প্রবন্ধ
গত কুড়ি বছরের নদিয়া জেলার উল্লেখযোগ্য কিছু লিটল ম্যাগাজিন (দ্বিতীয় পর্ব)
অমৃতাভ দে

'দর্পণ... মুখের খোঁজে' সাহিত্য পত্রিকার ৫০তম বিশেষ সংখ্যা
২০তম বর্ষ; ডিসেম্বর, ২০২২
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। তার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৫১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। মূলত বিষয়ভিত্তিক সংখ্যাই হয়। নানা বিষয় নিয়ে এখনও পর্যন্ত সংখ্যা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, 'ছুটি', 'আমাদের জীবনানন্দ', 'বৃষ্টি', 'সুনীল আকাশ', 'মাঝি', 'উদ্বাস্তু', 'এবং শান্তি', 'কবিতার অণু-পরমাণু', 'শিশু উৎসব', 'আমার একুশ', 'সার্ধশতবর্ষে নীলরতন মুখোপাধ্যায় ও তাঁর চন্ডীদাস পদাবলি', 'বর্ষবরণের কবিতা', 'হাট' ইত্যাদি।
'আমাদের জীবনানন্দ' সংখ্যাটি প্রকাশ হবার পর পশ্চিমবঙ্গের প্রথম শ্রেণির প্রতিটি কাগজেই আলোচনা বের হয়। 'আনন্দবাজার', 'স্টেটসম্যান' সহ সব দৈনিকেই আলোচিত হয়। তাছাড়াও 'ছুটি' এবং 'মাঝি' সংখ্যাটি বিদগ্ধ পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দেয়। বিশেষ বিষয় নিয়ে সংখ্যা ছাড়াও কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং পত্রিকা ও গ্রন্থ আলোচনাও প্রকাশিত হয়। ছবি, নাটক নিয়েও সমালোচনা প্রকাশিত হয়।
পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি একটি সাহিত্য সংগঠন হিসেবেও 'দর্পণ... মুখের খোঁজে' অন্যতম নাম। প্রতি মাসের প্রথম শনিবার নিয়ম করে কবিতা-চর্চা হয় এই পত্রিকার উদ্যোগে। প্রতি মাসেই কবিতা পাঠ ছাড়াও একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা, একজন কবির কাব্যগ্রন্থের আলোচনা ও নির্বাচিত কবিতা পাঠ (সংশ্লিষ্ট কবিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়) ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। পত্রিকার পক্ষ থেকে এমন একটি ইতিহাস তৈরি হয়েছে যা বিরলতম। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের কথায়, "কোনও একটি লিটল ম্যাগাজিনের একক উদ্যোগে একটি লিটল ম্যাগাজিন মেলা পরিচালনা এবং পরপর তিন বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে সেটা করা পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাস।"
তাছাড়াও 'কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী স্মৃতি পুরস্কার' প্রদান পত্রিকার উদ্যোগে পাঁচ বছর ধরে চলছে। কাব্যগ্রন্থের উপর এই রৌপ্যপদক দেওয়া হয়। যা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির কবিদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। পাশাপাশি কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে নিয়ে প্রচার, নিয়মিত জন্মদিন পালনও এই পত্রিকার অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে গেছে। কবির সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে এখন থেকেই পত্রিকার পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব সহ নানান প্রতিষ্ঠানে কবির ছবি বাঁধিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। ফলে বিস্মৃতপ্রায় কবিকে আবারও প্রচারের আলোয় আনা গেছে।
