আমার দীর্ঘদিনের প্রাণের বন্ধু সুমনা সাহা।
সুমনা আমার ট্রেনের সহযাত্রী।
বনগাঁ লোকালে দীর্ঘ সময় আমরা একদঙ্গল বন্ধু সারা রাস্তা হৈচৈ করে, অফুরন্ত গল্প করতে করতে পাড়ি দিতাম।
সবাই প্রায় দূরের যাত্রী।
বিড়া স্টেশনে প্রথম নামত সুমনা আর বীণা। রাজীবপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি আর ইতিহাসের দিদিমণি।
রমা আসে অনেক পরে। ও আমাদের চেয়ে অনেক ছোট।
বীণা খুব শান্ত, ভদ্র, চুপচাপ। খুব কম কথা বলত। কথা বলত সুমনা। আমাদের চাইতে অনেক বেশি বিষয়ে ছিল ওর অগাধ পাণ্ডিত্য। খুব পড়ুয়া মেয়ে ছিল। গুণীও বটে। খুব ভালো আবৃত্তি করে। ভালো গান গায়। স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। আর সুবক্তা। যে কোনো ঘটনা যখন বর্ণনা করত তখন ছেদ, সেমিকোলন, কমা ইত্যাদি যতিচিহ্নগুলো ওর স্বরপ্রক্ষেপণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। সেই গল্প শুধু আমরা নয়, কামরাশুদ্ধ অজানা অচেনা যাত্রীরাও বেশ মনোযোগ সহকারে শুনতেন।
বনগাঁ লোকাল বললেই যে ভয়াবহ ভিড়ের চিত্র আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে, সে ভিড় আমরা পেতাম না। কারণ আমরা যেতাম স্রোতের বিপরীতে। সকাল দশটায় অফিসযাত্রীদের কলকাতায় আসতে হত ট্রেনে বাদুড়ঝোলা হয়ে, আবার বিকেলে যখন হাবড়া লোকালে ফিরতাম উল্টোডাঙায় নামব বলে তখন উল্টোদিকের বনগাঁমুখি ট্রেনগুলোতে ঠাসাঠাসি ভিড়। তাই আমরা সবাই মিলে বেশ বসার জায়গা নিয়ে আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরতাম।
প্রথম যখন পরিচয় হয় তখনো সুমনা, বীণার বিয়ে হয়নি। তারপর সুমনা-র বিয়ে হল, ছেলে হল। ছেলে মনোজের বয়স যখন সাত তখন একদিন খুব কিন্তু-কিন্তু করে, কয়েকবার ঢোঁক গিলে, আমতা আমতা করে সুমনা আমাদের জানাল, ও এখানকার চাকরি ছেড়ে, সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিউজিল্যান্ড চলে যাচ্ছে একেবারে পাকাপাকিভাবে।
আমরা তো সবাই আকাশ থেকে পড়লাম। কী? কেন? প্রশ্নবাণে একেবারে জর্জরিত, ধরাশায়ী করে ফেলা হল। সুমনা জবাব দেবে কী? কথা বলতে গেলেই দুচোখ বেয়ে জলের ধারা। নিজের দেশ ছেড়ে, স্থায়ী চাকরি ছেড়ে, দমদমে নিজেদের দোতলা বাড়ি ছেড়ে, বিশেষ করে বয়স্ক বাবা-মাকে ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আরামদায়ক নিজস্ব পরিমণ্ডল — সবকিছু বরাবরের মতো পেছনে ফেলে যাওয়া নির্বাসনে যাবার মতোই। সেখানকার সবকিছু অজানা। অচেনা। ভাষা আলাদা। চাকরি অনিশ্চিত। আবহাওয়া আমাদের দেশের মতো নয়। একটি গাছ উপড়ে নিয়ে নতুন মাটিতে রোপণ করলে সেই গাছ সেখানে শাখা-প্রশাখা প্রসারিত করে, শিকড় দিয়ে রসগ্রহণে সক্ষম হবে কিনা এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো থেকেই যায়।
