ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

বিদ্ধাঙ ডায়েরি



সফিউল আলম


রেলি নদী কিশোরীর মতো চঞ্চলা, ভীষণ তাড়া তার, পাথরের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ছুটে চলেছে। নদীর একদিকে বিদ্ধাঙ আর উল্টো দিকে দুন গ্রাম, মাঝে নদীর পাড়েই দুন ভ্যালি রিসর্ট। কালিম্পঙ থেকে কাছেই, মাত্র ১৪ কিমি দূরে। ছোট্ট ছোট্ট কটেজ, ছবির মতো, চারিদিকে উঁচু পাহাড়, গাছে ঢাকা, সবুজের একেবারে মেলা যেন! তাকিয়ে থাকলে স্কুলের আঁকার খাতার ছবির কথা মনে আসবেই। নদী পারাপার এক-দেড় ফুট গভীর জল ভেঙেই করতে হচ্ছে। চওড়ায় কত হবে? আন্দাজ ফুট তিরিশেক। বর্ষায় জল বেড়ে গেলে পারাপারের জন্য আছে একটা 'ওয়ার রোপ' ব্রীজ। একবারই উঠেছিলাম। বেশ ভয়-ভয়ই লাগে, অল্পেই দুলছে। এখানে ওখানে পাটাতন ফাটা, ভাঙা ইত্যাদি। সবসময় মনে ভয়, - ভেঙে পড়ে যাবে না তো!

দুপুরে বিদ্ধাঙ পৌঁছে খাওয়ার পরেই আমরা দু'জোড়া মিলে নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে বেরোলাম। তিনশো মিটারের মতো উৎরাই গিয়েই ডানদিকে যেন লুকিয়ে রয়েছে একটা জলপ্রপাত, ২৫-৩০ ফুট উঁচু থেকে বেশ জোরেই জল পড়ছে। খানিক এসেই সে জল মিশছে রেলির সাথে। যেন দুরন্ত মেয়ে কলকল করে লাফিয়ে পড়ছে মায়ের কোলে! জলপ্রপাতের একটা মোহময়ী আকর্ষণ আছে, আমি কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না। এতো জল, আসছে তো আসছেই! মনে হয় যেন দেখতেই থাকি।

খানিক ঘুরে সেখান থেকে আবার ফেরার পথ, কিন্তু নদীর পাড় থেকে আসতেই ইচ্ছে করছে না যে! তাই উল্টো দিকেও একটু দেখা যাক বলে রওনা দিলাম। হাঁটছি, আর টুকটাক পাথর কুড়োচ্ছি, কোথাও কোনো লোকজনের চিহ্নও নেই। সন্ধে হবো-হবো। পশ্চিমে সূর্যাস্তের রং লাগতে শুরু করেছে। মনোতোষদা সদা সতর্ক, - এই চলো-চলো, আবার কাল হবে, সারাদিন তো আছি।

হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল বছর পঁচিশেকের এক পাহাড়ি মেয়ে। আমরা একটু ঘাবড়েই গেলাম। কোনো ঘরবাড়ি নেই, এখানে এ আবার কোথা থেকে এলো?

প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে লিলিদি আর রীমা অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাব জমিয়ে ফেলল। আর ভাব জমাতে পাহাড়ি মেয়েদের জুড়ি মেলা ভার। মিনিট দশেক বাদে সারমর্ম যা বোঝা গেলো তা এইরকম,

নাম তার ধানো, নদীর বাঁকের ওধারেই তার দিদির বাড়ি, তাদের পোষা গাই এখনও ঘরে ফেরেনি। তাকেই খুঁজতে সে একা এই আধো-অন্ধকারে বেরিয়েছে। প্রচুর কথা বলতে পছন্দ করে সে, ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সে কত কিছু যে জানিয়ে দিল! শেষে আমাদের আশ্বস্তও করলো,

- এখানে নিশ্চিন্তে ঘুরুন আর নদী-পাহাড়-জঙ্গলের মজা নিন।

আর একটি কথাও সে বেশ জোরের সাথেই বললো, এখানে নাকি একবার যে আসে সে আরও একবার আসবেই। দু'দিন থাকার পর কথাটি আমাদেরও একেবারে অমূলক মনে হয়নি!

