ভ্রমণ ও দেশ-বিদেশ

সিকিম - ঈশ্বরের বাসস্থান [Sikkim - The Abode of God]



অনুসোমা দাস


হ্যালো মা! আমি ছুটিতে বাড়ি আসছি। পরীক্ষা শেষ। চলো না কোথাও বেড়িয়ে আসি। কোন পাহাড় বা জঙ্গল প্ল্যান করো। প্লিজ প্লিজ!

পাহাড় বেষ্ট। সিকিম যাওয়া যেতে পারে। কি বলিস?

দারুন! একদম। তাহলে এবার সিকিম। ইয়ে ইয়ে ইয়ে...

আমার একমাত্র কন্যা অহনা, ডাকনাম তিন্নি। দিল্লিতে পড়াশোনা করে। তার আবদার রাখতে এবার আমরা সপরিবারে ঘুরে এলাম সিকিম। যা প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে এক স্বর্গ।

সিকিম উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য এবং উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। রাজধানী শহর গ্যাংটক, আয়তনে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশ। ভৌগলিক সীমানা হিসাবে এর উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে তিব্বত, পূর্বে ভূটান, পশ্চিমে নেপাল ও দক্ষিণে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। এবারে আমাদের গন্তব্য ছিল উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ সিকিম। পশ্চিম সিকিম সময় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় জনিত কারণে এবার আর দেখা হল না। তবে একজন প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপ্রেমী হিসাবে আমি ভবিষ্যতে আবারও সিকিম ভ্রমণের সুযোগ যে হাতছাড়া করব না এটা বলাবাহুল্য। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, যে এটি আমাদের দ্বিতীয়বার সিকিম ভ্রমণ। এর আগে আমরা ২০১৩ সালে পূর্ব সিকিম ঘুরে এসেছিলাম। তাই এবার আর সেদিকে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। যারা এখনও সিকিম যাননি তাদের জন্য বলি অবশ্যই তাঁরা যাবেন। পূর্ব সিকিমের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলি হল নাথুলা গিরিপাস, জেপ্লা পাস, ছাংগু লেক ও বাবা মন্দির। নাথুলা পাসের উচ্চতা ১৪,৫০০ ফুট, তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।


Nathula Pass, East Sikkim

এর আগেও আমরা বহুবার ভারতে অবস্থিত বহু পাহাড় - পর্বত অধ্যুষিত অঞ্চল ভ্রমণ করেছি, কিন্তু এবারের সিকিম ভ্রমণ একটু অন্যমাত্রায় মনের কোণায় আলাদা দাগ কেটেছে। বেশ রোমাঞ্চকর সেই অভিজ্ঞতার কিছু মুহূর্ত আমি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি।

৮ মার্চ, ২০২৩ বুধবার সকালে বেড়িয়ে পড়লাম সিকিমের উদেশ্যে। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইটে যাত্রা শিলিগুড়ির বাগডোগরা এয়ারপোর্ট। সেখানে আগে থেকেই গ্যাংটক-এর জন্য গাড়ি বুক করা ছিল। এইসময় সিকিমে খুব ঠাণ্ডা, তাই লাগেজ একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। তপন, আমার হাজব্যান্ড, একটু ঠাণ্ডা ও শান্ত স্বভাবের মানুষ। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বেজায় চটেছিল, লাগেজের সংখ্যা দেখে।

সেবক রোড ধরে আমরা চললাম গ্যাংটকের পথে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে বেশ মজা লাগছিল। ঠাণ্ডার লেশমাত্র নেই। আমি বরাবরই গাড়ির ফ্রন্ট সিট পছন্দ করি। আর একটি মুখ্য কারণ ফটোগ্রাফি। তাই চারপাশের দৃশ্য দেখতে-দেখতে আর ছবি ক্যামেরাবন্দী করে এগিয়ে চললাম। আমার শরীরটা বিগত কয়েকদিন ধরে ভালো না থাকায়, একটু ক্লান্তিজনিত কারণে চোখ বুঁজে এসেছিল, হঠাৎ তিন্নি বলল, মা ওই দ্যাখো! বেঙ্গল সাফারি, নামবে? যাবে? ওকে বোঝানো হল যে এইভাবে হয় না। এর জন্য আগে থেকে অনলাইন সাফারি বুকিং করতে হয়। কিন্তু জানতে পারলাম এখানে সাফারির মাধ্যমে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাঘ ও হাতি দেখতে পাওয়া যায়। এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না তাই তিন্নি একটু হতাশ হল। কিন্তু নিরাশ তিন্নি একটু পরেই খুশিতে ভরে গেল তিস্তা ড্যাম দেখে এরপর বিখ্যাত করোনেশন ব্রিজের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমদের গন্তব্য এই দিকে ছিল না, কিন্তু ব্রিজের উপর দাঁড়ালে তিস্তা ভিউ খুব সুন্দর দেখা যায়, তাই নেমে এগিয়ে গেলাম ব্রিজের দিকে। সেখানে বেশি সময় না অপচয় করে ফিরে এলাম। এরপর কালিঝোরার পথ ধরে এগিয়ে গেলাম গ্যাংটক-এর দিকে। এদিকে পেটে তখন ছুঁচোয় ডন-বৈঠক দিতে শুরু করেছে। কালিঝোরা পেরিয়ে আরও ৪৫ মিনিট চলার পর রাস্তায় ‘লীলামনি হোটেল-এ খাবার খেতে নামা হল। খুব পরিষ্কার হোটেল এটি। খাবারের মানও বেশ উন্নত। এখানে খাওয়া- দাওয়া সেরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করে আবার রওনা হলাম। গ্যাংটক-এর পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছলাম সন্ধ্যে ৬-৩০ টা নাগাদ। এই বছর সিকিমে জি-২ সামিট-এর কারণে ভালো হোটেল বা গেস্ট হাউজ পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল। কিন্তু প্রি-বুকিং-এর কারণে আমাদের এইরূপ কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। যাই হোক সেই রাতে আর কোথাও বেরোনো হল না। তিন্নির শরীরটাও ঠিক লাগছিল না, গাটা ছ্যাঁক- ছ্যাঁক করছিল। আমার শরীরটাও বিশেষ ভালো ছিল না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। আবার পরেরদিন অনেক ভোরে আমাদের রওনা হতে হবে। গন্তব্য উত্তর সিকিমের লাচুং। নতুন জায়গা দেখবার উৎসাহ থাকা স্বত্বেও আমার মনটা বেশ খানিকটা অবসাদগ্রস্ত ছিল। হয়ত মেয়েটার অসুস্থতার জন্য। সব যেন ঠিক হয়ে যায় এইরূপ কামনা করে ভগবানকে স্মরণ করে শুয়ে পড়লাম।