এই পত্রিকার উদ্যোগে প্রতি বছর 'শারদ সম্মান' দেওয়া হয়। যা এলাকার পুজো কমিটির প্রতিমাশিল্পী সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। দেওয়া হয় 'প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা'র ভিত্তিতেও। ফলে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চায় প্রতিনিয়ত নিয়োজিত এই পত্রিকার সকলেই। 'বর্ষবরণ উৎসব' আমাদের পত্রিকার একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে পত্রিকা প্রকাশ এবং 'বর্ষবরণ উৎসব'-এর মাধ্যমে সেটি করা হয়।
সব মিলিয়ে সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে এই কাগজ কতটা সফল তা তো পাঠকই বিচার করবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই কাগজে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা কলম ধরেছেন। প্রান্তিক একটি জায়গার নিরিখে যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় বলেই মনে হয় আমাদের।

'চরভূমি' সাহিত্য পত্রিকা ।। দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা; ডিসেম্বর, ২০২১
আমার বেড়ে ওঠা যে বড়ো আন্দুলিয়া গ্রামে, তারই পাশের একটি গ্রাম হাঁটরা। এই গ্রামের পাশ দিয়েও বয়ে গেছে জলঙ্গি নদী। হাঁটরা চর ঘাট পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে উল্লিখিত গ্রাম বড়গাছিতে। এই হাঁটরা চর থেকেই প্রকাশ পেয়েছে দিলীপ দত্তে সম্পাদনায় 'চরভূমি' পত্রিকা। দিলীপ এবং আমি একই স্কুলে পড়েছি। দিলীপ বয়সে আমার থেকে একটু ছোটো। ওর অনুরোধে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (ডিসেম্বর ২০২১) একটি ভ্রমণকাহিনী লিখলাম - 'ইতিহাস-অরণ্য-পাহাড় ভালোবেসে ডুয়ার্সের পথে পথে'। এই সংখ্যায় রয়েছে চাপড়া জনপদের প্রয়াত কবিদের কবিতা, রয়েছে বাংলাদেশের কবিতা, বেশকিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ আখ্যান, ছোটগল্প, অনুগল্প এবং পুস্তক সমালোচনা। পাশাপাশি রয়েছে অজস্র কবিতা। এই জনপদের সঙ্গে যেহেতু আমার নাড়ির যোগ তাই এই পত্রিকা ঘিরে আলাদা আবেগ কাজ করেই মনের ভিতর। অধ্যাপক দেবনারায়ণ মোদক 'সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে নদিয়ার যোগঃ টুকরো কিছু কথা' শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রিয় মোশারফ হোসেন লিখেছেন 'হাঁটরা গ্রামঃ অতীত থেকে বর্তমানের পথে'। নীলাদ্রিশেখর সরকার শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রয়াত কবি শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষের প্রতি। দীনমহাম্মদ মন্ডলের লেখা 'হারিয়ে যাচ্ছে নদিয়ার লোকায়াত গান' - এই পত্রিকার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সব মিলিয়ে 'চরভূমি' সাহিত্য পত্রিকা তার আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

পত্রিকাঃ আলোকবর্ষ ।। চতুর্থ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা; অক্টোবর, ২০২১
প্রকাশস্থানঃ তাহেরপুর, নদিয়া ।। সম্পাদকঃ সুমন বিশ্বাস
