বিবিধ

মেসি



দেবাশিস সেনগুপ্ত


(১)

যাকে নিয়ে এই লেখাটা, সেই লিওনেল মেসিকে নিয়ে কবীর সুমন লিখেছিলেনঃ "মেসির খেলার ধরণ দেখে আমার সালামাত নাজাকাতের পাহাড়ি ঠুংরির গায়কী ও ব্যাপার-স্যাপার মনে পড়ে যায় আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখি, আসলে শুনি। দেখি যত, শুনি তার চেয়ে বেশি। ঐ তো একটা অমানুষিক সাপাট তান, টুকরো তান, বক্রি তান, ঐ তো একটা অভূতপূর্ব কম্বিনেশন, আমার ভাবনারও আগে চলে গেল কোথা থেকে কোথায়। মেসির সকার-ভেল্কিতে আমি পাই সালামাত নাজাকাতের খ্যাপামি, আপনায় আপনি বিভোর থাকা, প্রতিপক্ষকে প্রেমিক বানিয়ে দেওয়ার দম আর কায়দা। মেসি যেভাবে পর পর প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের একবার এদিকে, একবার ওদিকে হেলিয়ে দেন, ফেলে দেন স্পর্শমাত্র না করে, সালামাত নাজাকাতের সরগম তেমন। সরগম চলছে সে-কী ঐশ্বরিক নির্লিপ্ততায়, যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না আবার আসে, জিততে হবে, জিতবই, জানি জিতবই, তবে এই ভেল্কিটাকে সত্যি করে তুলে জিতব।" (‘চন্দ্রিলিয়ে ৩’; ২৯শে জুন, ২০১৫)

(২)

এ জীবনে লাগাতার ব্যর্থতার মধ্যেও আড়ালে থাকা অজানা এক চিত্রনাট্যকার আমার জন্য যে ক'টা ব্যতিক্রমী সম্ভার লিখে রেখেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম সেরা একটি সন্ধ্যে ছিল ২ সেপ্টেম্বর ২০১১-র আলোধোয়া যুবভারতী, যেখানে চোখের সামনে ৯০ মিনিট আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের জার্সিতে প্রথমবারের জন্য অধিনায়ক হয়ে খেলতে দেখেছিলাম মেসিকে, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে। সেদিন মেসি যুবভারতীতে তার খেলা দিয়ে মুছে দিয়েছিলেন এ জীবনের অনেক না পাওয়ার মোটা মোটা স্মারকলিপি।

সল্টলেকের যুবভারতী স্টেডিয়ামে জীবনের সেরা ফুটবল দর্শন সেদিনই। মেসির জাদু সেদিন দেখেছিল যুবভারতী। স্কিলের এই বিচ্ছুরণ, বিস্ফোরণ তার আগে হয়ত কোনও দিন দেখেনি কলকাতা। ম্যাচ শেষ হওয়ার আধঘণ্টা পরেও গ্যালারি টপকে শূন্য মাঠে ঢুকে কেউ কেউ ছুঁয়ে দেখছিলেন লোকটার ছুঁয়ে যাওয়া যুবভারতীর ঘাস। ৯০ মিনিট চোখের সামনে মাঠে আমার ফুটবল দেবতাকে দেখে নিয়েছিলাম সেদিন। সাড়ে ৮ বছর পরেও ঘোর কাটেনি আজও। কাটবেনা আর কোনদিনও। একটা পাস নিয়ে তৃতীয় পাসের কথা ভেবে ফাঁকা জায়গায় চলে যাওয়া, দু’তিন জনের পাশ দিয়ে অনায়াস চোখধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে বেরিয়ে যাওয়া, হঠাৎ অবিশ্বাস্য গতি বাড়ানো, সেই গতির উপরেই কম্পাস মাপা জ্যামিতিক সেন্টার করা, আর অনাবিল ফাঁকা জায়গা নেওয়া ও সে সবের সদ্ব্যবহার - তার এ' সবকিছুই দেখেছিলাম সেদিনের যুবভারতীতে। না, সেদিন গোল পাননি ফুটবলের বরপুত্র। একজীবনে সবকিছু হয়না। একজীবনে এমন কিছু হয়, যাতে বাকী জীবনে আর কিছু না হলেও চলে। আমার হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর, ২০১১-তে।

