বিবিধ

শূন্য থেকে শুরু [পুস্তক পরিচিতি]



সুদীপ কুমার ধর


একটা সময় ছিল, যখন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জ্যোতি বসু আর শেষের পাতায় টুটু বসু। প্রথম পাতায় থাকত রাজনীতির খবর, যা জ্যোতি বসুকে বাদ দিয়ে করা যেত না আর শেষের পাতায় খেলার খবর, যা টুটু বসুকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব হতো না।

টুটু বসুর পোষাকি নাম স্বপন সাধন বোস। জন্ম ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪৭ সাল। নামকরণ সার্থক, কারণ সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে রূপদান করেছেন। শূন্য থেকে শুরু করে ফিনিক্স পাখির মতো উত্তরণ। ধুলোকে সোনা করা, পরাজয় থেকে বিজয়ীর আসনে বসা, একমাত্র টুটু বসুর পক্ষেই সম্ভব ছিল, যিনি কিনা আদ্যন্ত অন্য ধাতুতে গড়া।

হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর লেনের বনেদী বাড়ির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্রের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে, বাবাকে কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে টাকা ধার করতে দেখেছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে পারিবারিক ব্যবসার ৪৪ শতাংশের অংশীদারিতে বরাদ্দ হয়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। এইখানেই সফলতার বীজ বোনা ছিল। কথায় আছে, রুক্ষ আবহাওয়ায় ও অনুর্বর মাটিতে একটা সফল জাতি গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সুতীব্র বঞ্চনা একজন টুটু বসুর জন্ম হতে সাহায্য করে।

হরিসাধন বোসের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গেছি, সেখানে টুটু বসুর সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় বললেন, ‘মন্ত্রীগুলো সব শালা বাঙাল, আইএফএ’র মাথায় বাঙাল, বাঙালগুলো সব ইস্টবেঙ্গলে খেলছে, এক দশক ধরে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারছি, এরপর তো মোহনবাগান দলটা উঠে যাবে’। এই অনুযোগ, সেই সময় একটি ছোট ছেলের কাছ থেকেও পেয়েছিলাম, ‘যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়তাম, তখনও শুনতাম, মোহনবাগান হেরেছে আর এখন দশম শ্রেণীতে পড়ি এখনও দেখি মোহনবাগান হারছে’।

সেই দাবার পাশা একক প্রচেষ্টায় উল্টে দিয়েছেন। বাঙাল খেলোয়াড়দের মোহনবাগানে এনেছেন, কখনও ইস্টবেঙ্গল থেকে খেলোয়াড় ভাঙ্গিয়ে এনে ইস্টবেঙ্গলকে দুর্বল করেছেন, দলে প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় এনে প্রত্যাঘাত করার জন্য তৈরি থেকেছেন। এসবই করেছেন মোহনবাগান দলের সম্পাদক ও পরে সভাপতি হয়ে। এখন তো দেখি, মোহনবাগান জেতে, ইস্টবেঙ্গল হারে।

টুটু বসুর জীবনপথের দিশারী তার দীক্ষাগুরু দাদাভাই। সাফল্যের চাবিকাঠি কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য জেদ, সঙ্গে ছিল স্ত্রীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অফুরান ভালোবাসা। ভারতের সব বন্দরে দখল, কত জাহাজ, বার্জ আছে না জানাই ভালো। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মাছ সব ধরনের ব্যবসায় হাত পাকানো একজন ‘বিজনেস টাইকুন’।

মোহনবাগান ক্লাবের সভাপতি ছাড়াও ওঁনার মুকুটে যে সব পালক জুটেছিল সেগুলি ক্রমান্বয়ে, স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীনে গ্রান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান, চেক প্রজাতন্ত্রের অনারারি কনসুলেট জেনারেল, রাজ্যসভার সাংসদ, সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ-পরিচয় এবং ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর মালিকানা।

ব্যবসার বাইরে ‘মোহনবাগান ক্লাব’ আর ‘সংবাদ প্রতিদিন’ তার প্যাশন, তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব।

পরিশেষে বলি, ইতিহাস জানে, একজন গোপাল কাকাই, একজন টুটু বসুর জন্ম দিয়ে থাকে। প্রসঙ্গত এই গোপাল কাকাই হলেন তাঁর সেই কাকা যিনি টুটু বসুর পরিবারের সঙ্গত অংশীদারি থেকে তাঁদেরকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করেছিলেন।

বাঙালি ব্যবসা জানে না, এর যোগ্য জবাব টুটু বোস। তোমার লক্ষ্মী আজ তোমার পাশে নেই, জীবন নৌকার পাল তুলে তরতর করে এগিয়ে যাও, আমরা তোমার পাশে আছি।

শূন্য থেকে শুরু
স্বপন সাধন বোস
প্রকাশকঃ প্রতিদিন
প্রকাশকালঃ ২০২৩
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৫৬
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা