কখনও পর। কখনও শত্রু হয়ে বাঁচি, কখনও ঈশ্বর।

ঈশ্বরের কি কিছুই হারায় না? অথবা শয়তানের? ঈশ্বর নিজেকে শয়তানের মধ্যে হারিয়ে ফেলে ভাবতে থাকে তার আপন আর পরের কথা। উল্টো দিকে শয়তান নিজের শয়তানি হারিয়ে নিজেকে পর করে দেবার পরেও আপন করে নিতে অন্ধকারে নামে। গভীর অন্ধকারের শরীরের কেন্দ্রে এক আলোকবিন্দু। সেখানেই ঈশ্বর বসে বসে নিজের আপন আর পর বাছাইয়ের কাজ করে যাচ্ছেন। আর আমি হিসাব কষছি অভিমানের, অপমানের। অভিমান আর অপমানের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আমার আপনার জন পর হয়ে যাচ্ছে। আর আমি শব্দের অন্ধকারে নেমে আলোর ঈশ্বরের স্পর্শ নিতে নিতে হিসেব ভুলে যাচ্ছি। আমি কার আপন আর কার পর!