হাতে পেলাম তাহেরপুর, নদিয়া থেকে সুমন বিশ্বাস সম্পাদিত 'আলোকবর্ষ' পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন এই পত্রিকায় অরুণ বসু ও বীতশোক ভট্টাচার্যের অগ্রন্থিত কবিতার পাশাপাশি প্রকাশিত রয়েছে গৌতম বসুর অপ্রকাশিত গদ্য 'দ্বীপবাসী'। রয়েছে অসংখ্য কবিতা। বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ এই সংখ্যাকে সমৃদ্ধ করেছে। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন অনিমেষ মন্ডল। গৌতম বসুর কবিতা নিয়ে লিখেছেন উজ্জ্বল ঘোষ। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছেন চন্দন বাঙ্গাল। চিন্ময় গুহর 'ঘুমের দরজা ঠেলে' বইটি নিয়ে লিখেছেন পারমিতা ভৌমিক। 'ঘোড়ার ডাকে চিঠিঃ গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা' শীর্ষক রামচন্দ্র প্রামাণিকের প্রবন্ধটি এই সংখ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। অন্যতম প্রিয় কবি নির্মল হালদারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার একটি কবিতা রয়েছে এই সংখ্যায় - আমার পরম প্রাপ্তি।

'কাগজপত্র' ।। প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা; ২৪ অক্টোবর, ২০২২
২০২২ সালে কৃষ্ণনগর থেকে প্রকাশিত হলো দুটি উল্লেখযোগ্য মাসিক পত্রিকা - একটি বিখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, নাট্যকার স্বপনবরণ আচার্য সম্পাদিত 'কাগজপত্র' এবং অন্যটি প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী,কবি আকাশ দত্ত সম্পাদিত 'কলস্বর'। ভিন্ন স্বাদের এই দুটি পত্রিকা পাঠক সমাদর পাচ্ছে। কাগজপত্রের টাইমলাইনে লেখা রয়েছে 'প্রবন্ধ-নিবন্ধপত্র গল্পপত্র শিল্পপত্র সংস্কৃতিপত্র সংবাদপত্র বইপত্র চিঠিপত্র'। পাঠক দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রবন্ধ-নিবন্ধপত্র অংশে লিখেছেন অমর মিত্র, আনসারউদ্দিন, বিদ্যুৎ হালদার, বিশ্বনাথ প্রামাণিক, সুদীপ ভট্টাচার্য। শিল্পপত্র অংশে আছেন শেখর দে, কোয়েনা ভট্টাচার্য্য। শিল্পপত্র অংশে রয়েছে ফটোগ্রাফি এবং অসামান্য সব স্কেচ। স্বপনবরণ আচার্যের ধারাবাহিক 'আমরা সবাই রাজা'। তৃতীয় সংখ্যায় শুরু হয়েছে দেবশঙ্কর হালদারের ধারাবাহিক 'এক নাটক জীবন', এই সংখ্যায় নিবন্ধ লিখেছেন কিন্নর রায়, শিরোনাম, 'নদ নদী খেলা'। গল্প অংশে রয়েছেন বিশ্বনাথ প্রামানিক, শান্তনু দে এবং স্বপনবরণ আচার্য। কলম ধরেছেন অবিনাশ গুপ্ত, অনির্বাণ জানা, চিরন্তন সরকার, সুদীপ ভট্টাচার্য, জীবন বিশ্বাস। গদ্যের বিষয় বৈচিত্র্য মুগ্ধ করে। এই সংখ্যাতেই শেষ হয়েছে স্বপনবরণ আচার্যের ধারাবাহিক 'আমরা সবাই রাজা'।

'কলস্বর' ।। প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী, কবি আকাশ দত্ত (আমাদের প্রিয় আকাশ) সম্পাদিত 'কলস্বর' মাসিক পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এই পত্রিকার ট্যাগ লাইন - 'পাথরের গর্ভ থেকে ক্ষণজন্মা আগুনের বীজ খুঁজে আনি...' প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকা জানান দিয়েছে - এই পত্রিকার সুর ও ছন্দ আলাদা। দ্বিতীয় সংখ্যায় বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী প্রণতি ঠাকুরের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে আবৃত্তিশিল্পের নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছে মীনাক্ষ্মী কর্মকার। 