।। ১ ।।
বলুন দেখি, কুরুক্ষেত্রের আঠারো দিনের মহাযুদ্ধের পুরোটা দেখেছেন কে কে?
জানি আপনারা অনেকে অনেকের নাম বলবেন। কৃষ্ণ, অর্জুন নাকি দুর্যোধন? না, এঁরা কেউ নন, যুদ্ধ করতে গিয়ে এঁরা বিভিন্ন সময়ে কুরুক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। নিজেরা নিজেদের যুদ্ধ নিয়ে এত বেশি মগ্ন ছিলেন, যে যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক কিছুই তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে। পুরোটা দেখা তাঁদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
কিন্তু তিন জন ছিলেন যাঁরা নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ না নিলেও, আঠারো দিন ধরে চলা এই মহাযুদ্ধের পুরোটা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আপনারা কি জানেন, তাঁরা কে কে? শুনুন তবে বলি।
প্রথমজন হলেন ভীমের নাতি, ঘটোৎকচ-পুত্র বারবারিক। যুদ্ধের প্রথমেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রকে পবিত্র করে তোলার জন্য কৃষ্ণের কাছে নিজের মস্তক দান করেন। কৃষ্ণ তাঁর ছিন্নমস্তক যুদ্ধক্ষেত্রের লাগোয়া পাহাড়ে স্থাপন করেন। সেখান থেকেই তিনি কুরুক্ষেত্রের পুরো যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেন। দ্বিতীয় জন হলেন হনুমান, রামায়ণের সহনায়ক। তিনি অর্জুনের রথের পতাকায় বসে এই মহাযুদ্ধের সম্পূর্ণটা দেখেছিলেন। আর তৃতীয় জন হলেন সঞ্জয়।
- সঞ্জয়! তিনি আবার কে? তাঁর কথা তো শুনিনি।
আসুন তবে, আজ এই সঞ্জয়ের গল্পই শুনবো আমরা।
* * * *
ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ, আপনারা সবাই জানেন। কিন্তু তবুও তিনি যখন যুবক হলেন, অস্ত্র-শস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠলেন। ভীষ্ম ও অন্য সব গুরুজন মিলে ঠিক করলেন, ধৃতরাষ্ট্রের জন্য যোগ্য একজন সারথি দরকার। যোগ্য সারথি নির্বাচনের জন্য দিনও ঠিক হল একটা। অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হল সেখানে। সবাইকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভীষ্ম শেষে নির্বাচিত করলেন সঞ্জয়কে। সত্যি বলতে কী রথের ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী তিনি। বংশপরম্পরায় তাঁরা রথ চালানোর কাজ করে আসছেন। পিতা গবল্গনও ছিলেন দক্ষ রথচালক। পিতার সাথে থেকে, দেখে দেখে ছোট থেকেই তিনি রথ চালনার ব্যাপারে রীতিমতো পারদর্শী। অন্যদিকে মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়, অতি সজ্জন আর সহৃদয়। বন্ধুর মতো সবদিক দেখাশোনা তো করতেনই, প্রভুর ভালোর জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা ছিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের যষ্টি-স্বরূপ, সর্বক্ষণের সঙ্গী। ধৃতরাষ্ট্র যখনই বিপদে পড়েছেন, প্রথমেই তিনি সঞ্জয়ের শরণাপন্ন হয়েছেন। এরকমই দু-একটি ঘটনার কথা এবারে বলি।
পাশা খেলায় পরাজিত হয়ে পঞ্চপাণ্ডবেরা বনবাসে গেলেন। গোটা রাজ্যেই যেন শোকের আবহ। রাজসভায় বসে ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। পাণ্ডবদেরও তো ছোট থেকেই তিনি দেখছেন, তাদের প্রতি বেশ স্নেহপ্রবণও ছিলেন। এত বছর বনে বনে ঘুরে বেড়ালে তাদের তো বেশ কষ্টই হবে! বিষন্ন চিত্তে এসবই ভাবছিলেন তিনি। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন বিদুর। ধৃতরাষ্ট্রকে বললেনঃ
- মহারাজ, এ আপনি ঠিক কাজ করলেন না। পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠাবার জন্য সমগ্র রাজ্য দুঃখে নিমজ্জিত। চারিদিকে বিভিন্ন রকম কু-লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রাজ্যের অমঙ্গল হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আপনি এক্ষুণি লোক পাঠিয়ে আবার পাণ্ডবদের ফিরিয়ে নিয়ে আসুন, তাতে রাজ্যের মঙ্গলই হবে।
- তা কী করে সম্ভব! মানছি পাণ্ডবরাও আমার পুত্রসম। কিন্তু দুর্যোধন তো আমার নিজের শরীর থেকে উৎপন্ন। তাকে কীভাবে উপেক্ষা করতে পারি? পাণ্ডবদের এখন আবার ফিরিয়ে আনলে দুর্যোধনরা কি তা মেনে নেবে?
