সমর বসু ও বিজন মিত্র উভয়েই সল্টলেকের করুণাময়ীতে থাকেন। উভয় পরিবারের মধ্যে নিয়মিত আসা-যাওয়া ওদের বন্ধুত্বকে জোরালো করেছে। সমরবাবুর মেয়ের বিয়েতে, বিজনবাবু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই একা হাতে করেছেন। কে যে কন্যাকর্তা, বরপক্ষের লোকজনের বোঝা দুষ্কর ছিল। অন্যদিকে বিজনবাবুর ছেলে কোথায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে, কোথায় ম্যানেজমেন্ট পড়বে, তা ঠিক করে দেবেন সমরবাবু। তাঁদের এই গভীর বন্ধুত্ব ছিল বাকি প্রতিবেশীদের মুখরোচক আলোচনার বিষয়।
এহেন বন্ধুত্বে একজন মূলত শ্রোতা। সমরবাবু নির্বিবাদী, মৃদুভাষী, বিচক্ষণ ও অমায়িক হওয়ায় বিজনবাবু তাঁকে অবিরত উপদেশ দেন। স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করার সাহস না থাকায়, মাঝে মাঝে তাঁকে স্ত্রৈণ বলে উপহাস করেন। কখন রাগ করতে হবে, কখন প্রতিবাদ করতে হবে, কীভাবে বৌকে চোখে চোখে পাহারা দিতে হবে, সে বিষয়ে সবিস্তারে সমরবাবুকে জ্ঞান বিতরণ করেন। অপরদিকে বিজনবাবুর সংসারে তাঁকে না জানিয়ে কিছু করার উপায় নেই। তাঁর স্ত্রী কবে ভ্রূ প্লাগ করবেন, কবে শ্যাম্পু করবেন, হেয়ারস্টাইল কী হবে, বাইরে বেরোলে কী রঙের শাড়ি পরবেন, এমনকী কোন চটিজুতো পরবেন সবই বিজনবাবু ঠিক করে দেন। স্ত্রীর নাড়িনক্ষত্র তাঁর জানা। বিয়ের পর থেকে এমনভাবেই স্ত্রীকে গড়েপিটে নিয়েছেন। মনে মনে যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন স্ত্রীকে হাতের তালুর মতো চেনেন বলে। আর অন্যদের করুণা করেন, বিশেষ করে সমরবাবুকে।
সম্প্রতি উভয়েই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অতএব এখন স্বাস্থ্যের দিকে নজর। এতদিনে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে। সমরবাবু দাঁত সিল করেন তো, বিজনবাবু দাঁত তোলেন। এইভাবে সমরবাবুর দুটি, বিজনবাবুর তিনটি দাঁত তোলা ও বাঁধানো হয়। ডাক্তারবাবুর ব্যবহার আন্তরিক ও ফিজ কম হওয়ার জন্য বিজনবাবু ঠিক করেন, স্ত্রী সত্যবতীর দাঁতগুলো একবার দেখিয়ে নেবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সত্যবতীর নিচের পাটির মাত্র দুটো দাঁত তুলতে ও বাঁধাতে হয়। খরচ সামান্যই হয়। খুশি হয়ে গদ-গদভাবে ডাক্তারবাবুকে বলেন, ভাগ্যিস সত্যবতীর ওপরের পাটির সব দাঁতগুলো ভালো, তাই বেশি খরচ হল না। ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে বলেন, ওপরের পাটির দাঁত তুলব কী করে? ওপরের পাটির দাঁত তো সব বাঁধানো।
বিজনবাবুর মাথায় বজ্রপাত হল। বিজনবাবু স্তব্ধ। মনে মনে ভাবেন, চল্লিশ বছর ধরে সত্যবতীর সঙ্গে ঘর করছি, এতদিন জানতেই পারলাম না যে, ওর ওপরের পাটির দাঁত বাঁধানো! এই আমি সত্যবতীকে চিনি, এই নিয়ে গর্ব! মাথায় হাত দিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়েন।
সমরবাবু বিজনবাবুকে সান্ত্বনা দেন, দুঃখ কোরো না, কষ্ট পেও না। শাস্ত্রে আছে জানো তো, ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যা’।