ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

রূপকথার দেশ নিউজিল্যান্ড (পর্ব ২-৪)



সবিতা বিশ্বাস


পর্ব - ২

আমি সুমনাকে প্রশ্ন করি, এই যে তোরা সব সময় বাড়ি বদল করিস, এক জায়গার বসতি উঠিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাস, এতে অসুবিধে বোধ করিস না? আমরা তো পিতৃ-পিতামহের তৈরি করা বাড়িতে বংশানুক্রমিকভাবে বসবাস করতে অভ্যস্ত। নিজের পাড়া ছাড়া সবই বেপাড়া।

সুমনা কিছুক্ষণ চুপ করে প্রশ্নটা অনুধাবন করার চেষ্টা করে।

হয়ত মনে মনে উত্তরটি গুছিয়ে নেয়। বলে, আসলে কী জানো তো, এখানে জায়গা-জমি কিনে বাড়ি করার প্রথা বিশেষ চালু নেই। আর সেটি খুব ব্যয়সাপেক্ষ। এখানে সব বাড়ি ক্রমাগতভাবে হাত বদল হয়। এদেশে যখন আমরা এলাম, তখন সঙ্গতি কম। খুব কম টাকায় একটি ছোট বাড়ি কিনলাম। তাতেই আমাদের বেশ চলে যাচ্ছিল। তারপর ছেলে বড় হল। তার নিজস্ব ঘর চাই। তপন সারাদিন ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করে। আলাদা একটি ঘরের প্রয়োজন। তত-দিনে হাতেও কিছু টাকা সঞ্চয় হয়েছে। এবার একটি বড় বাড়ি কিনলাম। আমরা এখন এখানকার রাজধানী শহর ওয়েলিংটনে আছি। নিউজিল্যান্ড দেশটাই ছোট-বড় নানা রকম আগ্নেয়গিরির ওপর রয়েছে। যে কোনো সময় বিশাল বড় ভূমিকম্প হতে পারে। আর ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা বলে এখানকার বাড়িঘর সব কাঠ দিয়ে তৈরি। মেঝে তো সব সময় কাঠের হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় নোনা হাওয়ায় খুব সহজেই কাঠগুলো ক্ষয়ে যায়। তাই মাঝে মাঝেই বাড়ির সব কাঠ পাল্টাতে হয়। নতুন বাড়ি কিনে সবাই কাঠ পাল্টে, একটু আধটু ভাঙচুর করে নিজের মনের মতো করে তৈরি করে নেয়।

কিছুদিন পর হয়ত চাকরি সূত্রে ভিন্ন শহরে চলে গেল। তখন এই বাড়িটি বিক্রি করে আবার নতুন শহরে নতুন বাড়ি কিনে বসবাস করতে শুরু করে। কোনো কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরে এরা বাঁচে না। সবসময় নতুনের সন্ধানে, ভালো, ভালো, আরও ভালো। জিনিসপত্রের প্রতি কোন মোহ নেই। জীবনের প্রতিও বোধহয় কম।

নইলে সব সময় দুঃসাহসিক, রোমাঞ্চকর জীবনযাপন বেছে নিত না।

আমি জানতে চাই, মনোজ অবসর সময়ে কী করতে ভালোবাসে?

- ও বাবা, মনা তো ছুটির দিন হলেই বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রে যায় মাছ ধরতে। মাছ ধরা, ছবি তোলা ওর নেশা। শুধুমাত্র নিজের ছবি তুলতে চায় না। সমুদ্রের ধারে রোদ পোহাতে আসা সীলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। গল্প করে। সীল কিন্তু মানুষকে দেখে এতটুকু ভয় পায় না। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষের খুব কাছে চলে আসে আর ভাবে, বোধ হয় এরা পৃথিবীর কোনো আজব প্রাণী। ভিন গ্রহের কোনো জীব নয়তো।

