গল্প ও অণুগল্প

অতসী কি ফিরে এলো...



পল্লব রায়


ব‍্যানার্জী বাড়ির সকাল এমনিতে একটু দেরী করেই শুরু হয় তার উপরে আজকে আবার রবিবার। কাগজ আর দুধওয়ালারা তাদের সময় মতোই কাগজ আর দুধ বাড়ির দরজার সামনে রেখে দিয়ে গেছে। বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙে কাজের মাসি মোক্ষদার চেঁচামেচিতে। তিন ভাইয়ের যৌথ সংসারে চারজন কাজের লোকের মধ্যে মোক্ষদা মাসিই সবার প্রথমে এ বাড়িতে কাজে আসে। মোক্ষদার চিৎকারে সবার আগে বড়বৌ নলিনী বাড়ির নীচের বৈঠকখানায় নেমে আসে।

- ‘কি হয়েছে মোক্ষদা, সাত সকালে এত হাঁকডাক পাড়ছ কেন?’

বালিগঞ্জ অঞ্চলের অভিজাত এলাকায় এই ব‍্যানার্জী বাড়ি, চার পুরুষের বনেদি বড়লোক এই ব‍্যানার্জিরা। পারিবারিক যৌথ ব‍্যবসা সামলায় তিন ভাই রমনীনাথ, অবনীনাথ আর ছোট ভাই জানকিনাথ। এছাড়াও তিন ভাইয়েরই আলাদা করে নিজস্ব ব‍্যবসা আছে। এদের বাবা নলিনাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই পারিবারিক ব‍্যবসা সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছায়। এখন ওঁনার তিন ছেলে মিলেই উন্নতির সেই ধারাটা ধরে রেখেছে। নলিনাক্ষের জীবনের পঁচাশিটি বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে তাও বছর দুই-তিনেক হয়ে গেল, তবে উনি এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ আছেন। সুযোগ্য পুত্রদের হাতে ব‍্যবসার ভার সঁপে দিয়ে স্ত্রী রমলাবালা আর নাতি নাতনিদের‌ নিয়ে অবসর জীবনযাপন করছেন। অবশ্য রমলাবালা সাম্প্রতিককালে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন শয‍্যাগতই আছেন। বাড়ির সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব বড়বউ নলিনীর ওপর। রমনীনাথ আর নলিনীর এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে চাকরি সূত্রে লণ্ডনে বসবাস করে আর মেয়ে পড়াশোনা করতে ব‍্যাঙ্গালোরে থাকে। নলিনীর বাপের বাড়ি বিশাল বিত্তশালী, একদম যোগ্য ঘরেই বিবাহ হয়েছিল ওঁর, আজ থেকে তাও প্রায় বছর তিরিশ আগে। তাই নলিনী বরাবরই বেশ অহংকারী।

ছোট বউ চন্দ্রিমার বাপের বাড়িও ধনী, কিন্তু নলিনীর মতো নয়। চন্দ্রিমার বাবা ছিলেন ডেপুটি ম‍্যাজিস্ট্রেট। খুবই শিক্ষিত পরিবার, দাদারা সবাই প্রফেসর। এই নিয়ে চন্দ্রিমার মনে একটা চাপা গর্ব ছিল। জানকিনাথ আর চন্দ্রিমার দুই ছেলে। ছোটটি ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, পড়াশোনায় বেশ ভালো। কিন্তু বড় ছেলেকে নিয়েই ওদের যত চিন্তা, জন্ম থেকেই ও মানসিক প্রতিবন্ধী। চন্দ্রিমার অহংকার আর গর্ব তাই কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে যায় এই একটা কারণে। জানকিনাথ ব‍্যবসার কারণে ঠিক মতো সময় না পেলেও চন্দ্রিমা কিন্তু তার বড় ছেলেকে সর্বদা একদম আগলে রাখে।

