বিবিধ

ভাষার মজা, মজার ভাষা



সজল রায়চৌধুরী


ভাষা বিজ্ঞানকে সবাই ডরায়।

কারণ তার ভেতরের ব‌্যাকরণ শিং গুঁতোনোর জন্য তৈরি, এমনটাই ধারণা।

কিন্তু তার একটা শাখা সমাজ-ভাষা-বিজ্ঞান। ভারি মজার ছোটো ছোটো মিস্টি জলের হ্রদ তার পথে পথে ছড়ানো। সেখানে পথিকের সাদর আমন্ত্রণ।

সমাজে ভাষা যে সব কাণ্ড করে, যত বিচিত্রভাবে নানা শ্রেণির মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে সেগুলোই সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের চর্চার বিষয়।

সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মুখের ভাষা যে আলাদা রকম হয়, সেটা বুঝতে শিক্ষিত হওয়ার দরকার পড়ে না। 'নীলদর্পণ' নাটকে নিরক্ষর কৃষক তোরাপ ও অন্যান্য সাথীরা নীলকুঠির গারদে আটকে আছে। এমন সময় দেয়ালের ওপার থেকে শোনা গেল, 'সংবাদ দিবার তো আর উপায় দেখিনে। প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে'। শুনেই তোরাপ বলে, 'ভালো মানসির ছাবাল - মুই কোথায় জানতি পেরিচি'। নিরক্ষর চাষিও 'কথায় জানতি পারে', ওই বক্তা 'ভালো মানসির ছাবাল' অর্থাৎ ভদ্রলোকের ছেলে। সত্যিই ওই কণ্ঠস্বরের মালিক মজুমদার নীলকরের অত্যাচারে পীড়িত সম্পন্ন ও শিক্ষিত মানুষ।

কথায় সামাজিক স্তরের মধ্যে যে প্রভেদ ঘটে, তা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা।

'নীলদর্পণ'-এ একই কৃষক পরিবারের দুই ভাই। বড় ভাই সাধুচরণ বলে, 'আপনিও দেশের মায়া ত্যাগ করুন। গতবারে আপনার ধান গিয়েছে, এইবারে মান যাবে'।

ছোটভাই রাইচরণ নীলকুঠির আমিন সম্বন্ধে বলে, 'আমিন সুমুন্দি যেন বাগ। যে রোক করি মোর দিকে আসছিল, বাবারে মুই ভাবি মোরে বুঝি খালে'।

একই পরিবারের দুই ভাই। ভাষার পার্থক্য দেখুন। সাধুচরণ পাঠশালায় কিছুটা পড়েছে। রাইচরণ নিরক্ষর। প্রথাগত শিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ছাপ এই সংলাপে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে।

প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দেওয়া একটা দৃষ্টান্ত দেখি। উনিশ শতকের শেষ দিকে এক বাঙালি পন্ডিতের বাড়ির কর্তামশাই অনেকক্ষণ ধরে গৃহভৃত্যকে ডাকছেন, 'হরে, হরে।' প্রশান্ত মুখে হরে এসে দাঁড়ালো।

'কী করছিলি এতক্ষন'?

বাংলায় প্রবাদ আছে, পন্ডিতের বাড়ির বেড়ালটাও পন্ডিত। হরে বলল, 'আজ্ঞে আহার করছিলাম'। কর্তা এই উত্তর শুনে খেপে গেলেন। না, দেরি করার জন্য নয়। কেন শুনুন,

'তুই আবার আহার করবি কিরে। শোন, মহারানী ভিক্টোরিয়া ভোজন করেন। বর্ধমানের মহারাজা আহার করেন। আমি খাই, আর তুই গিলিস'।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, 'Death the leveller'। মৃত্যু সবাইকে সমান করে দেয়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? পাড়ার পেঁচো মাতাল নর্দমায় পড়ে পটকায়। রাস্তার মোড়ের ভিখারিটা এবার টেঁসে গেল। হীরুর জ্যাঠামশাই মারা গেলেন। বিশিষ্ট কবি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আশ্রমের সাধুবাবা সাধনোচিত ধামে গমন করলেন। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটে এবং গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।

সমাজ ভাষায় শুধু বক্তা নয়, শ্রোতা ও পরিস্থিতিরও সমান ভূমিকা। শ্রোতা ও বাচনের পরিস্থিতি বদলালে ভাষারও বদল হয়। ধরুন একটা স্কুল। ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে। ছেলেরা হই হই করতে করতে বেরিয়ে গেছে। হেডস্যার নিজের ক্লার্কের সঙ্গে বসে হিসেবপত্র মেলাচ্ছেন, সামনেই অডিট। কোথা থেকে যেন হা হা, হো হো, বেঞ্চি বাজানোর আওয়াজ আসছে। তিনি উঠে করিডোর বরাবর পৌঁছে গেলেন উল্লাসের উৎসে। ক্লাশ নাইন। হেডস্যারকে দেখে ছেলেরা চুপ।

'তোমরা বাড়ি যাওনি'?

