বই পড়া আমার কাছে আনন্দের এপিঠ-ওপিঠ। শৈশব থেকে গল্প পড়া শুরু। সত্তরেও তা অব্যাহত। ‘শিশুসাথি’, ‘শুকতারা’ দিয়ে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পাঁচ-ছয় বছর বয়সে কল্পনার জগতকে স্পর্শ করেছিলাম। বয়স বেড়েছে বই পড়া লাগামহীন হয়েছে। মনের জগতটা আকাশের মত খোলামেলা হয়ে উঠেছে।
বেশ কয়েকমাস ধরে নতুন করে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাবলীগুলো পড়লাম। মনটা স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ল। বাল্যে সদাশিবের গল্পগুলো পড়েছিলাম - সদাশিবের আদিকাণ্ড, সদাশিবের অগ্নিকাণ্ড, সদাশিবের ঘোড়াকাণ্ড আর সদাশিবের হৈ-হৈ কাণ্ড। গল্পের পটভূমি মহারাষ্ট্র, শিবাজি মহারাজের অভ্যুথানের সময়। লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিতান্তই শিশুপাঠ্য লেখা। কিন্তু কি অদ্ভুত সুন্দর। আমার বালিকা মনে আঁচর কেটে দিয়েছিল গল্পগুলো। লেখক সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না সেই বয়সে।
দিন বয়ে যায়, আরও কত বই পড়ি। লীলা মজুমদার, হেমেন্দ্রকুমার, সুকুমার রায়, আশাপূর্ণা দেবী, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী এবং অতি অবশ্যই টেনিদা ও ঘনাদা। এছাড়াও বাংলার ডাকাত, ডাকাতের হাতে ও সন্দেশ পত্রিকা তো আছেই।
এই রকম সময়ে স্কুলের উঁচু ক্লাসে হাতে এল - ব্যোমকেশের ত্রিনয়ন। তিনটি গল্পের মালা - সত্যান্বেষী, অর্থমনর্থম্, চোরাবালি। সচকিত হয়ে দেখি লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুযুগের ওপার থেকে মনের স্মৃতিতে ধাক্কা মারল সদাশিবের কাণ্ডকারখানা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবার পেলাম সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের স্রষ্টা রূপে। সত্য উদ্ঘাটন করাই তার লক্ষ্য। বন্ধু অজিতকে তাই তিনি বলেন যে, গোয়েন্দা শব্দটা তাঁর ‘না পসন্দ’। বরং সত্যান্বেষী শব্দটা জুতসই। কি বুদ্ধিদীপ্ত, মার্জিত, সরস এই ব্যোমকেশের লেখাগুলো। ধীরে ধীরে ব্যোমকেশের সব লেখাগুলি পড়ে ফেলি। আর বুঝলাম যে লোকে ভূতের গল্প, প্রেমের গল্প, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প ভালবাসে, কিন্তু ব্যোমকেশ অথবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার ভালোবাসাকে রহস্য উপন্যাসের তারে বেঁধে দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের পরে যিনি আমার মনন জগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, তিনি এই মুঙ্গেরবাসী, পুনে নিবাসী, কলকাতার কেয়াতলার বাসিন্দা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর ইতিহাস কেন্দ্রিক গল্প উপন্যাসও তুলনাহীন। রক্তসন্ধ্যা, কালের মন্দিরা, গৌড়মল্লার, তুমি সন্ধ্যার মেঘ, তুঙ্গভদ্রার তীরে আরও কতো লেখা যা প্রাণমন এক অনাস্বাদিত মাধুর্যে ভরে তোলে। রোমান্টিক গল্প, বরদাকে নিয়ে অলৌকিক ভূতের গল্প কিংবা নিতান্তই কিশোর পাঠ্য লেখা - কাউকেই অবহেলা করা যায় না।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় আমার চিত্তজগতে তাই সতত বিরাজমান, স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই।