'সত্য' শব্দটি যে দ্যোতনা বহন করে, স্পষ্টত তা অনড় ও একমুখী। কিন্তু জীবনের পথে চলতে চলতে সবসময় এই অনড়ত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না - লক্ষ্যপূরণের জন্য আপস করতেই হয়। সেই পরিস্থিতিতে যদি সাফল্য আসে, তাকে সাময়িক সত্য বা আপাত সত্য নামে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়, কিন্তু সেটি কখনই প্রকৃত সত্য হয় না। সত্য সর্বদা নিরপেক্ষ, যার একমাত্র লক্ষ্য - এক অপরিবর্তনীয় অবস্থানে।
আদর্শগতভাবে বিজ্ঞানীরাই প্রকৃত সত্যসন্ধানী। বর্তমান সময়ে নির্বিচারে যাকে খুশি বিজ্ঞানী আখ্যা দেবার যে প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা অধিকাংশ সময় স্বার্থরক্ষার উদ্দেশে - কিন্তু তারা নন, প্রকৃত বিজ্ঞানী তাঁরাই - নিরপেক্ষভাবে যাঁরা দৃশ্যমান প্রকৃতির অন্তর্গত মূল রহস্যের সন্ধান করেন। এছাড়া অন্য কোনো অভিমুখ তাঁদের থাকে না - সমাজ সংসারের ভালমন্দ বা অন্য কোনো মঙ্গলচিন্তা - কোনো কিছুই নয়। এছাড়া যারা আত্মানুসন্ধানী - নিজ অনুভূতির গভীরতম স্তরে পৌঁছতে যে অভিমুখ নির্দিষ্ট করেন, অবশেষে নিজ অনুভূতিকে বিশ্বানুভূতির সঙ্গে সামিল করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু এই আত্মানুভূতি সন্ধানী ব্যক্তিরা নেহাৎ-ই ব্যতিক্রমী। সাধারণ মানুষ তার জীবনচক্রে অবস্থানকালে প্রত্যাশার কবলে পড়ে যখন কিছু কিছু সম্পদ লাভ করে, তার প্রতিদানে সেখানে তাদের কিছু অবদান রাখতে হয়। বস্তুত, এই জীবনচক্র প্রকৃত সত্য-র ওপর একটি আচ্ছাদন মাত্র, যাকে আধ্যাত্মিক ভাষায় 'মায়া' নামে অভিহিত করা হয়।
ঘটনা এই, এই মায়াকে নির্মাণ করেছে কাল তথা সময়। যে কারণে আধ্যাত্মিক জগতে মায়া এতটাই সর্বব্যাপী - জীবনচক্রে তাই থাকে বৈপরীত্যের সমাবেশ - মঙ্গল-অমঙ্গল, ভাল-মন্দ, সাফল্য-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এর অর্থ সেখানে একমুখিনতা নেই, পর্যায়ক্রমে এইসব আসে, তারপর সরে যায় পুনরাবর্তনে, স্থায়ী কোনো অবশেষ না রেখেই। এই সূত্রে সবাই যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কথা বলে, তা হয়ত সঞ্চয় হয়, কিন্তু সেই বৈপরীত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এইভাবে জীবনচক্র সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা দূরে থাক, বরং কালের নিয়ন্ত্রণেই তাকে থাকতে হয়।
বাস্তববাদী বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা দাবী করেন, তাঁরা যা প্রত্যক্ষ করেন, সেটাই সত্য। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে - এই মুহূর্তে যা দৃশ্যমান, তা পরোক্ষ, কেন না সেই দৃশ্য শুধু প্রতিভাত হয় - বস্তুর যে তন্মাত্রাগুলি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গৃহীত হচ্ছে, তার সমাবেশ। আরো যে ঘটনা - ব্রহ্মান্ডের কোনো কিছুই স্থির নয় - চলমান, ফলে বস্তুটিকে এখন দেখছি বলে ধারনা হয়, কিন্তু তা অতীত হয়ে গেছে, ততক্ষণে অন্য দৃশ্য সেই স্থান দখল করেছে। তার কারণ, যা দেখছি, তা প্রকৃত বস্তুর ওপর সময় তথা মায়ার আবরণ। অর্থাৎ যা প্রত্যক্ষ করছি বলে ধারণা, বস্তুত তা পরোক্ষ - মায়ায় অধ্যস্থ প্রত্যক্ষ সত্যের পরোক্ষ দৃশ্যমাত্র, প্রত্যক্ষ কখনই নয়।
ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আগে ছিল শূন্য সময়। যে মুহূর্তে সময় তাতে যুক্ত হয়েছে, সেই মুহূর্ত থেকে তারই নিয়ন্ত্রণে ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্ম শুরু, তখন থেকেই সময় এই ব্রহ্মান্ডের চালক। কে বা কারা সময়কে এই দায়িত্ব দিয়েছে, বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এর কোনো সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। আধ্যাত্মিক জগৎ অবশ্য বিশ্বাস করে - একাকী ঈশ্বর তাঁর একাকিত্ব দূর করার জন্য যে লীলা সহচরী তথা মায়ার সাহায্যে এই ব্রহ্মান্ডের সূত্রপাত করেছেন - সময় সেই লীলা সহচর। সময়ের এই খেলায় ঈশ্বর নির্লিপ্ত থাকেন - একজন নিরপেক্ষ দর্শক।