এ বাড়িতে যদি কেউ বেমানান থেকে থাকে সে হলো অতসী, বাড়ির মেজবউ। অবনীনাথ আর অতসীর একটি কন্যা, কলকাতারই এক কলেজের ছাত্রী। অতসী যে কি করে এ বাড়ির বউ হয়ে এলো তা এ বাড়ির কারোরই ঠিক করে বোধগম্য হয় না এবং এই নিয়ে এককালে বাড়ির অন্দরমহলে বিভিন্ন মুখরোচক গল্প শোনা যেত। খুবই সামান্য নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অতসী। যৌবনে অসামান‍্য রূপসী ছিল অতসী, ঠিক তার মায়ের মতো। বাবা কেদারমোহন ভট্টাচার্য্য এই ব‍্যানার্জী বাড়িরই কুলপুরোহিত ছিলেন। মা আর মেয়ের অমন রূপ কেদার ভট্টাচার্যের বাড়িতে সত্যিই খুব বেমানান ছিল। নলিনাক্ষবাবু ঐ রূপ দেখেই মেজ ছেলের বউ করে অতসীকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আভিজাত্য আর অর্থের শিখরে থাকা ব‍্যানার্জী বাড়ির উপযুক্ত করে নিজের মেয়েকে বৌ করে পাঠানোর সামর্থ্য কেদারমোহনের ছিল না। প্রায় এক কাপড়েই বিদায় করেছিলেন মেয়েকে, আর অলঙ্কার তো দূর অস্ত। অবশ্য নলিনাক্ষবাবু মেজবৌমাকে নিজ উদ্যোগেই যথাপোযুক্ত আভরণে সজ্জিতা করেই ঘরে তুলেছিলেন। নলিনাক্ষের সহধর্মিনী রমলাবালা কিন্তু ব‍্যাপারটাকে একদমই ভালোভাবে নেননি। এই নিয়ে বিস্তর অশান্তির সূচনা হয়েছিল ব‍্যানার্জী পরিবারে। নলিনাক্ষের সাথে কেদারমোহনের সুন্দরী স্ত্রীর একটা অন্যরকম সম্পর্কের খবর যা ডালপালা ছড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, সে খবর বহির্জগৎ থেকে ব‍্যানার্জী বাড়ির অন্দরমহলে অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিল‌‌। নলিনাক্ষ যে তার ভুল কাজের মাশুল দেওয়ার জন্যেই অতসীকে এ বাড়ির বৌ করে নিয়ে এসেছিল, এই ধারনাটা রমলাবালার মনে তীব্রভাবে গেঁথে গিয়েছিল। তবে এই খবরে সত‍্যতার কোনও উপযুক্ত প্রমাণ কেউ কোনদিনই পায়নি বা নলিনাক্ষের স্ত্রীও তার স্বামীকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। তার ফলস্বরূপ রমলাবালার সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়েছিল অতসীর ওপর আর তাতে উপর্যুপরি উপযুক্ত ইন্ধন জুগিয়ে গেছিল বড় বৌ নলিনী। এক দরিদ্র ঘরের মেয়ের শুধুমাত্র রূপের যোগ‍্যতায় রাজরানি হওয়ার অপরাধের ফল প্রতিটি মুহূর্তে অতসীকে ভুগতে হয়েছিল।