এই দেশে জীবজন্তু, পশুপাখি এমনকি গাছেদেরও খুব খাতির যত্ন করে। একটি গাছ কাটতে হলে আগে দুইটি গাছ লাগাতে হবে। তারপর বৃক্ষছেদন। আগে রোপণ তারপর ছেদন।

সুমনার কথা শুনি আর নিজের দেশের সঙ্গে তুলনা করি। লজ্জিত হই। দুঃখিত হই।

একদিন সুমনা আমাকে ফোন করে উত্তেজিত স্বরে বলে, গতকাল কী ঘটনা ঘটেছে তোমাকে বলি। একটি বিশেষ কাজে আমি আর তপন যাচ্ছি। তপন গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাচ্ছি। হঠাৎ তপন গাড়িটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী হল বলে সামনে উঁকি দিয়ে দেখি, অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। কারণটা জানতে বেশি দেরি হল না।

কী ব্যাপার?

এখানকার গাড়ির বড় রাস্তার দুই পাশে দুইটি বিশাল বড় লেক রয়েছে। এবার এক মা-হাঁসের হঠাৎ শখ হয়েছে, পাড়া বেড়ানোর মতো করে এই লেক থেকে রাস্তার বিপরীত দিকের লেকে যাবেন। ছোট ছোট ছয় ছানাপোনা নিয়ে চললেন পাশের লেকে। হঠাৎ মা-মরালী রাস্তার ঠিক মাঝখানে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

ওদেশের নিয়ম পশুপাখি অসুস্থ হয়ে পড়লে গাড়ি নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যাবে না। গাড়ি থামিয়ে, গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে অসুস্থ পশু বা পাখিটির সেবাযত্ন শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তুলতে হবে এবং সে সুস্থ সবল সতেজ হলে তবে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার ছাড়পত্র মিলবে।

এসব শুনলে মনে হয় না, আমরা জীবজন্তুরও অধম!

যাই হোক, সবাই গাড়ি থেকে নেমে হংসীমাতা কোথাও আঘাত পেয়েছেন কিনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হল। নাঃ! কোথাও এতটুকু আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেল না। তাকে জলের বোতল থেকে জল খেতে দেওয়া হল। মাতাজি জলপানে অনাগ্রহী। এদিকে ছয় ছানাপোনা প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে ধীরে সুস্থে হেলে দুলে এপার থেকে ওপারের লেকে যেতে লাগল।

গাড়িওয়ালারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত - কীভাবে হাঁস-মাতাকে সুস্থ করা যায়। বৃদ্ধা মাতা আই সি ইউ-তে থাকলে বয়স্ক সন্তানেরা যেমনভাবে উদ্বিগ্ন হয় তেমনটাই আর কী।

এদিকে মরালী-মাতা অজ্ঞান হবার ভান করে মাঝরাস্তায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছেন আর তির্যক নয়নে খেয়াল রাখছেন ছানাপোনা নিরাপদে রাস্তা পার হল কিনা। যখন দেখলেন সব কটি পার হয়ে গেছে, তখন ধীরে সুস্থে আড়মোড়া ভেঙে যেন হঠাৎই জ্ঞান ফিরে এসেছে এই ভঙ্গিতে হেলতে দুলতে গন্তব্য লেকের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

কোট-প্যান্ট-টাই পরিধায়ী মানুষগুলো কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন।

বুঝলেন মা-হাঁস কত বড় অভিনেত্রী। এতগুলো মানুষকে বোকা বানানো সোজা কথা!

