কানাই জন্মান্ধ। খুব ছোট থেকেই ভিক্ষে করে। বান্ধবপুর স্টেশনে গেলে তার দেখা পাওয়া যায়। স্টেশনে যে গেট দিয়ে যাত্রীরা যাতায়াত করে, সেখানে কানাই একটা বড় বাটি নিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে ভিক্ষা চায়।
- বাবু, অন্ধকে দুটো পয়সা দাও, ভগবান তোমার মঙ্গল করবে।
বিজনবাবু রোজ বান্ধবপুর স্টেশন দিয়ে কলকাতা যান। ডালহৌসিতে বেসরকারি অফিসে কাজ করেন। তাই দু'বেলা তাঁর যাতায়াতের পথে কানাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। কানাই যতটা পারে হাত বাড়িয়ে পথ আগলে চিৎকার করে ভিক্ষা চায়। যাত্রীদের অসুবিধা হলেও মেনে নিয়েছে। বেচারি অন্ধ, কী আর করবে?
এখন কানাইয়ের বয়স প্রায় তিরিশ। সামনের বস্তিতে থাকে, বিয়েও করেছে। বিজনবাবু মনে মনে হাসেন। ভাবেন, দু’চোখে জীবনভর দেখে, একসঙ্গে সংসার করেও যখন নিজের স্ত্রীকে ঠিকমতো চিনে ওঠা যায় না, চোখ থেকেও যেখানে আমরা অন্ধ, তখন কানাইরা কোন ভরসায় বিয়ে করে!
এটাও ঠিক, বিজনবাবুর কানাইয়ের অন্ধত্ব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কোনোদিন যাওয়ার পথে অচল টাকা দিলে, ফেরার পথে কানাই বলে, বাবু সকালে যে টাকাটা দিয়েছিলেন, সেটা অচল। বিজনবাবু বলেন, তুই তো দেখতে পাস না, কী করে জানলি টাকাটা আমি দিয়েছি, আর ওটাই অচল। কানাই মুচকি হেসে বলে, ভগবান আমার চোখ নিয়েছে, আমার মন তো নেয়নি। সেই মন দিয়ে বুঝতে পারি, কোনটা ঠিক আর কোনটা অচল। যদিও বিজনবাবু কানাইয়ের এই যুক্তি মানতে চান না, তবু ভদ্রলোক হয়ে অন্যের অন্ধত্ব নিয়ে এর বেশি জেরা করা যায় না।
আজ কানাই দু’হাতে দুটো বড় বাটি নিয়ে, দু’দিকে যতটা পারে হাত ছড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে, স্টেশনে ঢোকার পথটা প্রায় বন্ধ। বিজনবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, পথটা একটু ছাড়। আজ দু’হাতে দুটো বাটি নিয়েছিস কেন? কানাই তার বত্রিশ পাটি দাঁতে বিগলিত হাসি ঝরিয়ে বলে, আপনাদের মা-বাবার আশীর্বাদে, আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে আমার ব্যাবসাটা ভালো চলছে। তাছাড়া গতকাল আমার একটা ছেলে হয়েছে, তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা ব্রাঞ্চ অফিস খুলেছি। শুনে বিজনবাবুর পিত্তি জ্বলে যায়। কী জানি কোন অজানা কারণে, হয়তবা কানাইয়ের ব্যাবসায় উৎসাহ জোগাতে, বিজনবাবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও কানাইয়ের নতুন ব্রাঞ্চ অফিসে একটা টাকা দিয়ে দ্রুতপায়ে ট্রেন ধরতে ছুটে যান।