বাড়ি থেকে বেরিয়ে সকালের আলো মাখছিলাম। ধুলো খেলার সঙ্গী হচ্ছিলাম। দু'চার গণ্ডা ধুলোদের ছানা তখন সবেমাত্র ঘুম ভেঙে জেগে উঠে খিলখিল করে হাসছে। ওদের ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঝরে পড়ছে কিরণ। আলোর ঋজুতা ঢুকে যাচ্ছে মল্লিকদের সাততলার ঘরে, ব্রজেনদার চায়ের দোকানে আর শর্মার হাতে টানা রিকশার গাঢ় নীল প্লাস্টিকের সিটের উপর। চোখের পাতার ফাঁক গলে স্বপ্নের ভেতর কড়া নাড়ছে ও। "ওগো, ওঠো তোমরা! এখন ঘুম ভাঙার সময়!..."
কান পেতে শুনছিলাম কলকলানি। হঠাৎ কোত্থেকে বেহায়া হাওয়া এসে পাতাবৃষ্টি চালালো একনাগাড়ে! ওপরে তাকিয়ে দেখি কৃষ্ণচূড়ার হলুদ ঝিরিঝিরি কল্লোল। গাছের শরীর বেয়ে গলে নামছে শীতল মেদুরতা। ওরাও যে ওর সন্তান ছিল! যত হাওয়া দেয় তত পাঁজরের ক্রুরতা মুচড়ে ওঠে। কয়েক ফোঁটা জল আমার চোখের দু'পাশ দিয়ে কানের পেছনে যে গড়িয়ে যায়নি, তা নয়! গিয়েছিল।
তোমাকে দেখতে পাই। স্পষ্ট! অনুভব করে সিক্ত হই। শীতার্ত! ওষ্ঠে মিশে যেতে যেতে দু'হাতে তোমার বুকপকেট চেপে ধরি। এ তো শূন্য নয়! পরিপূর্ণ! তোমার মুখ আমার কাঁধে নেমে এলে শীৎকার করি। সমর্পণ! অথচ সবটাই নীরব। ওদের জিজ্ঞাসা করি, "ওগো ধুলোখেলার সাথী, নীরবতা মানে কী শুধুই দহন!..." আবার আমার মুখের ওপর দিয়ে চলে যায় কাঁচাপাকা আলোর বন্দিশ। এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ। বড় মায়াময়। মায়া হয়। বলি, "ফিরে এসো প্রেম! হাত ধরো! আমাকে নাও! তোমাতে বিলীন হই! এ দেহ ছাই যেন চন্দন গন্ধ ছড়ায়। জানোই তো! বড় লোভ আমার! অমেয় বিপন্ন এ শার্শি। আমি বাঁচতে চাই। মৃত্যুতে জীবন চাই, নাকি জীবনে মৃত্যু! বুঝি না। বুঝিয়ে দাও হে আদিম পুরুষ। এসো, আমাতে অবগাহন করো। এসো, ভালোবাসি..." ধীরে ধীরে চিবুক নেমে আসে বুকে। কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যায়!
কলিজা কিছুটা শান্ত হলে সামনে তাকাই। গত সপ্তাহে বড় পুকুরের জলে বিশ্বকর্মার সৌম্যকান্তি মূর্তিগুলো ফেলে গিয়েছে ওরা। আজ সে সুঠাম পেশী আর কাঞ্চন রঙ হারিয়ে নগ্ন। জীর্ণ, দীর্ণ। ভাসছে জলের ওপর। নিস্তব্ধ। অথচ এরই জন্য সেই ক'দিন পাড়ার মোড়ে মোচ্ছব বসেছিল। উৎকট বাদ্যির তাণ্ডব! গুটিকয়েক তাঁরই সৃষ্ট সন্তানের পিতৃপ্রেম তছনছ করে দিয়েছিল কমলিনী ঠাম্মার ঘুম আর স্নেহা, অরূপদের কিশলয় পাঠ। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে দিব্যি জ্ঞাত হওয়া যায় এক দৃশ্য! ছেনি বাটালি নিয়ে কৈলাশের এককোণে নিবিষ্ট তিঁনি। কুঁদে কুঁদে গড়ে তুলেছেন মানব প্রতিমা। হয়তো আমাকেও! হয়তো তোমাকেও! হয়তো আমার তোমার প্রপিতামহকেও! হয়তো কমলিনী ঠাম্মার সেই প্রেমিককেও! এখনই ব্রহ্মা আসবেন উজাড় করে ভরে দেবেন প্রেম ওদের ভেতর। তারপরই দহন শুরু হবে।
দেখি, সেই নগ্ন খড় আর বাঁশের কাঠামোর ওপর সারস বসে। অপলক তাকিয়ে জলের দিকে। নীচে ব্যতিব্যস্ত মাছেদের সংসার। হয়তো ঘুম ভাঙেনি মৎস ছানাদের! বলি, "ওগো, ধুলোখেলার সাথী, জলের নীচে যেও না। ওদের ঘুমোতে দাও। ঘুম ভাঙলেই যে মৃত্যু! যেও না..." জলের ভেতর কি আলোর কিরণ প্রবেশ করতে পারে! তখন কি ধুলো-আলোর হাসির দমকও জল হয়ে যায় না? জলে জল কি কাঁদে? জলদহন ঠিক কতটা তীব্র? ছাই তো জলেই ভাসে! তাহলে কি হেঁটে যাবো জলের নীচে? তুমি আসবে? আসবে আমার সাথে? কত প্রশ্ন ঘিরে ধরে! তাদের করতোয়া সম্মেলক। তাকিয়ে দেখি, সারসের ধুম্র ডানার ভাঁজ থেকে হাওয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে কুয়াশা রঙের প্রতিচ্ছবি। মিলিয়ে যাচ্ছে চলচিত্র আবহাওয়ায়। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, "আমি আসছি..." কেউ যেন ক্রমশ প্রকটমান কুয়াশার ভেতর থেকে… কৃষ্ণচূড়া গাছের পেছন থেকে।
তবে কি আমি চন্দনচর্চিত হবো! কিন্তু আমি যে সাজতে পারি না প্রেম! এভাবেই কি আমায় তুমি নেবে!... আবার নীরবতা। উত্তর পেলাম। "নীরবতার নামই দহন। জলদহন।..." এসো প্রেম, এসো কাঁদি দু'জন। যতটা কাঁদলে বিস্মৃত হওয়া যায় অস্তিত্ব ততটা কাঁদি। পারব কি?