অতসীর শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব উচ্চমার্গের না হলেও একদম ফেলে দেওয়ার মতোও ছিলনা। কলেজের গণ্ডি সে সসন্মানেই পেরিয়েছিল। বংশ নিয়ে অহংকার করার মতো অবস্থা অতসীর বাপের বাড়ি ছিলনা, আর রূপ নিয়ে অহংকার করার মতো মেয়ে অতসী নয়। ঐ ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বিয়ের পর এই বৃহৎ পরিসরে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধার মধ্যেই পড়েছিল ও। ব‍্যানার্জী বাড়ির মতো বনেদি সম্ভ্রান্ত পরিবারের আদব কায়দার সাথে মানিয়ে নিতে প্রতি পদেই হোঁচট খেতে হচ্ছিল অতসীকে। সাথে ছিল শাশুড়ির গঞ্জনা, অবশ্য এই ধরনের পরিবারে শাশুড়ির গঞ্জনা আর পাঁচটা সাধারণ মধ‍্যবিত্ত পরিবারের মতো নয়। অতীত নিয়ে, অতসীর মায়ের সাথে নিজের স্বামীর তথাকথিত সম্পর্ক নিয়ে নয়, অতসী যে এই পরিবারের একেবারেই বেমানান তা নিয়ে প্রতিপদেই বিভিন্নভাবে অতসীকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছেন। ঐ ব‍্যাপারে স্বামীকে কিছু বলত না পারার জ্বালাটা এইভাবেই অতসীর উপরে মেটানোর চেষ্টা করে গেছেন। আর এতে রমলাবালার সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে গেছে অতসীর রূপের প্রতি ঈর্ষাকাতর বড়বৌমা নলিনী। বিয়ের পর থেকেই অতসীর বাপের বাড়ি যাওয়ার প্রতি একটা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছিল রমলাবালা। কেদারমোহন যখন পূজা করতে আসতেন তখন দূর থেকেই বাবা ও মেয়ের দৃষ্টি বিনিময় হতো, সামনা-সামনি দুজনের কোন দিনও কথা বলার উপায় হয়নি। ফলে বিয়ের পর থেকে দীর্ঘদিন অবধি মাকে দেখতে পায়নি অতসী। কিছুকাল পরে কোনও অজ্ঞাত কারণে কেদারমোহনের জন্য এই বাড়ির দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেয়ে কিছুটা বড় হওয়ার পর কখনও কখনও মেয়ের স্কুলে যাওয়ার বা মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার পথে লুকিয়ে লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসত অতসী। এ ব‍্যাপারে কোনওদিন স্বামী অবনীনাথের সমর্থন পায়নি অতসী। এই পরিবারের প্রত‍্যেক পুরুষই সাংসারিক ব‍্যাপারে বড্ড বেশি নিস্পৃহ ছিল, ব‍্যবসা ছাড়া সাংসারিক কোনও ব‍্যাপারেই এরা মাথা গলাত না। আর অবনীনাথ এদের মধ্যে একটু বেশিই নিস্পৃহ ছিল, বিশেষ করে স্ত্রী অতসীর প্রতি। প্রতি বছরে যেমন শীতের পর গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মের পর বর্ষা এসে ঋতুর পরিবর্তন হয়, যেমন করে নদীতে জল প্রবাহিত হয়, ঠিক তেমন করেই অতসী আর অবনীনাথের বৈবাহিক জীবন বয়ে চলেছিল। হিমবাহের মতন কোনও দিন শক্ত হয়ে জমাট বাঁধেনি। মেয়েকে নিয়ে অনেক আশা ছিল অতসীর, ভেবেছিল নিজের মনের মতো করে খুব সাধারণভাবেই মেয়েকে বড় করে তুলবে। এই পরিবারের বৈভব আর দম্ভের ছায়া মেয়ের ওপর পড়তে দেবেনা। কিন্তু মেয়ে একটু বড় হতেই এই বাড়ির ধারা পায়, মনের মধ্যে সবসময় অহংকার আর দাম্ভিকতা দিয়ে মানুষকে হেয় করার চেষ্টা। এমনকি জেঠিমার তালে তাল মিলিয়ে মা'কেও হেয় প্রতিপন্ন করতে সে ছাড়তো না। কলেজে ভর্তি হয়েই বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড়, আড্ডা আর টাকা ওড়ানোর প্রতিযোগীতায় মেতে ওঠে। অনেক আশা নিয়ে যে চারাগাছকে অনেক যত্নে বড় করে সুমিষ্ট ফলের বৃক্ষ করতে চেয়েছিল অতসী, তা কার্যতঃ ওকে হতাশ করে এক কন্টকময় বিষবৃক্ষে পরিণত হয়।

মোক্ষদার হাঁকডাক শুনে প্রায় ঘুম চোখেই উপর থেকে নীচে নেমে এসে কারণ জানতে চায় নলিনী।

- "আমি কাজে এসি দ্যাখলাম তোমাগো বাড়ির সদর দুয়ার বাইরের থেকি বন্ধ, আমি ঠেলা মারতেই খুলি গেল। তোমরা কি রেতে দুয়ার দিয়ে শোউনি নাকি?"

অবাক হয় নলিনী - "যতদূর মনে পড়ছে কাল রাতে বিথীর মা'কে শোওয়ার আগে দরজায় তালা দিতে বলেছিলাম, তবে কি ও...?"

বিথীর মা এই বাড়িতে সবসময় থাকে রমলাবালাকে দেখাশোনা করার জন্য। নলিনী হাঁক পেড়ে বিথীর মা'কে ডাকে। কিন্তু বিথীর মা'র কাছ থেকে যখন জানতে পারে যে কাল রাতে দরজায় তালা দেওয়া হয়েছিল তখন একটা ব‍্যাপারে নিশ্চিন্ত হয় যে এ বাড়িতে কাল রাতে চোরের আগমন ঘটেনি।

- "কিন্তু তাহলে দরজাটা খুললো কে? ভোর ভোর কি কেউ বাড়ি ছেড়ে কাউকে না বলে বেরিয়ে গেছে? কে বের হলো?"