'কলস্বর'-এর বিভিন্ন আয়োজনের জীবন্ত সব ছবি ফুটে উঠেছে পাতায় পাতায়। আকাশের আবৃত্তি সংস্থা 'কলস্বর' আসলে পেরিয়ে এসেছে কুড়িটি বছর। এই কুড়ি বছরের সাক্ষী থেকেছি আমিও। 'কলস্বর'-এর বিভিন্ন প্রযোজনার রিভিউ প্রকাশ পাচ্ছে এখানে। এই সংখ্যায় 'এবং শিশুতীর্থ' প্রযোজনা সম্পর্কে লিখেছেন অচিন্ত্য সাহা। 'নোনাজলের করোঙ্গা' নামের আবৃত্তিনাট্য প্রযোজনাটি সম্পর্কে লিখেছে দেবান্বিতা ব্যানার্জি। এই পত্রিকায় 'গাঙ্গিনী' শীর্ষক একটি অংশ রয়েছে, যার একটি পর্বে আছে 'বই-ভাষ'। এখানে কবিতা ও ছড়ার বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আমি আমার পাঠানুভূতি জানাচ্ছি। এবারে লিখলাম 'রতনতনু ঘাটীর ছোটদের শ্রেষ্ঠ ছড়া-কবিতাঃ ইচ্ছেপুরের গল্প হয়ে ওঠে'। আরেকটি পর্বে সুস্মিতা লিখছে গানমানুষের কথা যাঁদের কথা আগে কোনওদিন লেখা হয়নি - শিরোনাম 'গান-মানুষের টানে'। এই পত্রিকায় কবি দিব্যেন্দু একটি অনন্য গদ্য লিখেছে শিরোনাম - 'হলুদ বাস'। বন্ধু কবি সঞ্জীব চক্রবর্তী 'কলস্বরঃ একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার আত্মপ্রকাশ' শীর্ষক গদ্যে 'কলস্বর' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা নিয়ে মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ করেছে। বাংলা ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা ইতিহাসে 'কলস্বর' একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করলো। আবৃত্তিকে ঘিরে এরকম একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিতভাবে এর আগে প্রকাশ পেয়েছে কিনা জানিনা! এই পত্রিকার দীর্ঘজীবন কামনা করি।
দ্বিতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছে আকাশ। ক্যালিগ্রাফি শুভদীপ সেনশর্মা। শুভদীপ এবং মৌমিতার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। দ্বিতীয় সংখ্যার মুদ্রণ অসামান্য। মুদ্রণের দায়িত্ব নিয়েছে 'আলোপৃথিবী প্রিন্টিং অ্যান্ড গ্রাফিক্স' অর্থাৎ শুভদীপ আর মৌমিতা।

দৈনন্দিন গল্পের অল্পপত্র 'পরিধি' ।। এপ্রিল-জুন ২০০৩ সংখ্যা
দৈনন্দিন গল্পের অল্পপত্র 'পরিধি' কৃষ্ণনগরের পত্রপত্রিকার ইতিহাসে অন্যমাত্রা সংযোজন করেছিল। সৌম্যদীপের সম্পাদনায় 'পরিধি'র অনেকগুলি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতে। পত্রিকার শেষ সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ২০০৫) পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় এই পত্রিকা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানিয়েছিলেন। খুব তাৎপর্যপূর্ণ সেই মতামতের কিছুটা অংশ তুলে ধরলেই পত্রিকা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে - "পরিধি একটি তত্ত্ব, একটি আত্মসচেতন বীক্ষার কথা বলে এখনকার বাংলা ছোটগল্পের জগতে এটা একক, সে কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।... পরিধি পত্রিকা তাই শুধু গল্পপত্র নয়, সময়ের মুখোমুখি হয়ে পরিকীর্ণ অনন্বয় ও ভগ্নস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে খোঁজা। ব্যক্তিকে ভগ্নস্তূপ থেকে