(২)


Teesta River

ঠিক যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো। তিন্নি জ্বর বাঁধিয়ে বসলো। ১০২ ডিগ্রি। সর্দি, গা-হাত-পা ব্যাথা। মনটা আমার আরো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। এত লম্বা সফর কি করে মেয়েটা পারবে সেই চিন্তা হচ্ছিলো, সব রকম পথ্য সাথে থাকায় তিন্নিকে জ্বরের ওষুধ খাইয়ে কিছুটা সুস্থ করে পরেরদিন বৃহস্পতিবার আমরা বেশ সকালে আন্দাজ ৬টা নাগাদ রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম লাচুং-এর পথে। লাচুং হল ভারতের সিকিম প্রদেশে অবস্থিত একটি ছোট পাহাড়ি শহর। তিব্বতের সীমান্তঘেরা এই স্থানটি উত্তর সিকিম জেলার মধ্যে অবস্থিত। লাচুং, লাচেন নদী এবং লাচুং নদী থেকে প্রায় ৯,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। লাচেন ও লাচুং উভয় নদীই তিস্তা নদীতে গিয়ে পড়েছে। রাজধানী গ্যাংটক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। সময় লাগে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা।

মেয়েটার শরীর ভালো না থাকায় মনটা ঠিক ভালো ছিল না আমাদের। ওর জন্যই তো বিশেষ করে আমাদের এই ঘুরতে আসা। মেয়েটা আমার শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে যাতে আমাদের আনন্দ বিঘ্নিত না হয় তার পুরো চেষ্টা করে সব মেনে নিচ্ছিল। মা হয়ে সেটা বুঝতে কোনো কষ্ট হয়নি। আমিও সময়মত ওষুধ দিয়ে ওকে চাঙ্গা রাখছিলাম। বললাম, বাবু ঘুমিয়ে পড়। দেখ একটু ফ্রেশ লাগবে।

এদিকে গাড়ি ছুটে চলল গন্ত্যবের দিকে। তিন্নিও খানিকটা সুস্থতা বোধ করছিল।

এবার জানাই আমার যাত্রাপথের কাহিনি।

আগেই জানিয়েছি গ্যাংটক থেকে লাচুং-র দুরত্ব অনেকটাই। আর এই দীর্ঘ পথের দু’ধারের সৌন্দর্য যেন স্বর্গীয়। সর্পিল পাহাড়ি বাঁক আর খাড়া চড়াই-উতরাই এই হল সিকিম-এর ভয়ঙ্করতা। কিন্তু সেই ভয়ঙ্করতার মধ্যেও তার অনাবিল স্বর্গীয় সৌন্দর্য যেন ভগবানের দান। তাই হয়ত বলে, ’সিকিম দা ল্যান্ড অফ্ মিস্টিক বিউটি’।

গ্যাংটক থেকে লাচুং হাইওয়ের পাশে দেখতে পেলাম ক্রমান্বয়ে ‘সেভেন সিস্টার ওয়াটার ফলস’, ‘বাটারফ্লাই ওয়াটার ফলস’ এবং ‘নাগা ওয়াটার ফলস’। এই তিনটির মধ্যে রূপে শ্রেষ্ঠ ‘নাগা ওয়াটার ফলস’। নর্থ সিকিমের তুং চিক পোস্টের কাছে গ্যাংটক থেকে প্রায় ৩৩ কিমি দূরে এটি অবস্থিত। নাগা ফলসে নামামাত্রই এতটাই উৎসাহিত ও মুগ্ধ ছিলাম যে সব ভুলে তরতর করে বোল্ডারের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে সোজা ঝর্নার জলের কাছে পৌঁছে গেলাম। পেছন পেছন তপন এল, কিন্তু তিন্নি একটু ভয় পাচ্ছিলো তাই নামলো না। আমার তো ফিরতেই মন চাইছিল না। আসলে জলপ্রপাতের আলাদা একটা রূপ থাকে, লাবন্য থাকে। আমি শুধু ভাবতে থাকি এই জলরাশি কোথা থেকে আসছে? কিন্তু অগত্যা ফিরতে হল। নইলে অনেক রাত হয়ে যাবে পৌঁছতে। কিন্তু যতদূর দেখা যায় মাথা ঘুরিয়ে দেখি আর উৎস খুঁজি। এমনিতেই পাহাড়ে অন্ধকার তাড়াতাড়ি নামে। তাই বেশ কিছু স্মৃতি ক্যামেরাবন্দি করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। এবার সোজা লাচুং-এর হোটেল।


Naga Waterfalls

রাস্তাতে শুরু হল ঝিরিঝিরি পাহাড়ি বৃষ্টি। গাড়ির ভেতরে থাকায় বাইরে কতটা ঠাণ্ডা সেটা অনুভব করা যাচ্ছিল না। কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা হবে সেটা অনুমান করছিলাম। ড্রাইভার বলল, ’ম্যাডম্ উপরে বরফ পড়ছে কাল রাস্তা খোলা থাকবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না’। তখন এত্ত রাগ হচ্ছিল মনের ভেতর যে কটমট করে তাকালাম ড্রাইভারের দিকে কিন্তু সামলে নিয়ে হেসে বললাম, না না! সব ঠিক থাকবে। ড্রাইভার ভাইটিও যেন আমায় বুঝে ফেলেছে ভেবে একগাল হেসে ফেললো। যাই হোক রাত ৮টা নাগাদ পৌছলাম লাচুং হোটেল।

গাড়ির ভেতর থেকে নামামাত্র রক্ত হিম হয়ে গেল ঠাণ্ডায়। তাপমাত্রা শুন্য(০) ডিগ্রির আশেপাশে সাথে বৃষ্টি আর হিমেল বরুফে হাওয়া। হাত-পা ঠাণ্ডায় জমে বরফ, অবশ হয়ে গেল। দাঁত ঠকঠক করে কাঁপছে, সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। তার মধ্যে লোডশেডিং। যাই হোক নর্মাল ফর্মালিটি পূরণ করে রুমে গিয়ে ঢুকলাম। ততক্ষণে কারেন্ট এসে গেছে। লাচুং বা লাচেনে থাকা-খাওয়ার খুব কষ্ট। মনে মনে ভাবলাম এখানকার স্থানিয় লোকেরা কত কষ্টে থাকে। হোটেলের রিসেপশানিস্ট একটি বাঙালি ছেলে ছিল। সে বেশ হেল্প করেছিল আমাদের। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে নিচে এলাম, সেখানে একটি বাঙালি পরিবারের সাথে পরিচয় হল। কলকাতার ডানলপে থাকে, নতুন বিয়ে হয়েছে। খুব মিষ্টি ব্যবহার। একসাথে গল্প করে ডিনারটা ভালোই কাটল। কিন্তু খাবারে বেশি প্রকার নেই। মাছ-মাংস কিছুই পাওয়া গেল না। খুব খিদে পেয়েছিল অগত্যা ডিম দিয়ে কাজ চালানো হল। তিন্নির একটাও খাবার মনমতো হল না। কিন্তু উপায় নেই তাই অগত্যা মধুসূদন ডিম দিয়েই খেল। ভাল খবর একটা ছিল তিন্নির আর জ্বর আসেনি। তাই আমরাও একটু স্বস্তিতে ছিলাম। দেরি না করে রুমে চলে গেলাম, আগামিকাল আমরা যাব কালাপাথর আর গুরুদোংমার লেক। বর্তমানে আমরা রয়েছি ৯,৬০০ ফুট উচ্চতায়, গন্তব্য ১৯,০০০ ফুট। আগামিকালের স্বপ্ন চোখে নিয়ে, ক্লান্তিতে চোখে ঘুম নেমে এল।


(৩)