(৩)

গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই তার করা পেনাল্টি গোল সত্ত্বেও সৌদি আরবের কাছে ১-২ হারের ধাক্কায় বেসামাল আর্জেন্টিনার বিদায় নেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা - এই ভাবনাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে এর ঠিক ২৬ দিন পরে ২০২২-এর বিশ্বকাপ হাতে তুলে নিয়েছিল আর্জেন্টিনা আর অধিনায়ক মেসি, টানা ৬টা ম্যাচ জিতে। তিনি নিজে ম্যাচপুরুষ হয়েছিলেন ৭টার মধ্যে ৫টা ম্যাচে, নির্দিষ্ট সময়ে ৭টি গোল দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ১৫টির মধ্যে, টাইব্রেকার ধরলে ৯টি গোল দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ২৩টির মধ্যে। পুরো সময় মাঠে ছিলেন, পুরো সময় তেল খাওয়া মেশিনের মতো টেনেছিলেন টিমটাকে, কোচ লিওনেল স্কালোনি আর চমৎকার কিছু সহখেলোয়াড়ের সাহচর্যে। গ্রুপে মেক্সিকোর বিপক্ষে আর রাউন্ড অফ ১৬-তে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধ সূচ্যগ্র ফাঁকফোকর খুঁজে নিয়ে গোল করেছেন, যা অন্যদের পক্ষে কল্পনা করাই মুশকিল শুধু না, অসম্ভব ছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে জেতার পরে গোটা টিম উল্লাসরত, শুধু মাটিতে পড়ে কাঁদছেন শেষ প্রহরী এমি মার্টিনেজ, এমন অবস্থায় গণউল্লাসে মেতে ওঠা টিমের দিকে না গিয়ে দৌড়ে গেলেন এমির দিকে, তাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে আলভারেজের ৩য় গোলের অ্যাসিস্টের আগে তার ওই স্বপ্নেও না দেখা টার্নিং মেশানো ড্রিবলিংয়ের কথা কেউ ভুলতে পারবেন জীবনে? আর ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলায় ডি মারিয়ার করা ২য় গোলের কয়েক সেকেন্ড আগের সেই বাঁ পায়ের সাইড ফ্লিকটার কথা আমার মতো আম-আদমিও মনে রেখে দেবে সারা জীবনের জন্য।

(৪)

২০০৬ থেকে ২০২৩, ১৮ বছর ধরে একটা লোকের পায়ের জাদুর জন্য ভালবাসা বছর আশির প্রবীণ প্রাক্তন আমলা, বছর ষাটের ব্যাঙ্ক অফিসার, বছর চল্লিশের গৃহবধূ, বছর তিরিশের স্কুলশিক্ষক, বছর কুড়ির আইটি ছাত্র, বছর দশের স্কুলপড়ুয়া, এই পেশান্তর আর প্রজন্মান্তরকে মিলিয়ে দিয়েছে, সংক্রমণের মতো।

(৫)

ফুটবলের একটা মায়াকাজল থাকে। সেটা পরিয়ে দেবার লোকটাই হয়ত ফুটবল থেকে চলে যাবে এরপরে যে কোনো দিন। তার অলৌকিক ফুটবলজাদু, হয়ত আর মাত্র কয়েক বছরের জন্য। এই জাদুর বেলা ক্রমশ পড়ে আসছে। ক্রমশ সময়ের ছায়া লম্বা হচ্ছে, সময় পিঠ রাখছে মহাকালের দেওয়ালে, একটা ধূ ধূ শূন্যতাময় ফুটবল সন্ধ্যে নেমে আসার আগে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।