পাছে কোনো ছুটন্ত গাড়ি সন্তানদের চাপা দিয়ে দেয়, তাই তাদের নিরাপদে রাস্তা পার হতে দেবার জন্য তার এই অসুস্থতার অভিনয়।

মানুষ যে কত খারাপ হতে পারে, সেই ঘটনা তারা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে গল্প শুনে জেনেছে। সিদ্ধার্থ আর তার ভাই দেবদত্তের গল্প শুনিয়ে গেছেন পূর্বপুরুষ দাদামশাই, ঠামি, দিদারা। সেই থেকে হাঁসেরা জানে সিদ্ধার্থ আজ অতীত। রাজত্ব কায়েম রয়েছে দেবদত্তদের। দেবদত্তদের বিশ্বাস? নৈব নৈব চ।

তাই প্রয়োজন এই অভিনয়ের।

পর্ব - ৩

পাহাড়, নদী, সমুদ্র, প্রচুর লেক, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ বনানী, অজস্র ফলের বাগান, ফুলের প্রাচুর্য , অসংখ্য জলপ্রপাত নিয়ে নিউজিল্যান্ড সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

এখানকার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অতুলনীয় আকর্ষণীয় রূপ উপভোগ করার জন্য সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন।

এখানকার লোক সংখ্যা খুবই কম। শপিং মল, রাস্তার ধারের ক্যাফেটোরিয়া ছাড়া রাস্তাঘাট মোটামুটি জনবিরল। রাস্তায় গেলে দেখা যায়, শুধু মাঝে মধ্যে হুঁশ করে পাশ দিয়ে গাড়ি চলে গেল।

প্রায় সবার বাড়ির লাগোয়া জমিতে ফলভারে অবনত গাছ। প্রচুর আপেল গাছ তলায় পড়ে থাকে। আমাদের দেশে যেমন কুল গাছের তলায় কুল পড়ে থাকত। তফাতটা হল কুল গাছের তলায় বাচ্চাদের আনাগোনা লেগেই থাকত। কুল পাকার অবকাশ পেত না। কাঁচা আমের মতো করে কাঁচা কুল, বিট নুন, ধনেপাতা কুচি, লঙ্কা কুচি দিয়ে মেখে খায়নি, আমাদের সমসাময়িকদের মধ্যে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়ায় নিষেধ জারি করেও আমাদের নিরস্ত করা যেত না। আর এদেশের মানুষ এত এত রাশি রাশি ফল গাছ তলায় পড়ে থাকতে দেখে ও দৃকপাত করে না।

এখানকার বাসিন্দারা অসম্ভব পরিশ্রমী আর পরিচ্ছন্ন। আমাদের মতো তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরপুর নয়। কারো কোনো সহায়তার হাত, গণেশের মা, লক্ষ্মীর বাপ নেই বলে সকলেই দশভুজা। সুমনা বলে, আমাদের বাড়িতে যে আগে ঢোকে, সেই রান্না করতে শুরু করে দেয়। কখনো এসে দেখে, ছেলে সব রান্না করে রেখেছে, কখনো বা তপন। আমি বলি, বাপ রে। আমাদের এখানে এই সিস্টেম চালু থাকলে তোর শান্তনুদা তো কোনো রিস্ক না নিয়ে নিশুতি রাতে ঘরে ঢুকত।

হা হা করে হাসি দুই বান্ধবী।

এখানকার লোকজন ভালো রান্না করে, অতিথি এলে কফি দিয়ে আপ্যায়ন করে। নানা রকম খাবারদাবার রেঁধে খাওয়াতে ভালবাসে। বাগানের পরিচর্যা করে। লোকের উপকার করার জন্য মুখিয়ে থাকে। প্রতিবেশী কারো বাড়ির বেড়া ভেঙে গেছে। বলতেও হবে না। কেউ না কেউ এসে ঠিক তার ভাঙাচোরা বেড়া ঠিকঠাক সুন্দর করে দিয়ে যাবে। আমি বলি, বেশি না, এমন দু-একজন মানুষকে পাঠা না রে আমার বাড়িতে। আমার বড় প্রয়োজন।

ওখানকার মানুষজনের জীবজন্তুর ওপর ভীষণ মায়া-দয়া। নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য প্রায় সবার বাড়িতেই পোষা কুকুর, বেড়াল, পাখি আছে। তারা তো পোষ্যজনের খুবই যত্ন করে। তাও যদি কারো কুকুর বা বেড়াল কোনো কারণে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে তাহলে মালিককে তলব করে জবাবদিহি চাওয়া হয় কেন, তার পোষ্যটি বাইরে চলে গেছে। ঠিক মতো দেখভাল করা হচ্ছে না বোধহয়। পোষ্য জীবদের নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হয়।