সুমনার পতিদেবতা তপন সাহা আমাদেরও খুব ভালো বন্ধু। আমরা সমবয়সি। তাই বুঝতে পারলাম, তপন অনেক চিন্তাভাবনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটাতো ঠিক গড়ানে পাথরে শ্যাওলা জমে না। আমরা থাকব স্থবিরত্ব, জড়ত্বের কূপে। ফসিল হয়ে। ঠিক তাই হয়েছে। প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে যে চেয়ারটায় বসেছিলাম, চৌত্রিশ বছরের শিক্ষিকা জীবনযাপন করে সেই চেয়ার থেকেই অবসর নিয়েছি। না ছিল কোনো উচ্চাশা, না ছিল নিজেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা। দিনগত পাপক্ষয় তো সবার জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না।
আপন সন্তানকে দূষণমুক্ত একটি সুন্দর পৃথিবী দেওয়া, বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত করা, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, উচ্চমানের জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা সব বাবা-মায়ের কাম্য হওয়া উচিত। সুমনা-তপন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল সেদিন।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে সুমনা চলে গেল নিউজিল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা হতে আর আমরা বিয়োগ বেদনায় বেশ কিছুদিন ম্রিয়মাণ হয়ে রইলাম। তারপর সবাই নিজ নিজ অভিমত পেশ করতে লাগলেন। এই যাওয়াটা ঠিক হয়েছে না বেঠিক।
কূপমণ্ডূকেরা সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন! অত্যন্ত অবিবেচকের মতো কাজ হয়েছে।
উদারপন্থীরা উদাসভাবে মনে মনে ভাবলেন - ইস্, আমিও যদি পায়ের বেড়ি ছিন্ন করে এমনিভাবে যেতে পারতুম অচিনপুরের সোনার দেশে!
সমালোচনা একদিন শেষ হল।
সবাই নিজ নিজ কাজে মন দিল।
সুমনাকে তুলে রাখলাম বিস্মৃতির মলাট লাগানো খাতায়।
সুমনা কিন্তু আমাদের ভুলতে দিল না। দেশের প্রতি, দেশের প্রতিটি জিনিসের প্রতি ওর আকর্ষণ আরও গেল বেড়ে। দেশে বাস করে যে জিনিসটা আমরা দেখেও দেখি না, সুমনা ফোন করে জানতে চায় তার হালহকিকত। সবার সম্বন্ধে সমান ঔৎসুক্য।
আজ থেকে বাইশ বছর আগে বিদেশের ফোন এত সহজলভ্য ছিল না। আমাদের ল্যান্ডফোনে আইএসডি-র সুবিধে ছিল না। ফোন এলে কথা বলতে পারতাম। সুমনা ফোন করত। দেড় থেকে দুই ঘন্টার বেশিই হত কথোপকথন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করত। বিল উঠত হুহু করে। সুমনা ভ্রূক্ষেপও করত না। এইভাবেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখল ওর নিজের চেষ্টায়।
এবার আমি অবসর নিলাম। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে স্মার্ট হলাম। হোয়াটস্অ্যাপে বাক্যালাপ ফ্রি। আমার অখণ্ড অবসর। সময় অনন্ত।
যখনই দেখি সুমনা অনলাইন, আমিও ওকে রিং করি।
কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। সুমনা জানতে চায় দেশের খবর, আমি জিজ্ঞেস করি, এখন ওখানে তাপমাত্রা কত? চার ডিগ্রি? লেপ-কম্বল মুড়িসুড়ি দিয়ে শুয়ে আছিস? রান্না আছে? গরম গরম খিচুড়ি করেছে? কে? তপন রেঁধেছে? বা!বা! বেশ, বেশ। বাইরে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে? তুষারপাতের কথাও নিউজে বলেছে? ঘরে ফায়ারপ্লেস রয়েছে তাই আরাম পাচ্ছিস?