ব‍্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তোলে নলিনীকে। ইতিমধ্যে ছোট বৌ চন্দ্রিমা জটলা শুনে দোতলা থেকে নীচে নেমে আসে।

- "কি হয়েছে দিদিভাই, এত চেঁচামেচি কিসের?"

- "আর বলিস না ছোট, মোক্ষদা কাজে এসে দেখছে বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। আমি ভাবছিলাম কাল রাতে বন্ধ করা হয়নি, কিন্তু তা নয়, আজ ভোরেই কেউ বাইরে গেছে কাউকে কিছু না বলে। একবার দেখতো গিয়ে ছেলে-মেয়েরা কেউ বাইরে গেল কিনা।"

-"না গো দিদিভাই, আমার ছেলেরা তো ঘরেই ঘুমোচ্ছে। মেজদিকে জিজ্ঞেস করে দেখি ওর মেয়ে বেরিয়েছে কিনা।"

- "আরে বাবা বের হবি বের হ, কিন্তু কাউকে তো দরজাটা বন্ধ করতে বলে যাবি, হ্যাঁ তুই মেজোকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ। যেমন মা তেমনই তার মেয়ে।"

কিছু সময় পরেই চন্দ্রিমা নীচে এসে জানায় যে অতসী ওর ঘরে নেই। কখন বের হয়েছে বা কোথায় গেছে সে ব‍্যাপারে ওর মেয়ে বা অবনীনাথ কেউই আলোকপাত করতে পারে না। চন্দ্রিমার কাছে সব শুনে ভ্রুকুটি করে তীর্যক স্বরে মন্তব্য করে নলিনী

- "এত সকালে কাউকে কিছু না বলে মেজো আবার কোন অভিসারে গেল?"

অনেক দিন পর অতসীকে এবার প‍্যাঁচে ফেলা যাবে, এই ভেবেই খুশি হয় নলিনী।

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা, বাড়ির সকলেই একতলার বৈঠকখানায় জমায়েত করেছে। খানিক আগেই জলখাবারের পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেছে। বাড়ির ছোটদের খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল, অতসীর জন্যে অপেক্ষা করে বড়দেরও বেশ দেরীই হয়ে গেল। অতসী এখনও না ফেরাতে একে একে বাড়ির সকলের মনেই চিন্তা আর সন্দেহের মেঘ জমতে শুরু করে। নলিনী কিন্তু মনে মনে খুশিই হয় আর অতসীকে সবার কাছে আরও ছোট প্রতিপন্ন করার পরিকল্পনা করতে থাকে।

- "এত বেলা হয়ে গেল, মেজবৌমা এখনও ফিরল না। সেই কোন সকালে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কোথায় গেছে, কি হয়েছে কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।" রমনীনাথের গলায় চিন্তার সুর।

জানকিনাথ বরাবরই বেশ কাঠখোট্টা, যাকে যা বলে সরাসরিই বলে - "মেজবৌদি কিন্ত এটা ঠিক করেনি, একে তো বাড়ির কাউকে না বলেই সকালে দরজা খোলা রেখেই বেরিয়ে গেছে, তার উপরে এখনও ফিরল না। বের হওয়ার সময় বাড়ির নিরাপত্তার কথাটা একবারও ভাবলো না?"

ছোটকাকার সাথে তাল মিলিয়ে এবার অতসীর মেয়েও মা'কে ঠুকতে ছাড়ে না

- "মা কি যে করে, আমাদের সবার সন্মান নিয়ে টানাটানি।" মেয়ের মুখে মায়ের সম্বন্ধে শুনে অবনীনাথ অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নলিনী অনেক্ষণ ধরেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল

- "দেখ গিয়ে কারোও সাথে কোথায় দেখা দেখা করতে গেছেন।" বড় দেওরের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে।

- "মেজদি এই বয়সে? উফফফ পারেও বটে বাবা!" সুযোগ পেয়ে চন্দ্রিমাও ছাড়েনা। সভার মধ‍্যমণি নলিনাক্ষ এতক্ষণ ধরে চুপ করেই ছিলেন। নলিনীই অসুস্থ শাশুড়ির পাশ থেকে শ্বশুরমশাইকে নিচে নিয়ে এসেছে যাতে ওঁনার কানে অতসীর সম্বন্ধে সব অকথা কুকথা ঢালা যায়।