পরেরদিন শুক্রবার, সময় ভোর ৫টা। তাপমাত্রা -২ ডিগ্রি। হোটেলের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলির ওপর তুষারের চাদর। যেখানে সেখানে বরফ ছড়িয়ে রয়েছে। জানলা দিয়ে তুষার ধবল পর্বত শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছিল। বাইরে ঠাণ্ডার পরিমাণ অনুমান করে নিজেদের যথাসাধ্য গরম জামাকাপড়ে মুড়ে আমরা রওনা হলাম। সময় সকাল ৭টা, গন্তব্য ১৯,০০০ ফুট উচ্চতায়, গ্রেট হিমালয়ে অবস্থিত গুরুদোংমার লেক যেটি পৃথিবীর উচ্চতম লেকগুলির মধ্যে একটি। আমাকে নিয়ে তপন একটু চিন্তায় ছিল কারণ আমার শরীর। ক'দিন ধরেই আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল আর পাহাড়ে আরও বেড়ে গিয়েছিল। ইনহেলার ব্যবহার করছিলাম কিন্তু কষ্টটা থেকেই গেছিল। অক্সিজেনের প্রয়োজন হবে সেটা মাথায় রেখেই আমরা রওনা হলাম। ড্রাইভার ভাইটি বুঝতে পেরে বারবার কর্পূর শুঁকতে বলছিল, তাতে বেশ উপকার পেয়েছিলাম। উপরে নাকি খুব স্নো-ফল হয়েছে গতরাতে। তার প্রমাণ যেতে যেতেই পেলাম। এক নৈসর্গিক দৃশ্য। আকাশচুম্বী পর্বতমালা যেন বরফের চাদরে মোড়া। চারিদিকে পাইন, ফার আর ম্যাপলের পাতার উপর পেঁজা তুলোর মতো ঝুরো বরফ, আর বরফে ঢাকা পর্বত শিখরে সূর্যের সোনালি আলো ঝলমল করছে। কি অপূর্ব।


Kala Patthar

এইভাবে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এসে পৌঁছলাম ‘কালাপাথর’ বা ‘ব্ল্যাক রক’, যার উচ্চতা ১৫,০০০ ফুট। এটি নর্থ সিকিমের বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট। এখানে চেক পোস্টে কিছু কাগজে নিয়মকানুন সাড়া হল। হাতের আঙুল অসাড়। এতটাই সাড়শূন্য যে একজনের ধাক্কা লেগে আমার হাতে এক কাপ গরম চা পড়ে গেল। আমার কোনো মালুম হল না আর কোনো জ্বালা- যন্ত্রণা অনুভব করলাম না। এরপর গরম গরম চা-বিস্কুট আর ম্যাগি খেয়ে একটু গা গরম করলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সাথে হিমেল হাওয়া। তাপমাত্রা তখন -৫ ডিগ্রির পারদ ছুঁয়েছে। কিছুটা হেঁটে উপরে উঠলাম। তিন্নি আর তপন বরফে খেলতে লাগলো। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মাথা ঘুরে ২ বার মাটিতে পড়ে গেলাম। বুঝলাম আমি বেশি উৎসাহ দেখালে বিপদ হবে। তাই শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম আর ফটো তুলতে লাগলাম। এখান থেকে লাচুং নদীর উপত্যকার দৃশ্যটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। একটি সুতোর মতন জলরেখা দেখা যাচ্ছে আর বাকিটা পুরো বরফের চাদরে ঢাকা। মনে হচ্ছিল সাদা কাগজে পেন্সিল স্কেচ। ফেরার পথে সেই চায়ের দোকানে আবার গেলাম। ভূগোলের ছাত্রী ছিলাম তাই মনে অনেক কৌতূহল ছিল। চা- কাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম এই পর্বতের নাম কি? যদিও এটি কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের অংশ তবুও কৌতূহল হল। উনি বললেন, রাজা পর্বত ও রানী পর্বত। তিব্বত সীমান্তবর্তী তাই হয়ত ওখানকার রাজা-রানির কে উৎসর্গ করে এইরূপ নামকরণ। উত্তর মনপুতঃ না হলেও স্থানিয় মান্যতাকে আমিও মান্যতা দিলাম।


Lachung River (view from Kala Patthar)

এরপর ড্রাইভার ভাইটি আমাদের ফিরে আসতে বলল কারণ এবার আমরা যাবো গুরুদোংমার লেক। শ্বাসকষ্ট অনুভব করায় আমি কর্পূর শুঁকে চোখ বুঁজে রইলাম, একটু হয়ত ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম আবার এক বিশাল চেক পোস্ট। ঠাণ্ডা যেন গা-সয়ে গেছিল। আর সেইরকম ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছিল না। বরফ ধরার পর হাতের লীন তাপও স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। আমি প্রাণ ভরে ফটো তুলছিলাম। কিন্তু এখান থেকে আমার জন্য পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার নেওয়া হল। তপন বলেছিল, থাক আর উপরে যেতে হবে না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা তাই যেতেই হল। আর যদি জিদ করে আমি না যেতাম তাহলে অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যেত।

চেক পোস্ট পেরিয়ে চললাম গুরুদোংমার-এর পথে। একদিকে বরফে ঢাকা পর্বতমালা আর আরেকদিকে একদম গাছবিহীন ন্যাড়া ব্রাউন পর্বতমালা। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। যেন এটাও একটা মরুভূমি তবে পাথরের। দেখা পেলাম চমরী গাইয়ের। দল বেঁধে ওই ন্যাড়া পর্বতে কি যে খাচ্ছে কে জানে? আমি না কোনও ঘাস, না কোনও গাছ কিছুই তো দেখলাম না! তাহলে খাচ্ছে কী? কৌতূহল চাপতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ড্রাইভার ভাইটি যে তথ্য আমায় দিল সেটা জেনে আমি বেশ অবাক হলাম। শুনলাম এরা নাকি পাথরের ভেতরে একধরনের কীড়া বা পোকা খায়, যেটি প্রোটিনে ভরপুর। ওটাই ওদের খাদ্য।