ডায়েট চার্ট অনুসরণ করে খাবারদাবার খাইয়ে দিতে হয়। পার্লারে নিয়ে গিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করাতে হবে। নিয়মিত নখ কাটতে হবে। তাদের আলাদা আলাদাভাবে ক্রিম, নানা ধরনের লোশন ব্যবহার করতে হবে। শীতের জায়গা বলে ওখানকার বেড়াল, কুকুর খুব লোমশ প্রকৃতির হয়। সুমনা বলে, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। আদর করাও হয়। অজানা অচেনা ব্যক্তিও যে কোনো কুকুর বা বেড়াল দেখলে আদর করে দেন।

এত তাদের পশুপ্রেম।

সুমনার খুব ঘনিষ্ঠ উপকারী বন্ধু জুডি। সুমনার চাইতে অনেক বড় বলে সুমনাকে উনি সন্তানতুল্য ভাবেন। জুডির কুকুরের নাম চিকো। সাধারণত দেখা যায়, পোষা বিড়াল, কুকুররা বড়দের চাইতে ছোট বাচ্চাদের বেশি ভালোবাসে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে এরা শিশুর সারল্য, পবিত্রতা, নির্মল ভালোবাসা বোধ হয় অনুভব করতে পারে।

চিকো সবসময় সুমনার বাড়িতে এসে মনোজের ঘরের সামনে চুপ করে বসে থাকত। মনোজ তখন ক্লাস সেভেন কী এইটের ছাত্র। চিকো তখন প্রায় বৃদ্ধ। চোখে ছানি পড়েছে। আর্থারাইটিসে পেছনের পা দুটো তুলতে পারত না। সুমনাদের বাড়িতে ঢুকতে হলে দুটি উঁচু ধাপ পেরোতে হত। ওই ধাপ দুটো পেরোতে গিয়ে চিকো কিছুতেই পেছনের পা দুটো তুলতে পারত না। তাই মনোজ যখনই টের পেত চিকো এসেছে, অমনি ছুট্টে গিয়ে কোলে করে চিকোকে ঘরে নিয়ে আসত।

জুডি যখন দিন পনেরো-কুড়ির জন্য বাইরে কোথাও বেড়াতে যেত, তখন সুমনার কাছে চিকোকে রেখে যেত। জুডি চিকোর খাবার, ওষুধপত্র সব বুঝিয়ে দিয়ে যেত। বিকেলে চিকোকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে যেতে হত। কোনো কোনো দিন সুমনা সময় না পেলে অন্য কোনো প্রতিবেশী এসে ঠিক চিকোকে পার্কে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে আনতেন। অর্থাৎ কোনোভাবেই চিকোর নিত্যকার রুটিন চেঞ্জ করা যাবে না।

এরপর জুডি চলে এসে চিকোকে নিতে এলে চিকো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে, জিভ দিয়ে চেটে জুডিকে অস্থির করে তুলত। কথা বলতে না পারলেও, হাবেভাবে মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারত। সামনের দুই পা উঁচু করে ও যখন জুডির গালের নাগাল পেত না তখন ইশারায় বোঝাত, নিচু হও। অমনি জুডি নিচু হলেই গাল দুটো চেটে চেটে ভিজিয়ে দিত। যেন বলত, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? জানো, তোমার জন্য আমার কত কষ্ট হয়েছে! অবলা পশুর না বলা কথাগুলো বুঝে নিয়ে জুডি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, আর তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না সোনা। প্রমিস।

সুমনা বলে - বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, চিকো একবারও পেছনে না তাকিয়ে গটগট করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে জুডির পেছন পেছন চলে যেত। তখন আমার ভারি কষ্ট হত। এত দিন ধরে লালনপালন করলে ভীষণ মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে হয়।