জিজ্ঞেস করলাম, ভয় করে না?

প্রশ্ন শুনে এতো আশ্চর্য হলোঃ

- ভয়? ভয় কেন করবে?

- না... মানে... এই আধো অন্ধকারে - একা-একা...

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সে ছপ-ছপ করে নদী পেরিয়ে ওপারে জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেল। যাবার আগে অবশ্য আশ্বাস দিয়ে গেল, কাল আবার দেখা হবে, পারলে সে নদীর মাছ খাওয়াবে।

পরদিন সকালেই আবার চারমূর্তির বেরিয়ে পড়া। সেই উচ্ছলা নদী, কয়েকবার এপার-ওপার করা, ইচ্ছেমতো পাথরে বসে জলে পা ডুবিয়ে বসা, সময় কোথা দিয়ে যে বেরিয়ে যাচ্ছে! একবার নদী পেরিয়ে ওপারে হাফ কিমির মতো জঙ্গলের মাঝে হেঁটেও এলাম। কত্ত পাখি! আমাদের অনধিকার প্রবেশে তারা যে খুব বেশি পুলকিত, এমন মনে হলো না। তবুও খানিক কলকাকলির মজা নিয়ে ফিরছি, পাশেই এক লতানো গাছে ফুল দেখে থমকে গেলাম। আরে এ তো পুরো আগুন! কী দেখতে! নীচের দিকটা লালচে, মাঝে কমলা, ডগার দিকে হাল্কা হলুদ। পরে জেনেছি এর বাংলা নাম অগ্নিশিখা, সেটা নাকি আবার রবিঠাকুরের দেওয়া। পটাপট কিছু ছবি নেওয়া হলো।

ফেরার পথে এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো। দেখি চারজন মিলে প্রবল উৎসাহে মাছ ধরছে। খরস্রোতা নদীর পাথর-ঘেরা একটা জায়গায় গাছের ডালপালা দিয়ে ঘিরে তারমধ্যে খালি হাতেই হাতড়ে হাতড়ে চলছে মাছ ধরা। আমরা দেখতে চাইলে দেখালো, চারশো গ্রামের মতো হবে। ট্যাংরা, বাচা, চারাপোনা ইত্যাদি। ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমের ফসল। চারজন তাতেই কী খুশি!

খাওয়ার পর রোদে পিঠ ঠেকিয়ে আমাদের চারজনের আড্ডা চলছে। হঠাৎ লিলিদি বলে উঠল,

- আরে দেখো দেখো, ওই দিকে কী যেন নড়ছে, ভালুকের মতো মনে হচ্ছে!

সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই উৎসুকঃ

- কোথায়, কোথায়?

প্রায় শ'পাঁচেক ফুট ওপরে গাছের ফাঁকে পাহাড়ের একটু ফাঁকা মতো জায়গায় সত্যিই তো কী যেন নড়াচড়া করছে! এত দূর থেকে ঠিক মালুম হচ্ছে না। দ্রুত বেরলো ক্যামেরা, জুম করে দেখে একেবারে থ হয়ে গেলাম। এক বৃদ্ধ ঘাস-পাতা কেটে ঝুড়ি বোঝায় করছে। তারপর ওই ভারী ঝুড়ি পিঠে নিয়ে খাড়া পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। হয়ত এটা তার রোজকার অভ্যস্ত কাজ। কিন্তু টলোমলো পায়ে তাকে নামতে দেখে আমারই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ভয় পেতে শুরু করলাম, এই বুঝি পা পিছলে পড়ে যাবে! প্রায় মিনিট কুড়ি পরে সে যখন অনেকটা নীচে নেমে এলো আমরা সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অবশ্য একটা রহস্যের সমাধান আমার কাছে এখনও অধরা, চারিদিকেই এত গাছ, ছোট-বড়ো-মেজো, কিন্তু ঘাস-পাতা কাটতে অতদূর যাবার দরকারটাই বা কী!