না! একথা শুনে আমি অবাক হইনি। আমি অবাক হয়েছি এর পরের বাক্যটিতে। এই পোকা যদি মানুষরা খায় তবে তাদের গায়ের রঙ সোনার মত হয়ে যায়, বয়স কমে যায়। অর্থাৎ এককথায় যৌবন প্রাপ্তি হয়। আর এই পোকার দাম প্রায় এক লাখ টাকা। বিদেশিরা নাকি কেনে। সত্যমিথ্যা জানি না, তবে খুব অবাক হয়েছিলাম বটে। যৌবন প্রাপ্তি কে না চায়? তাই বলে এক লাখ টাকার পোকা খেতে হবে? না বাবা থাক! তখন আমার বেস্টফ্রেন্ডের কথা খুব মনে পড়ছিল। একটু ঝগড়া চলছে আমার সাথে তাই মনে হচ্ছিল এই পোকা তাকেই খাইয়ে দি। ভেবেই মনে মনে বেশ হাসি পেল।


Gurudongmar Lake, North Sikkim

একটা দূরত্বের পর আর রাস্তা নেই। অত্যন্ত দুর্গম এই পথ। গাড়ি উঠছে চরাই ধরে। নির্দিষ্ট কোন পথ নেই। একটু অসাবধানতা আর কয়েক হাজার ফুট নিচে। শ্বাসকষ্ট ক্রমশ বাড়তে থাকল। ইনহেলার বা কর্পূর আর কাজ করছে না। তাই আমায় অক্সিজেন দিতে হল। ড্রাইভার বলল, ম্যাডম আপনি গাড়ির মধ্যে থাকবেন কিছুক্ষণ তারপর খুব ধীরে নীচে নামবেন। আমি অক্ষরে অক্ষরে তাঁর আদেশ পালন করলাম। তাপমাত্রা -৮ ডিগ্রি মত। রাতে পারদ -১৪ ডিগ্রিতে নামে। একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর আমি এসে দাঁড়ালাম ১৮,৬০০ ফুট উচ্চতায় এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সামনে। যেন আমার সামনে পটে আঁকা কোনো চিত্রকারের ছবি। ভগবান মনে হয় এখানেই বাস করেন। কি পরম প্রশান্তি, কি স্নিগ্ধতা! আমি রূপমুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলাম তুষারাবৃত পর্বতটির দিকে, নিচে নীল জলের লেক, সূর্যের রশ্মিতে চিকচিক করছে জলরাশি। চারিদিকে সাদা ধবধবে বরফ আর মাঝে নীল জল। আনন্দে আমার দু'চোখ বেয়ে জলধারা নেমে এল। আমার সব কষ্ট ভুলে গেলাম। পর্যটক বলতে সেই সময় সেই স্থানে মাত্র গোটা পঞ্চাশজন আমরা। আমার মনে হচ্ছিল আমি একা। একটা পাথরের উপর বসলাম কিছুসময়, মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে রইলাম। ফিরে আসতে মন না চাইলেও ফিরতে তো হবেই। তাই আবার সেই পথ ধরে নিচে নামতে থাকলাম। হোটেলে ফিরে লাগেজ নিয়ে এবার যাব আর একটি শৈলশহর লাচেন। ওখানে রাত্রিবাস করে পরেরদিন যাব ‘ইয়ুমথাং ভ্যালি’ ও ‘জিরো পয়েন্ট’।

দুপুর ২টো নাগাদ হোটেলে পৌঁছে খাবার খেয়ে রওনা হলাম লাচেনের উদেশ্যে। রাস্তায় দেখা মিলল উচ্চতম একটি জলপ্রপাতের। উচ্চতার কারণে এর নাম ‘অমিতাভ বচ্চন ওয়াটার ফলস’। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে একটি রিল বানালাম সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য। বেশ মজা লাগছিল। তারপর আর কোথাও না দাঁড়িয়ে আমরা সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ লাচেন পৌঁছে গেলাম। তুলনামূলক ঠাণ্ডা এখানে কম। এখানে চিকেন পাওয়া গেল। আমরা রাতে খাবারে ভাত, ডাল, ঝুরো আলুভাজা আর চিকেন খেলাম। খুব ক্লান্ত থাকায় তিন্নি ও তপন ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আমার চোখে তখনও গুরুদোংমার লেক।


(৪)


Amitabh Bachchan Waterfalls

শনিবার সকাল ৬টা। আজ আমরা যাব নর্থ সিকিমের আরও ২টি স্থান, জিরো পয়েন্ট ও ইয়ুমথাং ভ্যালি। কিন্তু তপনের শরীর আজ বিশেষ ভাল নেই। খুব ঠাণ্ডা লেগে গেছে। গায়ে হালকা জ্বর। তবুও উদ্যমের শেষ নেই। সকাল ৬-৩০ টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম। আমরা যেখানে রয়েছি তার থেকে এই স্থানদুটির দুরত্ব বেশ খানিকটা। ২-৩ ঘণ্টার রাস্তা। গতকালের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন কিন্তু তাপমাত্রা -৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই বেশ ভালোরকম সাবধানতা নিয়েই রওনা হলাম।