'এম. কে. বি. স্যার আমাদের কনফাইন করে গেছেন'।

'তিনি কোথায়'?

'বাড়ি চলে গেছেন'।

'যাও, তোমরা চুপচাপ বাড়ি চলে যাও'।

যে ছেলেটি হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলছিল, এবার তার বাড়িতে আসা যাক। মা একটু অস্বস্তি নিয়েই দরজার গোড়ায় অপেক্ষা করছিলেন। ছেলেকে দেখে - কী রে এতো দেরি হলো যে?

'আর বোলো না। টাকলু স্যার আমাদের কনফাইন করে রেখেছিল'।

মা বলে, 'চুপ চুপ, তোর জেঠু বাইরের ঘরে বসে কাগজ পড়ছেন'।

তাহলে আমরা কী দেখছি? ছেলেটি স্কুলের পরিস্থিতিতে প্রধান শিক্ষকের কাছে কনফাইন করা স্যারকে এম. কে. বি. স্যার বলে উল্লেখ করেছে। বাড়িতে মায়ের কাছে তিনিই হয়ে গেছেন টাকলু স্যার। কিন্তু বাড়ির পরিস্থিতিতে মার সঙ্গে যেভাবে কথা বলা যায়, জেঠুর সঙ্গে সেই লব্জ ব্যবহার করার কথা ভাবাই যায় না। মায়ের সঙ্গে আন্তরিকতা বেশি থাকায় ফচকেমি করা চলে। জেঠুকে সমীহ করে, দূরত্বও কিছুটা আছে। তাই ওই একই লব্জ জেঠুর শ্রুতিগোচর হোক, এটা সে ভাবতে পারে না। মাও বোঝেন, তাই ছেলেকে সাবধান করেন।

এভাবে বক্তা-শ্রোতা স্থান-কালের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সমাজ ভাষা বদলে যায়।

সমাজ ও তাতে ব্যক্তিদের সম্পর্ক কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত বদলায়। তাই বাচনের রূপও বদলায়। কয়েক দশক আগেও বাবু শ্রেণীর লোকেরা ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, ঝাঁকামুটে (এখন বিলুপ্তপ্রায়) - এই ধরণের খেটে খাওয়া মানুষদের 'তুই' বলে সম্বোধন করতেন। ক্ষমতা ও আধিপত্যের থাকবন্দী সিঁড়িতে সবচেয়ে নিম্নবর্গের মানুষরা ওপরের থাকের মানুষদের কাছে তুচ্ছতাবাচক শব্দে অভিহিত হতেন। পরিবারে পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্যের জন্য একসময় স্বামীকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করাই ভদ্রতাসম্মত ছিল।

সমাজের গণতন্ত্রীকরণের আবহাওয়ায় অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমজীবীকে তুমি, এমনকি আপনি বলার রেওয়াজ হয়েছে। স্বামীকে স্ত্রীর 'আপনি' 'আজ্ঞে' করার কথা তো এখন ভাবাই যায় না। এই প্রজন্মের তরুণ দম্পতিরা অনেক সময় কলেজ পর্যায়ের 'তুই' ডাকটাই বজায় রেখেছেন।

একদিকে 'তুচ্ছার্থক' তুই ও অন্যদিকে দূরত্ববাচক 'আপনি' মাঝখানে 'তুমি'-তে এসে মিলেছে। ছোটরা বড়দের 'তুমি' বলে নৈকট্যের কারণে। তুই থেকে 'তুমি'তে উত্তরণ ঘটে মানুষে মানুষে সম্পর্কের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশের ফলে।

একটা অন্য প্রসঙ্গের কবিতার লাইন এখানে মনে পড়ে -
"তুমি যে তুমি ওগো
সেই তব ঋণ,
আমি মোর প্রেম দিয়ে
শুধি চিরদিন"