- পুত্রস্নেহে আপনি অন্ধ, তাই বুঝতে পারছেন না। যুধিষ্ঠিরাদির এই চোখের জল আপনার বা আপনার রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। এখনো সময় আছে। মহারাজ, আপনি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিন যাতে সবাই মিলেমিশে একসাথে থাকতে পারে।
- আমি আর কী করতে পারি! আর বললেই সবাই আমার কথা শুনবেই বা কেন?
- আপনি বুঝিয়ে বললে সবাই ঠিক মেনে নেবে। আর তাছাড়া পাণ্ডবদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে না পারলে কৌরবরাও যে খুব শান্তিতে থাকবে এমন তো মনে হচ্ছে না!
বারবার এসব শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র এবারে রেগেই গেলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে বললেনঃ
- তুমি এখানে আমারই আশ্রয়ে আছো। কিন্তু তোমার মন-প্রাণ পড়ে রয়েছে পাণ্ডবদের সাথে। মনে হচ্ছে তাদের প্রতি তুমি অতিমাত্রায় দুর্বল। এতই যদি দরদ, যাও না! তাদের কাছেই থাকো গিয়ে। রাজ্যসুখ ছেড়ে বনবাসের কঠিন জীবন কেমন লাগে, একবার না হয় দেখেই এসো!
এমন অপমানের পরে বিদুর আর কী করেন, মনের দুঃখে তিনিও চললেন বনে। পাণ্ডবদের দেখা পেলেন তিনি কাম্যক বনে। বিদুরকে পাণ্ডবরা পাঁচভাই বেশ সমীহের চোখেই দেখতেন। যুধিষ্ঠির পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে তাঁর যথোপযুক্ত বন্দনা করলেন। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাজ্যের সব কিছু জেনে নিলেন বিদুরের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্য গুরুজনদের সম্বন্ধেও জানলেন তিনি। সব শুনতে শুনতে তিনি কেঁদেই ফেললেন।
এদিকে ধৃতরাষ্ট্রের চোখে ঘুম নেই। বিদুরকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার পরে সর্বদাই অনুশোচনায় ভুগছেন তিনি। কিন্তু কীভাবে আবার ফেরানো যায়, পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষে শরণাপন্ন হলেন সেই সঞ্জয়ের। অনুরোধ করলেনঃ
- যাও তো সঞ্জয়, বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেভাবে পারো বিদুরকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। বিদুরের সঙ্গ ছাড়া আমি বুঝি আর বাঁচব না। যতই হোক, নিজের ভাই তো! তাকে ছাড়া সব কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। বিপদে-আপদে বিদুরের ওপর আমার বড় ভরসা।
সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে শেষে কাম্যক বনে গিয়ে বিদুরকে অনেক অনুনয় বিনয় করলেন, আবার হস্তিনাপুর রাজ্যে ফিরে আসার জন্য। তিনি তো কিছুতেই রাজি নন। শেষে ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক দুরবস্থার কথা জানিয়ে বিদুরকে অনেক কষ্টে রাজি করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের মনোকষ্টের কথা শুনে যুধিষ্ঠির নিজেও অবশ্য এ ব্যাপারে সঞ্জয়কে খানিক সহায়তা করলেন।