আজকের অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন ধরনের। মনে হতেই পারে একইরকম তো চারিপাশের ছবি। না! একেবারেই তা নয়। প্রতিটি স্থান তার নিজস্বতা নিয়ে বর্তমান। আজকের চলার পথ বড্ড পাথুরে। পাহাড় কেটে যে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে সেগুলি দোদুল্যমান। এই বুঝি ঘাড়ে এসে পড়ে। আসলে এমনভাবে পাথর কেটে রাস্তা তৈরি করা যে উপরের পাথর গুলি এবড়ো- খেবড়ো হয়ে ঝুলছে। আমি তো খুবই উৎসাহ নিয়ে ওইরকম একটি ঝুলন্ত পাথরের ব্যালকনির নিচে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেছি মাত্র, ঠিক তখনই তপনের অতি কঠোর দৃকপাতে আমার ইচ্ছে কর্পূরের মত উবে গেল।

আরও কিছুদূর এগোনোর পর দূরে একটি টানেল দেখতে পেলাম। ড্রাইভার ভাই জানালো, ২টি পর্বতের মাঝখান দিয়ে একটি নতুন টানেল তৈরি করা হয়েছে সম্প্রতি ২০১৮ সালে চুংথাং অঞ্চলে। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০০ মিটার যেটি সিকিমের দীর্ঘতম টানেল। নাম থেং টানেল। এই অঞ্চলটি রক স্লাইডিং অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণে ‘ইন্ডিয়ান আর্মি’এই টানেলটি বানিয়েছেন। দারুণ একটা রোমহর্ষক অনুভূতি হয়েছিল এই পথ অতিক্রম করবার সময়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমাদের ড্রাইভার ভাইটি ছিল আমার গাইড। অনেক অজানা তথ্য আমি তাঁর থেকেই সংগ্রহ করেছি।


Cherry Flower

গতকাল রাতে প্রচুর স্নো-ফল হওয়ার কারণে আজ বরফের পরিমাণ অনেকটাই বেশিমাত্রায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজ অন্যমাত্রায় সুন্দর। রাস্তার পাশে পাইন-ফারের সমারোহ আর পাতার ডগার ওপর সাদা ঝুরো বরফ বা তুষার। আর পাথরের ওপর বরফ যেন চকোলেটের ওপর মিল্কি বার। অদ্ভূত মোহময় দৃশ্য।এ দৃশ্য লেখা দিয়ে বর্ণনা প্রায় অসম্ভব। রাস্তার পাশে কিছু সামান্য রডোডেনড্রন, ব্ল-বনেট ও চেরি দেখতে পাওয়া গেল। আরেক জাতিয় ফুল গাছ খুব বেশি মাত্রায় ছিল যার স্থানিয় নাম ‘গুরাস’। লাল রঙের থোকা থোকা ফুল ফুটে ছিল। এই ফুলের নাকি দারুণ আয়ুর্বেদিক মুল্য আছে। আমরা যারা মাছ খাই তাদের অনেক সময় গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে গিয়ে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। আর তার থেকে মুক্তি পেতে নানাবিধ উপায় অবলম্বন করতে হয়। শেষে ডাক্তারবাবুরও শরণাপন্ন হতে হয়। এই ফুল নাকি সেই ধন্বন্তরি যা এই বিপদ থেকে মুক্তি দেয়। এই ফুল শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে খেয়ে নিলে নিমেষে মুক্তি। এইরকম অনেক ভেষজের সাথে আমি ভাইটির দৌলতে পরিচিত হলাম। মনে মনে গন্ধমাদন পর্বত আর সঞ্জীবনি বুটির কথাও মনে পড়ে গেল।

পৌঁছুলাম ইয়ুমথাং ভ্যালি বা ‘দা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারর্স’। এটি মূলত তিস্তা নদীর ভ্যালি। আমরা সিজনের আগে গিয়েছি বলে ফুল সমৃদ্ধা ইয়ুমথাং ভ্যালি দেখতে পাইনি, কিন্তু ছোট ছোট চারা দেখা গেছে। অবাক ব্যাপার পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষ‍্য সৃষ্ট নয়। এপ্রিলের শেষের থেকে ফুটতে শুরু করে এরা। অর্কিড, পপি, রডোডেনড্রন, ব্ল-বনেট ও চেরিতে ভরে ওঠে এই ভ্যালি। তাই এর নাম ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্রস’। ফুল নেই, তাই বলে তার রূপের ছটা এতটুকুও কম হয়নি!

আমি তরতর করে নেমে গেলাম ভ্যালিতে। ড্রাইভার পেছন থেকে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ম্যাডাম ধীরে ধীরে, নইলে শ্বাসকষ্ট হবে...