- " সব না জেনে কারোর সম্বন্ধে কি সব বাজে কথা বলছ তোমরা! আগে অতসীকে আসতে দাও, সব জানো ওর কাছ থেকে। ততক্ষণ না হয় চুপ করে থাকো।" এতক্ষণে নীরবতা ভাঙেন নলিনাক্ষ।

অবনীনাথ অতসীর সম্পর্কে সবার মুখ থেকে এমনকি মেয়ের মুখ থেকেও বাজে মন্তব্য শুনছিল, খুব খারাপ লাগছিল ওঁর। আসলে স্ত্রী অতসীকে নিয়ে এত বছরের বিবাহিত জীবনে সেভাবে ভালো-মন্দ কিছুই চিন্তা করেনি অবনী। অতসী কি চায়? কি ওর ভালো লাগে বা খারাপ লাগে, তা কোনদিনই ভেবে দেখেনি বা ভাবার অবকাশ খোঁজেনি অবনীনাথ। নিজের স্ত্রীর প্রতি বাড়ির লোকদের অবহেলা আর দুর্ব‍্যবহার নিয়ে এতকাল কোনও প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু আজকে যেন অতসীর বিরুদ্ধে প্রতিটি কথাই বিদ্ধ ও ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে ওঁর মনকে। যে এতকাল স্ত্রীর সমর্থনে কোনওদিন কোনও কথা বলেনি, সে আজ এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাবার সমর্থন পেয়ে অতসীর হয়ে প্রথমবার মুখ খোলে

- "আমি অতসীকে এত বছরে যতটা চিনেছি, তাতে ও আর যাই করুক এই পরিবারের অসন্মান কোনো দিনই করবেনা।" বাবার মুখে মা'র প্রতি এই প্রথম অগাধ আস্থার কথা শুনে অবাক হয়ে বাবার চোখে চোখ রাখে অতসীর মেয়ে পলা। বাবার দু'চোখে বেদনার পাশাপাশি মা'র প্রতি ভালোবাসা বুঝতে কোনো অসুবিধাই হয়না ওর। এতকাল মা'কে অবজ্ঞা আর অবহেলাই করে এসেছে, আজকে যেন মায়ের অনুপস্থিতির পরবর্তী পরিস্থিতিতে মা'র জন্যে বুকের ভিতর এক অপরিসীম শূণ্যতা অনুভব করে।

ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। অতসীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারতে বেশ দেরীই হয়ে যায় সবার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবনী আর পলা খেয়ে নিতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় অতসী এখনও না ফেরায় এবারে বাড়ির সকলেই বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। অতসীর কি হলো, কোনও বিপদ আপদ, কোনও দুর্ঘটনা বা অপহৃত হলো কিনা এই সকল আলোচনা বাড়ির সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। শুধুমাত্র নলিনী ধরে নিয়েছে যে অতসী নিশ্চয়ই কারোর সাথে চলে গেছে, কিন্তু ভয়ে সবার সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। বৈঠকখানায় বসে সকলেই কি করা যায় এই নিয়ে আলোচনা করছে। পুলিশের কাছে যাবে মনে করেও যেতে পারছে না শুধুমাত্র পারিবারিক সন্মানের কথা ভেবে। এমন সময় সদর দড়জায় কড়াঘাত এবং সকলকে চমকে দিয়ে অতসী প্রবেশ করে। ঘরে ঢুকেই অতসী সকলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে একপ্রকার উপেক্ষা করে নীচের স্নান ঘরে ঢুকে পড়ে। স্নান সেরে, বাইরের জামাকাপড় পালটিয়ে বিথীর মা'র দেওয়া কাপড় পড়ে যতক্ষণে বৈঠকখানা ঘরে সবার সামনে উপস্থিত হয়, ততক্ষণে সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে অতসীর মুখ থেকে সব কথা শোনার জন্য।

- "কি ব‍্যাপার? সেই কোন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছ, সারাদিন কোনও খবর নেই, এতক্ষণে ফিরলে। সারাদিন কোথায় ছিলে? আমরা সবাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।" একটু রাগতঃ স্বরেই অতসীর কাছে জানতে চায় অবনীনাথ, আসলে সমবেত আক্রমণ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই প্রথমে প্রশ্নের উত্থাপন করে অবনী। সকলের দৃষ্টিতে একরাশ জিজ্ঞাসা, কিভাবে শুরু করবে ভেবে পায়না অতসী...