বের করার চেষ্টাও বটে। আধুনিকের অবক্ষয়মুখীনতা, উত্তরাধুনিকের বিকেন্দ্রিত বীক্ষা, এসবের মধ্য থেকেই এসবকে স্বীকার করেই 'পরিধি' অন্য আর এক প্রস্থানে যেতে চায়... এক ঐকতানের মত গল্পগুলি মিলে, একটা গল্প হয়ে ওঠে - মহাগল্প। অনেক গল্প মিলে যেমন একটা চরিত্র, 'পরিধি'র গল্পগুলি মিলে একটা গল্পের সমগ্র।" একেবারেই সামান্য মূল্যে পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া হত এই পত্রিকা। তরুণ গল্পকারদের কাছে এই পত্রিকা ছিল এক বিরাট আশ্রয়। এই পত্রিকা কখনই নিজেদেরকে লিটল ম্যাগাজিন বলত না, লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রের সঙ্গে এর মিল ছিল না। অনেক অনেক কপি ছাপা হত, অনেক কম মূল্যে অনেক বেশি পৃষ্ঠায় অনেক পাঠকের কাছে তা পৌঁছে যেত। আবিষ্কার করা হত গল্পকারদের। আজকের অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পকার 'পরিধি'র পাতাতেই প্রথম গল্প লেখা শুরু করেন। এই পত্রিকায় অন্য মাত্রা যোগ করেছিল এর অলংকরণ।
'পাঠকদের প্রতি' অংশে লেখা হতো - 'আপনার জীবনে বা আপনার দেখা, শোনা, আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনাগুলি, যা আপনাকে আশ্চর্য্য করেছে বা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে হয়েছে বা আপনার অনুভবে বিশেষভাবে ছাপ ফেলেছে বা জীবনচর্যায় পরিবর্তন এনেছে বা ভাবিয়েছে, নাড়া দিয়েছে আপনার ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র সমষ্টি জীবনকে সেই বাস্তব ঘটনাগুলি আমাদের কাছে গল্পাকারে লিখে পাঠান। আমরা সেগুলি একত্র করতে চাই।
যদি মনে করেন 'লেখালিখি আমার কম্ম নয়' তাহলে স্রেফ বন্ধুকে চিঠি লেখবার মত করেই ঘটনার বিবরণ ও আপনার মনোভাব লিখে পাঠান। আমরা পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনার গল্পের অনুলেখক জোগাড় করে দেব। আপনার সাথে বন্ধুত্ব চাই।'
'লেখকদের প্রতি' অংশে লেখা হতো - 'লাইনটানা কাগজের একপিঠে এক লাইন অন্তর পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা পাঠান। যাঁরা নিয়মিত লেখেন তাঁরা একাধিক লেখকের লেখা পাঠালে ভালো হয়। তার মধ্যে থেকে আমাদের বেশী পছন্দের লেখাটি আমরা প্রথমে ছাপবো। লেখা অবশ্যই কপি রেখে পাঠাবেন। যোগাযোগের জন্য একটি টেলিফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন।'
পত্রিকায় ছাপা হতো অনেকগুলি গল্প। থাকতো বড়গল্প, অনুবাদ গল্প, পুনর্মুদ্রণ, চিঠিপত্র, উপন্যাস, কোনো কোনো সংখ্যার বিশেষ ক্রোড়পত্র (নারায়ণ সান্যাল, অরূপরতন বসুর অগ্রন্থিত গল্পসমূহ) প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় আকর্ষণীয় বিষয় ছিল 'গল্পকথা' (ঠিক সম্পাদকীয় নয়)। ভাষা পাঠকদের মননকে স্পর্শ করত। 'পরিধি'র শেষ সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ২০০৫) 'পরিধির কথা' শীর্ষক একটি অংশ (স্ববাস্তববাদী ইস্তেহার / পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় 'প্রায় ম্যানিফেস্টো') ছাপা হয়েছিল, সেখান থেকে কিছুটা লিখছি -