আমি বলি, সুমনা, হাঁসের গল্প শুনলাম, কুকুরের গল্প শুনলাম। এবার বেড়ালের গল্প বল। বেড়াল আমার আর পুপেসোনার ভীষণ প্রিয়।

সুমনার বাঙালি বন্ধু রুণু। রুণুর পোষা বেড়ালের নাম টুসি। টুসির জন্য আলাদা দুধ আসে। ক্যালসিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার আসে। ভারি আদুরে। ভীষণ রকমের মিষ্টি। যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ধবধবে সাদা অভিজাত চেহারা, তেমনি তার গাম্ভীর্যপূর্ণ চলাফেরা। বাড়িতে অতিথি অভ্যাগত এলে সে তখন লাজুক। পর্দানশীন। কিছুতেই সামনে আসবে না। গৃহস্বামিনী চাইতেন, তার টুসিকে সবাই দেখুক, আদর করুক। কিন্তু টুসি তখন ভেজা বেড়াল।

টুসি খুব শিক্ষিতও বটে। টুসি যখন ম্যাও বলত, তখন শুনতে লাগত মা। মানুষের সব কথা যেমন বুঝতে পারত, তেমনি নিজের মনের কথাও সবাইকে বুঝিয়ে দিত। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির সবাই একসাথে যখন টিভি দেখতে বসতেন, তখন বাড়ির একজন মেম্বার হিসেবে টুসিও একখানা সোফা দখল করে বসত।

একদিন টিভিতে একটি মেয়ে গান গাইছে। বিজ্ঞের মতো টুসিও গান শুনছে। হঠাৎ করে উঠে গিয়ে টুসি একবার টিভির দিকে তাকিয়ে টিভির পেছনে চলে গেল। ভাবছিল, নিশ্চয়ই টিভির পেছনে বসে কেউ গান গাইছে।

টুসির এই কান্ড দেখে সবাই যখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, তখন টুসি খুব বিরক্তির সাথে সবার দিকে রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। এই যাওয়ার সময় সে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে, হেসে তাকে অপমান করা হয়েছে।

টুসি তরমুজ খেতে খুব ভালোবাসত। ওর জন্য বেছে বেছে সুস্বাদু মিষ্টি তরমুজ আনা হত।

সুমনা বলে, এখানকার লোকজন এত ভালো আর স্নেহপ্রবণ ভাবা যায় না। প্রথম ওদেশে গিয়ে কারোকে চিনতাম না। জানতাম না। ভাষার দূরত্ব। ধর্ম আলাদা। ওখানকার লোকাচার, সহবত, আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তখন প্রতিবেশীরাই এগিয়ে এসে আলাপ পরিচয় করে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। নতুবা কীভাবে যে এখানকার সব জিনিস আয়ত্ত করতাম জানি না। খুব ভালো লাগছে, তুমি এদের সবাইকে নিয়ে লিখছ। আমার অনেক কিছু বলার আছে এদের জন্য। সামনাসামনি মুখে বলে তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় না। তোমার লেখার মধ্য দিয়েই প্রকাশ করব আমার কৃতজ্ঞতা। একদিন যারা আমার অসময়ে পাশে থেকে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছেন, তাদের উদ্দেশে এটাই হবে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জানি তাঁরা অচেনা ভাষার কারণে এই লেখাটি পড়তে পারবেন না। কিন্তু আমি তো মনে সান্ত্বনা পাবো যে আমি অকৃতজ্ঞ নই। সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে পেরেছি। ঋণ স্বীকার করেছি। সবাইকে পরিচিত করেছি আমার আপন বৃত্তে। এতেই আমি খুশি।

কথা আমার। লেখনী তোমার।

পর্ব - ৪

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে, জলবায়ুর দাক্ষিণ্যে, প্রকৃতি-রাণির উজাড় করা সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণে একটি দেশ নয়ন লোভন হয়ে উঠে। সৌন্দর্যের পূজারী মানুষ সুন্দরকে সমাদর করে। কিন্তু পহেলে দর্শণদারী হলেও দেখার পর তার গুণ বিচার করা হয়। যেমন মানুষের ক্ষেত্রে তেমনটাই দেশেরও ক্ষেত্রে।

