বিবিধ

যাকে দেখে 'মোহিত'



সুদীপ কুমার ধর


আমি তখন কলতলায় চান করছি, একজন মিষ্টি করে বললেন, সুদীপ তোমার বালতিটা একটু সরাবে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোহিত মৈত্র। আমি দ্রুত বালতিটা সরিয়ে নিয়ে ভাবছি, মোহিতবাবু আমার নাম জানলেন কি করে? গত তিন দিন প্রেসিডেন্সি জেলে এসেছি, ওঁনার সঙ্গে তো আমার সেইভাবে পরিচয় হয়নি, অথচ নাম ধরে ডাকলেন! আসলে আমার জায়গা হয়েছে নিউ ওয়ার্ডে আর উঁনি আছেন অন্য ওয়ার্ডে, তাই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ কম ছিল। পরে ভেবে দেখলাম, তিন দিন আগে লর্ডস সিনহা রোডের এস. বি. অফিসে যখন আমাদের মতো রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের জড়ো করা হয়েছিল, ঘরের ভেতরটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভোরের আলো ফুটতে তারজালির জানালার ছোটো ছোটো ছিদ্র দিয়ে যে অস্ফুট আলো এসেছিল, তাতে পরস্পরের মুখ ভালো করে দেখা না গেলেও, আমাদের অবস্থান জানতে পারছিলাম। সেই সময় যতীন চক্রবর্তী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'ভাই তোমার নাম কী?' তখন আমি নাম বলেছিলাম। ওঁনার মতো এত বড় মাপের নেতা তিন দিন বাদেও নামটা মনে রেখেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

নুরুল ইসলাম, আনন্দ হাইতদের রক্তে লাঞ্ছিত ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন রাজ্যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক নেতারা সব কারারুদ্ধ, তখন সত্যজিৎ রায়ের ডাকে শহীদ স্মরণে কলকাতা মহানগরীর বুকে মহা মিছিলের আহ্বান, রাস্তায় শুধু জনতার ঢল, সেই ঢল চলেছে শহিদ মিনারের পথে। মানুষের বাঁধভাঙা জনরোষ ছিল শহীদ স্মরণের যথার্থ তর্পণ।

তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন রাজ্যবাসীকে চালের বদলে কাঁচকলা খাওয়ার নিদান দিয়ে 'কাঁচকলা মন্ত্রী' হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কৃষ্ণনগর, বিশেষ করে নদীয়া জুড়ে গণআন্দোলনের তীব্রতা দেখে প্রফুল্লবাবু মন্তব্য করেন, "কৃষ্ণনগর ডুবুডুবু, নদীয়া ভেসে যায় রে।"

পরের দিন 'দৈনিক বসুমতী'র প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর কবিতা 'শহীদ স্মরণে' প্রকাশিত হয়। জোড়াবাগানের কাউন্সিলর হরপ্রসাদ চ্যাটার্জীর অনুরোধে, ওই কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে শোনাতে হয়। শহীদ মিছিলের রেশ টেনে প্রেসিডেন্সি জেলেও শহীদ স্মরণে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১০৫ জন রাজবন্দীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন মোহিত মৈত্র। প্রধান বক্তা ছিলেন জ্যোতি বসু।

মোহিত মৈত্র ১৯৫৩ সালে কলকাতা করপোরেশনের নির্বাচনে সংযুক্ত নাগরিক কমিটির প্রথম আহ্বায়ক হন এবং সেনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই বছরে ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নিবর্তনমূলক আইনে কারারুদ্ধ হন। ডঃ মেঘনাদ সাহার মৃত্যুতে খালি হওয়া বড়বাজার লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী অশোক সেনকে হারিয়ে ১৯৫৬ সালে লোকসভার সদস্য হন। ১৯৫৭ সালে রাজ্য বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন ও ৩১ আগষ্ট মিছিলে নেতৃত্ব দেবার জন্য গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)-এর পার্টি কংগ্রেসে দলের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন। চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে ভারতরক্ষা আইনে আটক করা হয়, স্বাস্থ্যের কারণে ১৯৬৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পান।

১৯৬৬ সালে যখন আবার জেলে আনা হয়, তখন ওঁনার গলায় ক্যান্সার। ওঁনার পথ্য ছিল, শুধু গলা ভাত। কিন্তু ওঁনাকে দেখে বা কথা বলে, তা বোঝার উপায় ছিল না। পৃথিবীর দেশে দেশে শাসকের একই চরিত্র, শুধু দমন করো। বিরোধী কণ্ঠস্বর হলে, তাকে স্তব্ধ করো। ক্যান্সারের মতো করাল ব্যাধি নিয়ে যে অবিরত জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে, তারও কোনো রেহাই নেই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে মাত্র সাত মাস বেঁচে ছিলেন।

রাজনীতির পাশাপাশি সমান্তরালভাবে সাংবাদিকতার কাজ করে গেছেন, সমাজের যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর কলম ছিল সদা তৎপর। প্রথমে দেশবন্ধু প্রতিষ্ঠিত 'ফরওর্য়াড' কাগজে যোগ দেন, পরে দৈনিক বাংলার কথা'র সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৬ সালে 'ভারতীয় সাংবাদিক সংঘ-এর সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে কুখ্যাত প্রেস এ্যাক্টের প্রতিবাদে তাঁর নেতৃত্বে দীর্ঘদিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার আন্দোলন চলে। ১৯৩৭ সালে 'অমৃতবাজার পত্রিকা'র প্রতিনিধি হিসেবে ওড়িশার রাজন্যবর্গের প্রজাদের ওপর নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী ও ছবি তুলে ধরেন। প্রতিকার চেয়ে এইসব অত্যাচারের তথ্য দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ ও ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোকে পাঠান। এরপর অমৃতবাজারের এলাহাবাদ সংস্করণের সময় তিনি সেখানে যুক্ত হন। এর কয়েক বছর পরে কলকাতা অফিসে আসেন। ১৯৪৯ সালে শরৎচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত 'দি নেশন' পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে 'দেশহিতৈষী' পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচিত গ্রন্থ, 'হিস্ট্রি অফ্ ইন্ডিয়ান জার্নালিজম' (History of Indian Journalism)।

আমার পরম সৌভাগ্য এমন মানুষের সঙ্গ করতে পেরেছিলাম, যেমন ছিল তাঁর পান্ডিত্য, তেমন মধুর স্বভাব।

ত্রিদিব চৌধুরী, মোহিত মৈত্ররা পৃথিবীতে একবারই আসেন। তাঁরা রেখে গেছে্ন পদচিহ্ন, কিন্তু তাঁদের অনুসরণ করার মতো লোক আজ আর নেই।


(উৎসঃ সংসদ বাঙ্গালি চরিতাভিধান।)