কে কার কথা শোনে? আমি গিয়ে দু’হাত মেলে বড় শ্বাস নিলাম। যেন চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছে হল। আমার বয়স ভুলে বাচ্চা মেয়েটির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকলাম। অনেক কাঠের বেঞ্চ রাখা আছে বসে এই মনোরম দৃশ্য দেখবার জন্য। আমি সোজা গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলাম নদীর পাড়ে। তাকিয়ে রইলাম উপত্যকাটির দিকে। উপত্যকা ঘিরে পাইন আর ফার গাছ। প্রতিটা গাছের মাথাগুলি বরফে ঢাকা।


Yangtham Valley

আর তখনি ঘটল বিপত্তি। নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারলাম না। হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেললাম, কিছুতেই চোখের জল বাঁধ মানছে না। বুকের ভেতরের জমা কষ্ট যেন কান্না হয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসছে। তপন ও তিন্নি তখন অন্যদিকে। ওদের আসতে দেখে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তপন আমাকে ওইভাবে বসতে দেখে একটু বকাবকি করল। যদি মাথা ঘুরে পড়ে যাই তাহলে সোজা কয়েকশো ফুট নীচে নদীতে। তিন্নি টুক করে আমার ফটো তুলে নিল। নদীতীরে খুব জোরে হাওয়া বইছিল, গা শিরশিরানি ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রায় অনিচ্ছাতেই আমায় ফিরতে হল। হেঁটেই উঠতে হবে আর এবার বুঝলাম সেটা কতটা কষ্টকর। তবুও খুব ধীরে উপরে উঠলাম। এবারের গন্তব্য ‘জিরো পয়েন্ট’।

পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল। হঠাৎ আমার একটি পর্বতে চোখ আটকে গেল। প্রায় জোর করে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম। তপন একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলল না আর গাড়ি থেকেও ওরা দু’জন নামল না। আমি একাই নামলাম আর ড্রাইভার ভাইটি আমার সাথী। পর্বতটি একটু আলাদা দেখতে। যেন মাঝখান থেকে কেউ লম্বালম্বি চিড়ে ফেলেছে। আর সামনে অজস্র বড়বড় পাথরের খণ্ড। বিশালাকৃতি সেইসব খণ্ড। জিগ্যেস করতেই জানতে পারলাম এর রহস্য। ২০১১ সালের ভূমিকম্পের ফলশ্রুতি। তিব্বত সীমানাবর্তী এই পর্বত এইরকম বীভৎসভাবে ভেঙে পড়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল স্থানীয় গ্রাম ও সড়ক। মৃত্যু হয়েছিল শতাধিক। আমি একটি ব্লগ বানালাম তারপর আবার গাড়িতে চড়ে রওনা হলাম।


Way to Zero Point

এরপর এসে দাঁড়ালাম জিরো পয়েন্ট চেক পোস্টে। একটা কথা বলা হয়নি। এই অঞ্চল প্লাস্টিক বর্জিত। তাই কোনো জলের বোতল আমাদের কাছে ছিল না। ধরা পড়লে ১,০০০ টাকা ফাইন। ২০২২ সাল থেকে সিকিম সরকার এই নিয়ম লাগু করেছেন। অগত্যা সব বোতল ফেলে দিতে হল। এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। অবশেষে পৌঁছলাম। এবার বরফের জুতো পরতে ভুল করিনি। সাবলীলভাবেই বরফের পাহাড় চড়ে গেলাম। এর উচ্চতা ১৫,০০০ ফুট। এখানেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তবে আমি আজ অনেক বেশি স্বাভাবিক। তাপমাত্রা -৪ ডিগ্রি। কিন্তু আজ আমার ঠাণ্ডাও লাগছে না। হাতের গ্লাভস খুলে বসে গেলাম স্নো-ম্যান বানাতে। তিন্নিও হাত লাগাল। খালি হাতেই বরফ ধরে বানালাম কিন্তু কোনো অসুবিধা হল না। সাদা মোলায়েম বরফের চাদরে লিখলাম প্রিয় মানুষটির নাম ও অনুভুতি। এটা চিৎকার করে বলতেও মন চাইছিল কিন্তু লজ্জায় আর বলা হল না। ভয়ও লাগছিল যদি আওয়াজে বরফের স্লাইড শুরু হয়। তাই মনে মনেই বললাম। তপন আর তিন্নিও যে যার নিজের মতো করে আনন্দ করছিল। এইবার ফেরার পালা।