নিউজিল্যান্ডের মানুষেরা এত সৎ যে, সেখানে চুরি-ডাকাতির কোনো ঘটনাই ঘটে না। শহর এলাকায় ভিন লোকজন এসে যাওয়ায় দরজা খুলে রেখে বাইরে যাবার সাহস কেউ দেখায় না বটে, তবে শহরতলির গ্রাম্য পরিবেশে এখনও মানুষ দরজা-জানালা খোলা রেখেই শপিং মলে যায়, বেড়াতে যায়। তালাচাবির ব্যাপারটাই নেই। শুনে তাজ্জব। বলিস কীরে? এতো শুনেছি রামচন্দ্রের সময়ে হতো। যাকে বলে রামরাজত্ব। আর ইতিহাস পড়তে গিয়ে গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন? তখন পড়েছি মানুষজন দরজা-জানালা খোলা রেখে ঘুমাত। রাস্তায় সোনা পড়ে থাকলেও কেউ ছুঁয়েও দেখত না। তাহলে তোরা তো রামরাজত্বে বাস করছিস রে! আমার তো শুনে কেমন অলীক বলে মনে হচ্ছে।

সুমনা বলে, শুধুমাত্র সৎ নয় গো। এরা যে কতটা পরোপকারী, তার গল্প শোনো।

সুমনারা সদ্য গেছে ওদেশে। কারোকে চেনে না, জানে না, গাড়ি নেই। গাড়ি ছাড়া ওদেশে থাকা খুব কষ্টকর।

তপন মার্কেটে গেছে। মার্কেট অনেক দূরে। উঁচু টিলার উপর ওদের বাসস্থান। অনেকখানি নেমে, অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে তারপর বাস পাওয়া যায়। মার্কেটে গিয়ে তপন দেখে, সেদিন ওখানে আলু, পেঁয়াজ, সব্জির ওপর বেশ ভালো রকম ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছে। সেই আনন্দে তপন দশ কেজি আলু, দশ কেজি পেঁয়াজ আর প্রচুর পরিমাণে সব্জি কিনেছে।

ফেরার পথে নির্দিষ্ট জায়গায় বাস তো নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এবার ওই পরিমাণ জিনিস পিঠের ব্যাগে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন উঁচু টিলার ওপর উঠবে, তখন পাশে একটি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ছোট্ট খাটো এক ব্রিটিশ রমণী। ঠিক যেন এক বিদেশী পুতুল। সোনালি চুল। নীল চোখ। নীল নয়না জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন? উনি বললেন, উঠে আসুন। সেই বলার মধ্যে এমন একটা আত্মীয়তার সুর ছিল যে, মনে একটু দ্বিধা সংকোচ থাকলেও তপন উঠে বাঁচল। ঘাড় তো টনটন করছে। ওই প্রবল শীতের হাওয়ায়ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মহিয়সী নারী বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে সব জিনিসপত্র নামাতে সাহায্য করে যাবার সময় তাঁর একটি কার্ড দিয়ে পরে ফোন করতে বললেন।

যথারীতি সেই কার্ড তপন হারিয়েও ফেলল।

হঠাৎ করে এক দিন ক্যাফেটোরিয়াতে কফি খেতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল ওই ভদ্রমহিলার সাথে। আলাপ-পরিচয় হল। উনি খুব কাছেই থাকেন। উনি বললেন, তোমার যখনই কোথাও যাবার প্রয়োজন হবে, তুমি আমাকে বিনা দ্বিধায় ফোন করবে। আমি গাড়ি করে তোমাকে পৌঁছে দেব।