যাহোক, খানিক বিশ্রামের পরেই আবার বেরিয়ে পড়া গেল। সারাটা দিন রোদে-রোদে, পাথরে-পাথরে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে যেন সেই ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম। খানিক জলে পা ডুবিয়ে বসে প্রকৃতির সাথে মাখামাখির চেষ্টাও করলাম। আহ, কী ঠাণ্ডা জল!

বিকেলের দিকে আবার দেখা আগের দিনের সেই ধানোর সাথে, আজ আবার সাথে তার পিসতুতো বোন, শর্মী। দুজনে মিলে গড়গড় করে কতো কী যে বলে গেল। আর হাসতেও পারে দুজনে! আজ যে তার মাছ খাওয়াবার কথা ছিল সেটা অবশ্য দু'পক্ষই সজ্ঞানে বেমালুম ভুলে গেলুম।

রাতের খাবার পর শুক্লা-দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় রিসর্টের উঠোনে হেঁটে বেড়াচ্ছি। নদীর পাড়টাকে কী যে মায়াবী লাগছে! চোখের পাতা ফেললেও মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে ফেলব। যতটা পারি চোখ ভরে দেখে মনের হার্ড ডিস্কে ভরে নিই। লিলিদি প্রস্তাব দিল,

- চলো না, চাঁদের আলোয় নদীর ধারে আর একবার গিয়ে বসি।

মনোতোষদা খানিক বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে তা ফুৎকারে উড়ে গেল। টর্চ আর মোবাইলের আলোয় পথ দেখে নদীর উপরেই পাশাপাশি দুটি পাথরের উপরে বসলাম চারজন মিলে। তারপর ঘন্টাখানেক কিভাবে যে কাটলো জানি না! নিজেরাও কথা বলেছি খুব কম। অপার জ্যোৎস্নার আলোয় চল-চল করে ছুটে চলা নদীকে যেন মনে হচ্ছে গলানো রুপো! কী তার রূপ, কী তার ছটা! পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ছলাৎ-ছলের সাথে হালকা জল-কনা উড়ে উড়ে গায়ে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

আর নদীর দু'পারের কথা কী আর বলি! অল্প হাওয়ায় গাছগুলি দুলছে, জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় মনে হচ্ছে, কারা যেন সব আসর জমিয়েছে, মাথা দুলিয়ে আড্ডা মারছে। দু'চোখ দিয়ে সে সব গিলছি আর ডুবে যাচ্ছি অদ্ভুত এক ভালো লাগায়। এ জিনিস শুধু দেখার নয়, অনুভব করার।

চটকা ভাঙলো রীমার ধমকেঃ

- রাত প্রায় বারোটা বাজে, খেয়াল আছে?

আরে তাইতো, চরাচর নিঃঝুম! এবারে যেন একটু ভয় ভয়ই লাগছে। আমরা বোধহয় একটু বেশিই সাহসী হয়ে পড়েছি। তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম ঘরে। তবে এই এক ঘন্টায় যা সম্পদ সঞ্চয় করে নিলাম, তা ফুরোবার নয়!

দু'দিন এখানে কাটিয়ে বুঝলাম, এখানকার সাধারণ লোকেদের জীবন অত্যন্ত সরল, কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই। অত্যন্ত অল্পেই এরা সন্তুষ্ট, জীবনে তাই কোনো তাড়াও নেই। ছোট্ট একটা ঘরে সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু খাবার দরকার তার বন্দোবস্তু হয়ে গেলেই কত খুশি! আচ্ছা, সবাই যদি এমন হতো খুব কি খারাপ হতো?

পরদিন সকাল ১১টা নাগাদ যখন বিদায় নিচ্ছি, সত্যি বলছি, বড়ই খারাপ লাগছিল। এই অপরূপ প্রকৃতি, এই সহজ জীবন, এই পাখিদের কলকাকলি, এই রাতের জ্যোৎস্না-মাখা নদী, তোমাদের বড়ই মিস করব। কথা দিলাম, সম্ভব হলে আরও একবার আসব, আসবই।