"...আশেপাশের প্রতিদিনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আর ঘটনা মিলে গড়ে ওঠে গল্প - কখনও তাদের চিনতে পারি, কখনও পারি না, গল্প- ছোটগল্প আসলে আমাদের মত, লোকজনের মত, চেনা-আধাচেন-অচেনা-সদ্যআলাপ-একটু ঘনিষ্ঠতা বা প্রেম, ভালোলাগা - আবার বলি লোকজনের মত, চরিত্রের মত নয়। 'ভীষণ সাহসী' কোনো লোকের জীবনে থাকে 'ভয়ের গল্প' - অনেক গল্প জুড়ে জুড়ে সম্পন্ন করে একটি চরিত্র - তাই খন্ডতায় চেনা যায় না সবসময় - তবু চেনবার চেষ্টা থাকে তাই ছোটগল্প পড়া। ছোটগল্প নিয়ে কাজ করা।... আমার সত্য বিন্দু আমি দিই - তোমার সত্য বিন্দু তুমি দাও - সত্য গল্প জীবনে মেশাও - একসাথে ঘিরে ধরি আমাদের - যাতে হারিয়ে না যাই - আমরা মানুষেরা।"
'পরিধির কথা'য় যে উচ্চারণ সে উচ্চারণ পত্রিকার চরিত্র বাতলে দেয় -
'বিযুক্তি (alienated) হয়ো না বিযুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী তার একমাত্র শত্রু আমাদের।
বিযুক্ত হয়ো না জীবন থেকে যদিও তা পূর্ণ যন্ত্রণা আর দুর্দশাতে।
বিযুক্ত হয়ো না কাজ থেকে যদিও তা নেহাৎই বাধ্যবাধকতা।
বিযুক্ত হয়ো না অফিস-ওয়ার্ক থেকেও যদিও তার শোষণ নামান্তর।
বিযুক্ত হয়ো না বাস্তব থেকে।
চেষ্টা করো অন্যদের সাথে এক সত্য সেতু নির্মাণের যদিও তা এখন অসম্ভব প্রায়
তবু তুমি চেষ্টা করো তোমারই জন্য কেননা তুমিই তোমার অন্যতম (other)।
হয়ো না বিযুক্ত
হয়ো না 'ভিন্নতর' অন্যের কাছে।
মা দেবে তোমায় এক মেকি-আত্মতৃপ্তি, ছোট আমির পরিচর্যা
ভিন্নতর হবার মানে মৃত্যু তোমার বড় আমির।
বাঁচবার মত বাঁচো বিযুক্তি-বিরুদ্ধ জেহাদে।
এসো একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করি -
বিশেষতঃ আমার জন্যই আমার কিছু উচিত লেখা
আমার জন্য, আমার দ্বারা - একটু কিছু সুবাস্তব
সত্য, বাস্তব নিগড় মুক্ত
আমার উচিৎ সত্য গড়া বাস্তবকে দুমড়ে
আমি পারি মাপতে একে, ঘুরিয়ে কিংবা চেপ্টে দিতে,
টুকরো করে ভেঙে দিতে, অন্য কোথাও জুড়ে দিতে, অথবা
ছেঁটে বাদ দিতে আশার আলো দেখতে চেয়ে
আমি ব্যবহার করতে পারি ফিল্টার কিংবা লেন্স,
আমি পারি একে সম্পৃক্ত করতে, বদলে দিতে পারি বর্ণালী
পারি লঘু করে দিতে অথবা আলোকিত
বাড়িয়ে দিতে পারি বৈষম্য
শুধু যা পারি না তা হল মনে গেঁথে নিতে নির্মিতকে।
লেখো কিংবা আঁকো সাদা কাগজে
রেখে দাও শীতল শুষ্ক স্থানে। আর সব ভুলে যাও এ সম্পর্কে।'
'পরিধি'র গল্প লেখকদের তালিকায় ছিলেন - সৈকত মুখোপাধ্যায়, মৃগাঙ্কমৌলি বিশ্বাস, বিদ্যুৎ গোস্বামী, প্লাবন ভৌমিক, নন্দিনী নাগ, দেবব্রত মিত্র, জগন্নাথ মন্ডল, রজত বিশ্বাস, সুরঞ্জন প্রামাণিক, দেবাশিষ সিংহ, সঞ্জয় মৌলিক, শান্তি নাথ, পাঁচু রায়, আশিস ভট্টাচার্য, দীপঙ্কর ঘোষ, শৈবাল মুখোপাধ্যায়, পলাশ পাত্র, সৌম্যদীপ সহ অসংখ্য লেখক।

'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকা ।। একাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ।।
উজ্জ্বল এক দশক