এরপর সুমনা গাড়ি কিনল। ড্রাইভিং শেখার স্কুলে ভর্তি হল। এথেনা — এই সুন্দরী ভদ্রমহিলা সুমনাকে বললেন, স্কুলগুলোতে ভালো করে শেখা যায় না। আমি রাতেরবেলায় তোমাকে নিয়ে বের হব। তখন রাস্তা ফাঁকা থাকে। ভালোভাবে শেখা যায়। এথেনার সহায়তায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সুমনা নিপুণ হাতে গাড়ি চালানো শিখে নিল।

ওদেশে প্রচুর পরিমাণে জমি নিয়ে বাড়ি। আমাদের কাঠার হিসেবে নয়, বিঘা দিয়ে বলা হয় বাড়ির সীমানা। প্রতিটি বাড়ির সামনে সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো লন।

নানা ধরনের নানা বর্ণের ফুলবাগিচা।

বাড়ির পেছনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ফলের বাগান। সুইমিং পুল। টেনিস কোর্ট। খেলার মাঠ।

আমার বাড়ি। আমি যেমন খুশি তেমন করে বাড়ি রাখব, ওখানে সেটি হবার জো নেই। বাধ্যতামূলকভাবে নিয়মিত ঘাস ছাটতে হবে। বাগানের পরিচর্যা করতে হবে। জল সিঞ্চন করে গাছকে সতেজ সুন্দর করে রাখতে হবে।

সুমনাদের তখনো ঘাস কাটার মেশিন কেনা হয়নি।

এথেনা নিজের ঘাস কাটার মেশিন নিয়ে এসে যত্ন করে ঘাস ছেঁটে, বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুমনাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, বাগান কেমন রাখতে হবে। কীভাবে তার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।

এথেনা ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে ক্রিম, রুজ, লিপস্টিক ব্যবহার করে সেজেগুজে ফিটফাট। যেন এক্ষুনি কোথাও বেড়াতে যাবেন। ওইভাবেই ঘরের সব কাজ করবেন।

আমরা তো বাড়িতে থাকি যৎপরোনাস্তি কুৎসিততম পোশাক পরে। বাইরে যাবার সময় রূপটানে রূপান্তরিত হই পরি-হুরিতে। ঘরোয়া সুমনাকে ঘরোয়া পোশাকে দেখে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, নিশ্চয়ই দেশ ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে এদেশে আসার ফলে ওর খুব মন খারাপ। তাই এমন মলিন মুখ। মলিন বেশবাস।

একদিন লিপস্টিক, আই লাইনার, সানস্ক্রিন লোশন নিয়ে এসে বললেন, সব সময় সেজেগুজে হাসিখুশি হয়ে থাকলে মন ভালো থাকে। তুমি সেজেগুজে আমার সঙ্গে পার্কে চলো।

সাদাসিধে সালোয়ার কামিজ পরা এক বিনুনি করা সুমনা এই প্রথম রুজ ব্যবহার করে গণ্ডদেশ রক্তিম করে ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় করে মড মেমসাহেবাতে রূপান্তরিত হল। প্রথম দর্শনে তপন নাকি পাক্কা পাঁচ মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। পাঁচ মিনিট পর সম্বিত ফিরতে হাঁ মুখখানি বন্ধ হয়।

সেই শুরু। প্রতিদিন বিকেলে পার্কে যেতেই হবে। তাও আবার এই সব রংচং মেখে। সং সেজে। সাজতে না চাইলে উনি আবার খুব দুঃখিত হতেন। কী জ্বালা!

কারোকে দুঃখ দেওয়া কি উচিত? তাই সাজতেই হয়।

সুমনার কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন আমি একটু ভদ্রসম্মত পোশাকে সামান্য সেজে হল ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম। শান্তনু বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে আমাকে দেখে বললেন, কোথাও যাবে?

বলি, না তো।

- তাহলে কি কোথাও গিয়েছিলে?

- নাঃ।

- তাহলে?

- কী তাহলে?

- এই যে সাজগোজ করে বসে আছ? কারোর আসার কথা আছে?