- "কাল শেষ রাতে ফোন এসেছিল, মা খুব অসুস্থ। পাশের বাড়ির কাকিমা ফোনে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি না করলেই নয়। তাই আমি ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে যাই। আজ রবিবার, সবাই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, তাই কাউকে বিরক্ত না করে বাইরে থেকে দরজা আটকে আমি ওবাড়িতে গিয়ে মা'কে হাসপাতালে ভর্তি করি।"

খুব শান্তভাবেই থেমে থেমে কথাগুলো বলে অতসী। এত বছর বাদে অতসীর কথা আর কাজের মধ্যে এই স্বনির্ভরতা সকলকে বিস্মিত করে।

- "সারাটা সকাল ধরে ডাক্তারবাবুরা মা'র জন্যে খুব চেষ্টা করেছেন, দুপুরের কিছু আগে সব চেষ্টা সত্ত্বেও মা চলে গেলেন।" একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অতসীর। অতসীকে এত কথা বলতে কেউ কোনোদিন শোনেনি, বরাবরই চুপ থেকেছে ও। শাশুড়ি, বড়জা কারোর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেননি, এমনকি স্বামীর অবহেলা নিয়েও কোনওদিন মুখ খোলেনি। আজ একা অতসী কথা বলছে আর বাকিরা সবাই শুনছে।

- "হাসপাতাল থেকে মা'র মৃতদেহ ছাড়িয়ে এনে শ্মশানে নিয়ে দাহ করতে করতেই এত দেরি হয়ে গেল।" অতসীর সব কথা শুনে ব‍্যানার্জী বাড়ির বৈঠকখানায় নীরবতা বিরাজ করে। খানিক পরে অবনীনাথই প্রথমে মুখ খোলে

- "এতকিছু হয়েছে, আমাকে একটা ফোন করলে না কেন? সবকিছু তোমাকে একাই সামলাতে হলো।"

- "না আসলে ভোরবেলায় তাড়াহুড়োতে ফোনটা নেওয়া হয়নি। অবশ্য ফোনটা নিয়ে গেলেও আমি এ ব‍্যাপারে তোমাদের ফোন করতাম না, এটা আমার দায় তাই আমাকে একাই এটা সামলাতে হতো। তোমরা তো আমাকে, আমার বাবা-মা'কে কোনও দিন সামান্য মর্যাদাও দাওনি। তোমরা কেউই সামান্য সন্মানটুকুও জানাওনি ওঁদেরকে। আমার শ্বশুরমশাই-ই আমাকে এই বাড়ির বৌ করে নিয়ে এসেছিলেন। অর্থনৈতিক আর সামাজিক ব‍্যবধানের জন্যে চিরকাল আমাকে অবহেলিত হতে হয়েছে তোমাদের সকলের কাছেই। তুমিও আমার ভালো-মন্দ নিয়ে কোনওদিন কিছু ভাবোনি আর আমার মেয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আজকে না বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সারাদিন ফিরিনি বলে বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করে তোমরা আজ আমার কথা ভাবতে বসেছ...?" খানিক উত্তেজিত হয়ে পড়ে অতসী।

- "ঠিক আছে ঠিক আছে, তুমি ওপরে যাও, গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। সারাদিন খুব ধকল গেছে তোমার।" নরম সুরে অতসীর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে অবনী।

-"হ্যাঁ আমি ওপরে যাচ্ছি ঠিকই, তবে থাকতে নয়, আমার জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে। আগে আমার মা ছিলেন, বাবাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল। আজ উনি চলে যাওয়ার পর বাবাকে দেখার আর কেউ নেই। উনিও খুব অসুস্থ, তাই আমি এবার থেকে ওখানেই থাকব। আমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে ওর প্রতি আমার দায়িত্ব শেষ, ও নিজেই নিজেকে এখন সামলে নিতে পারবে আর এই ব‍্যানার্জী বাড়িতে আমার প্রয়োজনীয়তা কারোর কাছে আছে বলে আমার মনে হয়না। এখন আমার বাবার প্রতি মেয়ে হিসাবে কর্তব্য করার সময়। আমার যা শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে ছাত্র পড়িয়ে আর যতটা গান শিখেছিলাম তাতে গানের ইস্কুল খুললে আমাদের বাবা আর মেয়ের চলে যাবে।"

নিজের দৃঢ় সিদ্ধান্তে ব‍্যানার্জী বাড়ির সকলকে স্তম্ভিত করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় অতসী।