'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় নদিয়া জেলার নাকাশিপাড়ার একেবারে প্রান্তিক গ্রাম ধাপাড়িয়া থেকে। নাকাশিপাড়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা মূলত বেথুয়াডহরীকে আবর্ত করে। তবে নাকাশিপাড়ার এই প্রান্তিক অঞ্চলে সাহিত্যচর্চা ছিল না বললেই চলে। হাতে গোনা দু'একজন কবি ছাড়া, যারা নিভৃতে কবিতাচর্চা করতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কবি গাজী রহমান চৌধুরী, শফিউদ্দিন বিশ্বাস। তবে কোনো সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। তাই এতদঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস ও কবিতাচর্চার তাগিদে ২০১২ আগষ্ট মাস থেকে কবি দীনমহাম্মদ সেখ সম্পাদনা শুরু করেন 'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকা। এই পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বিশিষ্ট কবি, ছড়াকার ও নাট্যকার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, কবি ও সম্পাদক ধর্মেন্দ্র বিশ্বাস। পত্রিকার নামকরণ করেন ধর্মেন্দ্র বিশ্বাস তাঁর সম্পাদিত 'কাব্যমন' পত্রিকার অনুকরণে। এই পত্রিকায় লিখেছেন ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, দেবদাস আচার্য, জয়নুল আবেদিন, তপন বাগচি, রফিকুর রশীদ, আসাদুজ্জামান, তৈমুর খান, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, কনক ঠাকুর সহ আরও অনেক খ্যাতিমানেরা।
বাৎসরিক একটি করে সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে আসছে, সেই সাথে বিশেষ সংখ্যাও। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে সাহিত্যপাঠের আসর ও সাহিত্য সম্মানপ্রদান। প্রতি বছর একজন কবিকে এই পত্রিকার পক্ষ থেকে 'কাব্যকণ্ঠ সাহিত্য সম্মান' তুলে দেওয়া হয়। ১০১৮ সাল থেকে এই সম্মান জানানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে পত্রিকার পক্ষ থেকে সম্মান জানানো হয়েছে কবি জয়নুল আবেদিন, দিলীপ মজুমদার, রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, দেবনারায়ন মোদক মহাশয়কে।
এই পত্রিকা মূলত তরুণদের সবচেয়ে বড়ো প্লাটফর্ম। এই পত্রিকা থেকেই জন্ম নিয়েছে অনেক সম্ভাবনাময় কবির। যেমন ইব্রাহিম বিশ্বাস, ফজলুর রহমান মন্ডল, ওয়াশিম জাফর মোল্লা, হাসিবুল মল্লিক প্রমুখের।
'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকা এখন জেলার একটি সুপরিচিত লিটল ম্যাগাজিনের নাম। নাকাশিপাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলা ও ওপার বাংলাতেও সমাদৃত হচ্ছে তার কাজের জন্য। সম্প্রতি সদ্য প্রয়াত কবি জয়নুল আবেদিনের এই পত্রিকার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল। তাঁর প্রয়াণে 'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে নাম নামাঙ্কিত স্মৃতি পুরস্কার চালু করা হয়েছে। প্রথম বছরে এই পুরষ্কার তুলে দেওয়া হয় বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনসারউদ্দিনের হাতে। সেই সাথে কবি জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যার কাজ ইতিমধ্যে শুরু করেছে 'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকা।
এক কথায় বলা যায় 'কাব্যকণ্ঠ' সাহিত্য পত্রিকার দৌলতে গ্রাম বাংলার নিভৃতচারী ও সুপ্ত প্রতিভাকে যেমন লেখার জায়গা করে দিয়েছে তেমনই নাকাশিপাড়া ও নগরকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার সাথে মেলবন্ধনের কাজ করে চলেছে এই পত্রিকা।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