- না। কারোর আসার কথা নেই। আমি তোমার জন্যই সেজেছি।

- যাঃ। তাই আবার হয় নাকি? নতুন অবস্থাতেই সাজোনি। আর এখন তো...

- কী এখন? অসমাপিকা ক্রিয়াকে সমাপিকা ক্রিয়া করো। এখন পড়ন্ত বেলা ? তাই বলবে তো? ঘাট হয়েছে সেজে। এক্ষুনি ঘরের রাজবেশ পরে আসছি।

- আহ্! রাগের কী হলো? কোনোদিন এমনটা দেখিনি তো। তাই বলছিলাম।

এথেনা চাকরি করে। স্টেনোগ্রাফার।

এক ছুটির দিনে ফোন করে বলে, দুপুরে তোমাকে নিয়ে বের হব। রেডি হয়ে থেকো।

কোথায়, কী বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করার নেই। যেখানেই হোক, যেতে হবেই।

এথেনা নিয়ে এলেন কারাগারে। কয়েদিদের বাইবেল পড়ে শোনালেন। অনেক ধর্মীয় উপদেশ দিলেন। তাদের বাড়িতে কে কে আছে, এমন সব গল্প করে তাদের কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দান করলেন।

সুমনাকে কোনোদিন নিয়ে যেতেন বৃদ্ধাশ্রমে। তাদের ও বাইবেল পড়ে শোনাতেন। ছোট ছোট উপহার দিতেন। উলের সোয়েটার, টুপি, মোজা দিতেন। সব নিজের হাতে বোনা। বৃদ্ধাদের গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। গাল দুটো টিপে আদর করতেন। খিলখিল করে হেসে সেই আদর মানুষগুলো খুব উপভোগ করতেন। ঠিক যেন মাকে করা মেয়ের আদর।

মাঝে মাঝেই যেতেন বলে এথেনা এদের পূর্ব পরিচিত।এথেনা গেলেই একটা আনন্দের লহরি বয়ে যেত। সুমনাকে দেখে কত কৌতূহল। ইন্ডিয়া? সেটা কোথায়? ও, গাণ্ডীর দেশ। গাণ্ডীর নাম তারা শুনেছেন। রবীন্দ্রনাথ টেগোরকেও কারো কারো জানা আছে।

একদিন এথেনার গাড়ি ভর্তি ফুল। জানালেন, আজ তিনি যাবেন হসপিটালে। পেশেন্টদের ফুল দেবেন। গল্প শোনাবেন। তাদের মনোবল যাতে বাড়ে সে চেষ্টা করবেন। এথেনাকে দেখে তারা সবাই মিলে কী ভীষণ খুশি। এক বৃদ্ধ তার হাত দুটো ধরে বললেন, আমি রোজ রোজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তুমি এলে আমি বাইবেল শুনব। তোমার গলায় শুনতে খুব ভালো লাগে আমার। এরপর এত দেরি করে আসবে না। খুব তাড়াতাড়ি আসবে।

অফিস থেকে ফিরে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে এথেনা বড় একটা ভ্যান চালিয়ে আসতেন। এই দিনটি তিনি রেখেছেন শপিং মলে যাবার জন্য। অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অশক্ত হবার কারণে শপিং করতে যেতে পারেন না। এথেনা তাঁদের একত্রিত করে শপিং মলে নিয়ে যান। সময় দেন তিন ঘণ্টা। এর মধ্যে তাঁরা আশ মিটিয়ে শপিং করেন। সম্পূর্ণ ফ্রি সার্ভিস বলে সবাই খুব পুলকিত। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় হয়।

এথেনা এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। কফি খায়। মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সাহায্য করে। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে সবাইকে একত্রিত করে আবার ফিরতি পথে নামাতে নামাতে আসে। সবাই আন্তরিক ভালবাসা জানায়। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে চলন্ত ভ্যানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, আবার আগামী সপ্তাহের অপেক্ষা।

(ক্রমশ)