তারপর অনেক ঘটনার ঘনঘটার শেষে বারো বছরের বনবাস আর একবছরের অজ্ঞাতবাস শেষ করে পাণ্ডবরা আবার রাজ্যে ফিরে এলেন। এসেই দাবি করলেন তাঁদের রাজ্যের প্রাপ্য অংশ। দুর্যোধন শুনেই তো হুংকার দিলেন, "বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচ্যগ্র মেদিনী।" ধৃতরাষ্ট্র সহ অন্য সব গুরুজনদের পরামর্শ কানেই নিলেন না তিনি।
শেষে পাণ্ডবরা, পাঁচ ভাইয়ের জন্য শুধুমাত্র পাঁচটি গ্রামই দাবি করল। এই পাঁচটি গ্রাম পেলেই তাঁরা খুশি, রাজ্যের বাকি অংশ নিয়ে কৌরবরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। এই দাবীতেও কৌরবরা কর্ণপাতই করল না। অবশেষে ঘটনা পরম্পরায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল যুদ্ধ। দু'পক্ষই এবারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সৈন্য সংগ্রহ করতে। যোদ্ধারা একে একে এ-পক্ষে ও-পক্ষে গিয়ে দলভারি করতে শুরু করলেন। কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করায় ধৃতরাষ্ট্র বুঝি খানিক ভয়ও পেলেন। যুদ্ধের ঠিক আগে বিভিন্ন জনের চাপে ধৃতরাষ্ট্র আবারো শরণাপন্ন হলেন সেই সঞ্জয়ের। শেষ মুহূর্তে অনেক আশা নিয়ে পাঠালেন তাঁকে সমঝোতার উদ্দেশ্যে পাণ্ডব শিবিরে।
।। ২ ।।
খানিকটা বাধ্য হয়েই সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের শান্তির বার্তা নিয়ে এলেন পাণ্ডব শিবিরে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুধিষ্ঠির তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলেও, বাকি পাণ্ডবরা এমনকি কৃষ্ণও তাঁর সাথে খানিক দুর্ব্যবহারই করলেন। অনেক রুঢ় কথাও শুনতে হল তাঁকে। পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণের কাছে রীতিমতো প্রত্যাখ্যাত হয়ে, ব্যর্থ-মনোরথে ফিরে এলেন সঞ্জয়। এসেই সব জানালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। চূড়ান্ত হতাশায় বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
যুদ্ধের ঠিক আগের দিন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এলেন ব্যাসদেব। কুশল সংবাদ নেবার পরে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে ধর্মযুদ্ধ সম্বন্ধে অনেক উপদেশ দিলেন। তারপর বললেনঃ
- এই যুদ্ধে তো দুপক্ষই তোমার অতি আপন। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তুমি কি নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছা করো? যদি চাও, তবে তোমাকে আমি দিব্যদৃষ্টি দান করব। যার প্রভাবে তুমি এখানে বসেই যুদ্ধক্ষেত্রের সব কিছু দেখতে পাবে।
- না না, আমি নিজে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখতে চাই না। অতি নিকট-জনের বিনাশ নিজের চোখে দেখে সহ্য করতে পারব না। কিন্তু নিজের ছেলেরা লড়াই করবে, তাদের কখন কী হল সেসব জানতে তো বড় ইচ্ছে করেই!