আচ্ছা, ছাড়ছি। ঘুমিয়ে পড়ো বন্ধু আমার। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সুখস্বপ্ন দেখো।
সুমনা যখনই ফোন করে তখনই বলে, তুমি এত বেড়াতে ভালোবাসো, শান্তনুদাকে নিয়ে চলে এসোনা আমাদের কাছে।
শুধু প্লেনে এসে এখানে ল্যান্ড করো, তারপর সব দায়িত্ব আমার। এখানে প্রচুর কিছু দেখার আছে। আমারও সবকিছু দেখা হয়ে ওঠা হয়নি। তোমরা এলে তোমাদের নিয়ে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখব।
গেলেই হয়। এমন মধুর প্রস্তাব দেয় কয়জনা? এতো সুবর্ণ সুযোগ। মন বলে, একে হেলা করিসনা। শরীর বলে, আজ নয়, কাল।
বাঙালির এই 'কাল' হল সবকালের কারণ।
আমি ইন্টারভিউ নেবার মতো করে অজস্র প্রশ্ন করে যাই। সুমনা সাধ্যমতো উত্তর দেয়। গতকাল রাতে আমি বলি - সুমনা, আজ রবিবার রাত ১১টা।
তোদের ওখানে কটা বাজে?
সুমনা উত্তর দেয়, আমাদের এখানে সোমবার। এখন সকাল সাড়ে ছ'টা। আমি বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পুব আকাশে সুয্যিমামা আড়মোড়া ভেঙে ওঠার চেষ্টা করছেন। পুবের আকাশ লালে লাল। রক্তিম আভায় চারিদিকে মোহময়ী সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ। এই অক্টোবরে আমরা তোমাদের চাইতে সাড়ে সাত ঘণ্টা এগিয়ে আছি। সূর্য আগে আমাদের আদর করবে তারপর তোমাদের। আজ তাপমাত্রা আট ডিগ্রি। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বের হয়েছি। শীতের পোশাক বেশি পরতে পারি না।
এপ্রিল মাসে আবার সময়ের ব্যবধান এক ঘন্টা কমে হবে সাড়ে ছ' ঘন্টা।
তপন সকাল ছ'টা পনেরোতে ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে কলেজে চলে গেছে। তপন কলেজের অধ্যাপক।
ছেলে মনোজও নামকরা এক কলেজের অধ্যাপক। সুমনা পড়ায় বাচ্চাদের স্কুলে। এখন ওরা খুব প্রতিষ্ঠিত। খুব সুখেই আছে। কিন্তু ওদেশে যাবার পর প্রথম তিনটি বছর খুব কষ্ট করতে হয়েছে।
প্রথমত ওদেশের ভাষা আয়ত্ত না করা পর্যন্ত ওখানে কোনো সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না। একটি বিদেশি ভাষা রপ্ত করা সহজসাধ্য নয়। তবে বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি ভিন্নভাষা আয়ত্ত করতে পারে। তাই ওর ছেলের খুব কষ্ট হয়নি যতটা সুমনা আর তপনের হয়েছে।
তারপর আবহাওয়া। কনকনে ঠান্ডা। সঙ্গে শনশন করে তীব্র হাওয়ার বেগ। মুষলধারায় লাগাতার সাতদিন দশদিন বৃষ্টি। তুষারপাতের কারণে বাইরে যাওয়ার কথা কল্পনাই করা যায় না।
আমি জিজ্ঞেস করি, তাহলে তোদের তো সবসময় সঙ্গে ছাতা রাখতে হয়।
সুমনা হাসে। বলে, এখানকার সব ছাতা আমাদের দেশের দাদুর ছাতা। কিন্তু এত হাওয়ায় ছাতা উল্টে যায়, শিক ভেঙে যায়। তাই আমরা সবাই উইন্ডচিটার জ্যাকেট পরি। শীতও আটকায়। বৃষ্টি থেকে আড়ালও করে।
(ক্রমশ)