অতএব এই জীবনপ্রবাহের মূল কারিগর সময় - এই প্রবাহের বৈচিত্রে নির্দিষ্ট গতিতে তা সম্পন্ন হয় - তাতে মুগ্ধ সাধারণ মানুষজন। কিন্তু সেই কারিগর নিজে নেহাৎ-ই বৈচিত্রহীন - একমুখী তার অভিমুখ, তার চলন, এপাশে ওপাশে দৃষ্টি থাকে না, পেছন ফিরে দেখবার অবকাশ নেই, দৃষ্টি শুধু অনির্দেশ্য সামনের দিকে তথা ভবিষ্যতের দিকে। তার গতিতে বৈচিত্র না থাকায় কোনো জটিলতা, সাফল্য বা ব্যর্থতা নেই, তার গতির কোনো পরিবর্তন কেউ করতে পারে না। চূড়ান্ত একঘেয়ে এই সময়, অথচ বৈচিত্রপূর্ণ অসংখ্য বিষয়ের জন্ম দিয়েছে সে। বস্তুত এই ঘটনার ভেতরেই নিহিত আছে সময়ের সেই রহস্যময়তা তথা মায়া।
যতিহীন চলমান এই অখন্ড সময়, সে-কারণেই তাকে নিয়তি বলা হয়। স্বরূপতঃ সেই মহাসময় যা ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির মুহূর্তে উদ্ভূত হয়েছিল - সেখানে গতির অনুভূতি কার্যকরী থাকার ফলে এই বৈচিত্র গড়ে উঠেছে। সে-কারণেই এই বৈচিত্র সমূহের উৎস সরাসরি সেই মহাসময় নয় - যাবতীয় ব্যক্তিসমূহের ব্যক্তিগত অনুভূতিসমূহের বৈচিত্রময় সমাবেশ।
এরপর এই ব্যক্তি সমাবেশের মধ্য দিয়ে যখন সংসার ও সমাজ গড়ে উঠল, সেখানে কার্যকরী হয়েছিল সাংসারিক তথা সামাজিক সময়। একজন ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভাল লাগা-মন্দ লাগা, কামনা-বাসনা ইত্যাদি অন্য ব্যক্তিদের থেকে স্বতন্ত্র, ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব সময় নিয়ে অবস্থান করে তার নিজস্ব পৃথিবীতে। কিন্তু সংসার বা সমাজে সেই ব্যক্তির অবস্থান-হেতু তাদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। যেহেতু প্রতিটি সংসার ও সমাজেরও নিজস্ব সময় থাকে এবং সেই ব্যক্তির নিজস্ব সময়ের অতিরিক্ত সেই সংসার ও সমাজের সময়ের প্রতিও তাকে মান্যতা দিতে হয়। এই দুটি সময় মাত্রার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কখনো কখনো বিরোধ উপস্থিত হয়। এই কারণে ব্যক্তির জীবনে সংকট উপস্থিত হয় কখনো কখনো, যার ফলে সংসার ও সমাজে প্রায়শ অশান্তি দেখা দেয়।
প্রকৃত বিষয়টা এই, যাবতীয় তথাকথিত বাস্তব পৃথিবীর সার্বিক মূল সমস্যা এই। সমস্যা না বলে বরং রহস্য বলাই সঙ্গত, কেন না, আমাদের ঘিরে বিশ্বের যাবতীয় সভ্যতা, যা নিয়ে আমাদের গর্ব - বস্তুত সেটি একটি প্রতারণার ফাঁদ, যে ফাঁদে আমরা অসহায়ভাবে গ্রস্ত আছি। এখানে রহস্য এটাই যে, সে-বিষয়ে আমরা কখনই সচেতন থাকি না। তুলনায়, ইদানিং নানা প্রয়োজনে অন্যতর কিছু সৃষ্টি করার চেষ্টা করি অর্থাৎ ভার্চুয়াল পৃথিবী গড়ে তোলা। প্রয়োজনে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে তোলায় কিছুটা সারবত্তা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মূল বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা জানিই না যে, এতকাল প্রত্যক্ষ জগৎ বলে যার প্রতি সম্মোহ ছিল, তা আসলে পরোক্ষ তথা ভার্চুয়াল জগৎ, তাও আমারই ধারনা-নির্ভর।
এইসব যাবতীয় ঘটনার মূল চক্রী - সময়। আপাতদৃষ্টিতে নিরাসক্ত এই চক্রী - সবকিছুর প্রতি নিরাসক্তভাবে এগিয়ে চলেছে চলেছে ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনার প্রতি - ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির শুরু থেকেই। এই 'সময়' তথা 'কাল' সেই মায়া, যাতে মধ্যস্থ থেকে প্রত্যক্ষ বস্তু ভার্চুয়াল তথা পরোক্ষ পৃথিবী রূপে দৃশ্যমান হতে থাকে। বরং এটাই আশ্চর্য যে, মানুষ এতটাই আত্মমন্য - উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে যে ভার্চুয়াল অস্তিত্ব গড়তে উৎসুক, কিন্তু সে তো নিজেই ভার্চুয়াল - যার প্রকৃত অস্তিত্ব তার কাছে অধরা, অধরাই থেকে যাবে, কারণ মূল অস্তিত্বটি সময়ের প্রবাহে অধ্যস্ত থেকে চিরকাল অধরাই থাকে।
একমাত্র কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি তাঁর আত্মানুভূতিকে যদি বিশ্বচেতনায় লীন করে দিয়ে - সময়ের মায়া ছিন্ন করে, তখনই তাঁর পক্ষে বস্তুর প্রত্যক্ষতা লাভ করা সম্ভব।