- শোনো, তাহলে তোমার সারথি, সর্বক্ষণের সঙ্গী সঞ্জয়কে আমি দিব্যদৃষ্টি দান করছি। সে এখানে বসেই গোটা কুরুক্ষেত্র দর্শন করতে পারবে। আর তুমি যখন যা জানতে চাইবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু তোমাকে জানাবে।
ধৃতরাষ্ট্র কাছে ডাকলেন সঞ্জয়কে। তিনি তো সব শুনে খুব খুশি! ব্যাসদেবের বরে সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টি লাভ করলেন। তিনি ছিলেন একদম নিরপেক্ষ মতের অনুসারী। আঠারো দিন ধরে চলা এই মহাযুদ্ধের খুঁটিনাটি সব তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে নির্মোহভাবে বর্ণনা করেছিলেন। কোন অতিরঞ্জন বা কোন কিছুই গোপন রাখেননি। সেসব শুনে ধৃতরাষ্ট্র কখনো উৎফুল্ল, কখনো বা গম্ভীর, আবার কখনো গভীর বিষাদে ডুবে যেতেন।
ব্যাসদেবের বরে দিব্যদৃষ্টি লাভ করে সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রে দিনে বা রাতে যা কিছু ঘটছে, সব দেখতে পেতেন। এমনকি কোথাও গোপনে কিছু শলা-পরামর্শ হলে তাও বুঝতে পারতেন। কোন মহারথী কী সব নতুন নতুন পরিকল্পনা করছেন, সেসবও তিনি বুঝতে পারতেন। আর সবকিছুই ধৃতরাষ্ট্রকে জানাতেন অকপটে। এইভাবেই ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ঘরে বসেই যুদ্ধের সব খবরাখবর সাথে সাথেই জানতে পারতেন।
প্রকাশ্য রাজসভায় সবার সামনে কৌরব ভাইয়েরা যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করার চেষ্টা করেছিল, ক্রুদ্ধ ভীম সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেনঃ
- দুর্যোধন, দুঃশাসন সহ একশো কৌরব ভাইকে আমি নিজের হাতে সংহার করব। দ্রৌপদীর এই অপমানের বদলা না নিতে পারলে মনে করব আমার মনুষ্যজন্মই বৃথা!
যুদ্ধের চাকা গড়াতে না গড়াতেই কৌরব ভাইয়েরা একে একে ভীমের হাতে মারা পড়তে শুরু করল। সঞ্জয়ের পক্ষে এই খবরটি ধৃতরাষ্ট্রকে জানানো ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। পুত্রশোক, সে যে বড়ই কঠিন আর নির্মম! এক একজন করে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ শুনে ধৃতরাষ্ট্র যেন শোকে পাথর হয়ে যেতেন। শুধু তাঁর চোখ দুটি ছল-ছল করে উঠতো। মাঝে মাঝে বলতেন, এসবের জন্য তিনিই বুঝি দায়ী! খানিক অনুতাপও যে হতো না তা নয়। ইচ্ছে করলে কি এই যুদ্ধ তিনি আটকাতে পারতেন না?
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো যেদিন বিকর্ণের মৃত্যু হল। বিকর্ণ কৌরব ভাইদের মধ্যে একেবারেই একটু অন্যরকম ছিলেন। তাঁর মন ছিল অনেক নরম আর সহানুভূতিশীল। অন্য ভাইদের মতো দুর্যোধনের সব কাজ তিনি অবলীলায় সমর্থন করতেন না। তিনিই একমাত্র কৌরব ভাই, যিনি দ্রৌপদীকে প্রকাশ্য সভায় হেনস্থার প্রতিবাদ করেছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রও তাঁকে একটু বাড়তি স্নেহের বন্ধনেই বেঁধেছিলেন। তিনিও যখন ভীমের আক্রোশের শিকার হলেন, ধৃতরাষ্ট্র আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। ভীমও পরে আক্ষেপ করেছিলেন, যে বিকর্ণকে মারতে তিনিও বেশ মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছিলেন। নেহাত আগে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলেন যে, সব কৌরব ভাইদের তিনি একার হাতেই সংহার করবেন। তাই একাজ করতে এক রকম বাধ্যই হয়েছিলেন তিনি।
তারপর এলো যুদ্ধের অষ্টাদশ তথা শেষ দিন। যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা করতে করতে হঠাৎ সঞ্জয় থেমে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র উন্মুখঃ
- তারপর? সঞ্জয়, তারপর কি হলো?
