বিবিধ

পরমহংসদেবের খানা-তল্লাশি



শিখা কুমার


শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যিনি আপামর বাঙালি ও ভক্তদের কাছে ছিলেন ঠাকুর, যুগাবতার এক সাধক। তাঁর খানাতল্লাশি করতে বসেছি আজ। না, না, ভুল বুঝবেন না, এতবড়ো সাহস আমার নেই, খানা বলতে খাদ্যের কথা বলছি। ঠাকুর মজা করতেন, তাই আর কি। আমাদের প্রাণের ঠাকুর কতটা খাদ্যরসিক ছিলেন সেই বিষয়ে কিছু জানা-অজানা তথ্য পরিবেশন করব।

স্বামী চেতনানন্দ লিখেছিলেন ঠাকুর নিজের সাধনা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একঘেয়েমি একদম পছন্দ করতেন না। তাই বলতেন, ‘‘মা আমাকে রসেবসে রাখিস।’’ বলতেন, ‘‘আমার মেয়েলি স্বভাব, আমি মাছভাজা, হলুদ দিয়ে মাছ, অম্বলে মাছ, বাটি-চচ্চড়ি - এই সবেতেই আছি আবার মুড়িঘন্ট, কালিয়া, পোলাওতেও আছি।’’ আমিষ, নিরামিষ সব খাবার তিনি খেতেন। ঠাকুরের বালকোচিত প্রীতি ছিল ফোড়নের উপর। মাকে বলতেন, ‘‘পাঁচমিশালি ডাল করো, এমন সম্বরা দেবে যেন শুয়োর গোঙায়।’’ জিলিপি আর আইসক্রিম ছিল ঠাকুরের ভীষণ প্রিয়। গরম সহ্য করতে না পেরে বরফ খেতেন। ভরপেট খাওয়ার পর বলতেন, একটা সরষে গলা দিয়ে নামার পথ নেই, তবে একখান জিলিপির পথ হবে। কলকাতার ভক্তরা ঠাকুরের জন্য ফল, নানান মিষ্টি, যেমন সন্দেশ, রসগোল্লা, সর-দই, মিহিদানা, ক্ষীর, জিলিপি এসব নিয়ে যেতেন। এসব ঠাকুর নিজে খেতেন ও ভক্তদেরও খাওয়াতেন। মজা করে বলতেন, ‘‘মায়ের নাম করি তো, তাই এসব ভালো ভালো জিনিষ খেতে পাই।’’ এছাড়া সাদা বোঁদে ছিল তাঁর ভীষণ পছন্দের, যেটা শুধুমাত্র কামারপুকুরেই তৈরি হতো।

কামারহাটি থেকে গোলাপের মা আসতেন দেদো সন্দেশ নিয়ে। ঠাকুর বলতেন, ‘‘সন্দেশ আনো কেন পয়সা খরচ করে? নারকেল নাড়ু পাকিয়ে আনবে, লাউশাকের চচ্চড়ি, আলু-বেগুন-বড়ি দিয়ে সজনেখাড়ার তরকারি, তাই আনবে। তোমার রান্না খেতে বড় সাধ হয়।’’

ঠাকুর সকালে প্রসাদি ফলমূল, মিষ্টি ইত্যাদি খেতেন আর রাতে লুচি ও সুজির পায়েস খেতেন। দক্ষিণেশ্বরে গেলে ঘিয়ের তৈরি গুরুপাক প্রসাদ খেতেন না, কারন পেটরোগা মানুষ ছিলেন, বিলিয়ে দিতেন ভক্তদের।

রানিমার (রাসমণি) রান্নাও গ্রহণ করতেন না কারণ তিনি কৈবর্ত ছিলেন। কাজেই হাত পুড়িয়ে সেদ্ধভাত করা ছাড়া উপায় ছিল না।

আর একটা খাবারের কথা না বললেই নয়, তা হল কচুরি। এক বিহারি ফাগু সাহু যার কচুরি ছিল ঠাকুরের বড় প্রিয়। বরানগরের আশেপাশে এক কালীমন্দিরের পাশেই ছিল ফাগু সাহুর নিরামিষ তেলেভাজা ও কচুরির দোকান, যা পরে ‘মুখরুচি’ নামে পরিচিত হয়। এই ফাগু সাহুও ঠাকুরকে খুব যত্ন করে কচুরি খাওয়াতেন সঙ্গে জল ও দু’খিলি পান সহযোগে।

পান ও তামাক দুইই খেতেন ঠাকুর, বটুয়ায় থাকত পান মশলা, আমলকি, জোয়ান, মৌরি, সুপুরি, লবঙ্গ, এলাচ ইত্যাদি।

জীবনের শেষের দিকে যখন উনি ক্যান্সারে ভুগছেন তখন মা যত্ন করে পায়েস, মাংসের সুরুয়া ও পাতলা খাবার দিতেন, তাও মাঝে মধ্যে মুখ নাক দিয়ে বেরিয়ে আসত। মুখের অরুচি কাটাতে আমলকি চুষতেন।

এই অবস্থাতেও একদিন ভক্তদের বললেন, ‘ভেতরে এত ক্ষিদে যে মনে হয় হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি খাই, কিন্তু মহামায়া কিছুই খেতে দিচ্ছেন না’।

এই ছিল রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের খাদ্যাভ্যাস। ওঁনার শ্রীচরণে প্রণাম জানিয়ে, এই লেখায় ইতি টানলাম।