সঞ্জয়ের দিক থেকে কোন সাড়া নেই। ধৃতরাষ্ট্র আরও বেশি উদগ্রীবঃ
- সঞ্জয়, কিছু বলছো না কেন? কী দেখতে পাচ্ছ আমাকে বলো।
- মহারাজ, অশ্বত্থামার বিলাপের করুন সুর অনেক দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে!
- কেন, আবার কী হলো? অশ্বত্থামার এমন করুণ বিলাপের কারণ কী? তাড়াতাড়ি বলো আমাকে।
এই একবারই বলতে গিয়ে সঞ্জয়ের গলা ধরে এলো, বাকরুদ্ধ হলেন তিনি। এই বৃদ্ধ অন্ধরাজাকে তাঁর শেষতম পুত্রের মৃত্যু সংবাদ দিতে গিয়ে তিনিও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হায়রে অদৃষ্ট! হায় ক্ষমতার দম্ভ! দুর্যোধনের মৃত্যু সংবাদ শুনে ধৃতরাষ্ট্র মূর্ছিত হলেন। সঞ্জয় তাড়াতাড়ি তাঁর চোখে-মুখে জল দিয়ে খানিক শুশ্রূষা করলেন। জ্ঞান ফিরলো তাঁর, কিন্তু তিনিও কোনো কথা বলতে পারলেন না। একেই কি বলে, শোকে পাথর হয়ে যাওয়া? এই একবারই সঞ্জয়ের মনে হয়েছিলঃ
- কোন প্রয়োজন নেই আমার এই দিব্যদৃষ্টির। এ আমার কাছে আশীর্বাদ নয়, যেন এক অভিশাপ!
একথা বলার সাথে সাথেই তাঁর দিব্যদৃষ্টি অন্তর্হিত হলো। চোখে যেন অন্ধকার দেখলেন তিনি।
।। ৩ ।।
আঠারো দিন ধরে চলা কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ। পাণ্ডব পক্ষ জয়ী হয়ে রাজ্য পেল। যুধিষ্ঠির বসলেন রাজ-সিংহাসনে। ব্যাসদেবের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞ সফল করে যুধিষ্ঠির ভূ-ভারতের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। রাজ্যে রীতিমত সুখ-শান্তি বিরাজমান, প্রজারাও বেশ খুশি। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, বিদুর আর কুন্তী বৃদ্ধ হয়েছেন। প্রাথমিক শোক সামলে তাঁরা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। যুধিষ্ঠিরও তাঁদের সব রকমের দেখভাল করেন, তাঁদের পরামর্শ মেনে চলেন। তবুও তাঁরা একদিন ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, রাজকীয় সুখের আশ্রয় ছেড়ে এবার বানপ্রস্থে যাবেন। বাকি জীবনটা ধ্যান, তপস্যা আর ধর্মচিন্তা করেই কাটাতে চান তাঁরা। যুধিষ্ঠির বাধা দেবার অনেক ব্যর্থ চেষ্টা করলেন কিন্তু তাঁদের একান্ত অনুরোধে শেষে তিনিও আর আপত্তি করতে পারলেন না। সবার কাছে বিদায় নিয়ে চারজন যখন বনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, উপস্থিত হলেন সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্রের একান্ত অনুগত সঞ্জয় এখানেও তাঁকে সঙ্গ দিতে চাইলেন। বললেনঃ
- আমিও আপনাদের সাথেই বনে যাব, মহারাজ।
- না না, সে কী করে হয়? আর তোমার বয়সই বা কত? এখনো তোমার বাণপ্রস্থে যাবার সময় হয়নি।
- আপনার সাথেই আমার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে যাবেন, আমিও আপনার সাথেই থাকবো। মহামতি ভীষ্ম আমাকে এমনই আদেশ করে গিয়েছেন।
কারো কোন আপত্তিই শুনলেন না তিনি। তারপর সবার কাছে বিদায় নিয়ে পাঁচজন মিলে যাত্রা করলেন অনিশ্চিতের উদ্দেশে। পঞ্চপাণ্ডবসহ অনেক অনুগত প্রজাও বহুদূর পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে বন-গমন করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে শেষে তাঁরা নিরস্ত হলেন, অত্যন্ত দুঃখিত মনে আবার ফিরে এলেন রাজ্যে। যুধিষ্ঠির বিলাপ করতে লাগলেনঃ
- আত্মীয়-পরিজনবিহীন হয়ে গুরুজনদের ত্যাগ করে এভাবে রাজ্যশাসনে আমার কোনো ইচ্ছে নেই।
ব্যাসদেবই তাঁকে অনেক প্রবোধ দিয়ে, অনেক সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করলেন।
বনে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই দীর্ঘ উপবাসের ফলে তপস্যারত অবস্থায় বিদুরের মৃত্যু হল। বাকি চারজন গঙ্গা-তীরবর্তী স্থানে এখানে-ওখানে কয়েকদিন থাকার পরে একদিন সবাই নদীর ধারের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে আরো দূরে যাচ্ছিলেন। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎই যেন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল আগুন, দাবানল! একেবারে দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠলো সে আগুন। দ্রুত তাদের দিকেই যেন এগিয়ে আসছে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র অসহায়ের মতো বলে উঠলেনঃ
- আমাদের তো ছুটে পালাবারও ক্ষমতা নেই। অগ্নিদেব বুঝি বা আমাদের মুক্তির জন্যই আবির্ভূত হয়েছেন। সঞ্জয়, তুমি দ্রুত পালাও এখান থেকে। নিজেকে অন্তত বাঁচাও।
- না না মহারাজ, সে হয় না। স্বার্থপরের মতো আপনাদের ছেড়ে আমি কিছুতেই যেতে পারবো না। সে বড় অকৃতজ্ঞতা হবে। যা হবার সবার একসাথেই হোক। আমি কোথাও যাচ্ছি না।
- আহঃ, তুমি বুঝছো না কেন, তুমি বেঁচে গেলে অন্তত যুধিষ্ঠিরের কাছে আমাদের মৃত্যুর খবরটা তো পৌঁছে দিতে পারবে! নইলে হয়তো আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়াও হবে না। তাড়াতাড়ি যাও। আমাদের সবার ভালোর জন্যই তোমাকে পালাতে হবে।
অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে বাধ্য হলেন সঞ্জয়। সেই দাবানলেই পুড়ে মরলেন ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, আর কুন্তি। সঞ্জয় অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রাজসভায় পৌঁছে যুধিষ্ঠিরকে খবরটি দিলেন। যুধিষ্ঠির এমন দুঃসংবাদ শুনে বাকরুদ্ধ হলেন। মনে হল তিনি বুঝি মূর্ছাই যাবেন! সারা রাজ্যও শোকস্তব্ধ হলো। অন্য পাণ্ডবরাও অত্যন্ত দুঃখ পেলেন। কিন্তু ভবিতব্য! কিছু তো করার নেই, মেনে নিতেই হবে। ভারাক্রান্ত মনেই যথাযোগ্য মর্যাদায় সবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হল।
সঞ্জয় এবারে সবার অনুমতি নিয়ে রওনা দিলেন হিমালয়ের উদ্দেশে। কারো বাধাই তিনি মানলেন না। জীবনের প্রতি তাঁর আর কোন আকর্ষণই অবশিষ্ট নেই। সেই যে গেলেন, তারপর তাঁর আর কোনো খবর কখনোই পাওয়া যায়নি।
স্কেচঃ রাজর্ষি দত্তরায়।