একই রাস্তা ধরে আমরা নীচের দিকে নামতে থাকলাম। প্রথমে হোটেল তারপর সোজা গ্যাংটক। এইরকমই পরিকল্পনা। কাল যাবো পশ্চিম সিকিমের পেলিং ও খেচিপালরি লেক। হোটেল পৌঁছে কোনো সময় নষ্ট না করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তার একটি খাবার হোটেল থেকে খাবার খেয়ে এগিয়ে চলেছি গ্যাংটকের দিকে। সময় দুপুর ৩টে। হঠাৎ করেই বিপত্তি। অন্ধকার হয়ে এলো চারিধার। শুরু হল ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি। লাচেন থেকে গ্যাংটকের দুরত্ব প্রায় ১২৫ কিমি। এখনও অনেক পথ যেতে হবে। উপত্যকাগুলিতে যেন কেউ এসে কালো রঙ লেপে দিল। বেশ ভয় লাগছিল। আগেই বলেছি এই রাস্তাটি খুব বিপজ্জনক। এবার শুরু হল পাহাড়ি বৃষ্টি। কি গর্জন তার। ভগবানকে ডাকতে থাকলাম। বৃষ্টির স্বভাবটিও বেশ মজার। কখনও এদিকে তো কখনও ওদিকে। সরু সর্পিল বাঁকযুক্ত রাস্তা। যাওয়ার পথে যেখানে জলধারার নামগন্ধও ছিল না, সেখানে জলপ্রপাতের মত এদিক ওদিক থেকে জল পড়ছে। এইভাবেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। একটু কাদাতে পিছলে গেলেই আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করার জন্য কোন অংশই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যে যেন গভীর রাতের সমান। ভয় হচ্ছিল পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ না হয়ে যায়। একটি কি দুটি গাড়ি দেখা গেল। তারপর আর কোনো গাড়িরও দেখা মিলল না। বেশ কিছু সময় পর বৃষ্টি থামল। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নামলাম। তখনও উপত্যকায় বৃষ্টি পড়ছে। খুব অন্যরকম সেই বৃষ্টি পড়ার শব্দ। পরিস্থিতি খুব বিপদজনক তাই দেরি না করে আবার চলা শুরু। পাথর পড়াও শুরু হল। ভীত সন্ত্রস্ত আমরা সবাই। প্রতিটা মুহূর্তে মৃত্যুভয়। তখন ভগবান ওই ড্রাইভার ভাইটি যার নাম শ্যাম। কিছু সময় পর আমরা একটি জনবহুল গ্রামের কাছে এলাম। রাস্তাও অনেকটা চওড়া। একটু আশ্বস্ত হলাম। এটিও ছিল খুবই বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা এবারের ভ্রমণের।

গ্যাংটক পৌঁছতে রাত্রি ৮-৩০টা বেজে গেল। এখানেও খুব বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এম জি রোড মার্কেটপ্লেস বন্ধ। হোটেলে ঢুকলাম তখন ৯টা বেজে গেছে। ফিরে জানতে পারলাম সিকিম সরকার আগামী সাতদিনের জন্য নর্থ সিকিম, ইস্ট সিকিমের রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছেন, যা আগামীকাল থেকে লাগু হবে। একটু আগে যখন প্রাণ হাতে করে আমরা ফিরছিলাম তখন ভাবতেও পারিনি যারা রয়ে গেল তাদের বিপদ আরও বেশি। স্বার্থপরের মতন ভগবানকে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। বারবার ফেলে আসা ফেরার স্মৃতি তাজা হয়ে উঠছিল।

ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে আগামিকালের প্ল্যান নিয়ে তপনের সাথে আলোচনা করলাম। তখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে।

পেলিং সফর বাতিল করা হল। সকলেরই শরীর খুব ক্লান্ত আর সুস্থ নয়। অপেক্ষা পরেরদিনের সকালের।


(৫)

আজ রবিবার। সময় সকাল ৭টা। গতকাল রাতেই পেলিং যাওয়া বাতিল করা হয়েছিল, তাই ঠিক হয়েছিল আজ গ্যাংটকেই থাকা হবে। সকালে হেলিকপ্টার রাইড আর প্যারাগ্লাইডিং করে বিকালে মার্কেটিং। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে সব বাতিল করা হয়েছে। তাহলে কী হোটেলেই সারাদিন কাটাতে হবে? মনটা খারাপ হয়ে গেল।

তিন্নি তখনও ঘুমোচ্ছে। আমার স্নান সারা হয়ে গেছে। তপন মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। ঠিক এই সময় ড্রাইভারের ফোন এল।

স্যার! আজ কী তাহলে কোথাও যাবেন না? আমি হোটেলে পৌঁছে গেছি।

কোথায় যাবো? সব নাকি বন্ধ। তুমি অপেক্ষা করো, বেলার দিকে বের হবো।

স্যার! নামচি গেছেন? ওইদিকে আবহাওয়া ভালো। যদি যাবেন তাহলে ৯টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ুন। একটা টি-গার্ডেন আছে ওটাও দেখে নেবেন।

ফোন স্পীকারে থাকার কারণে সব কথা আমার কানে এল। আমি দ্বিতিয়বার না ভেবে তপনকে বললাম আমরা যাবো, ওকে বলে দাও। তপন জানিয়ে দিল। চটজলদি সব পরিকল্পনা পরিবর্তন। ঠিক হল আর গ্যাংটক ফেরা নয়, চেক- আউট করে নামচি থেকে সোজা শিলিগুড়ি। আবহাওয়ার কোনো ভরসা নেই, যদি কোনো বিপত্তি হয় তাহলে সঠিক সময় এয়ারপোর্ট পৌছনো যাবে না। তাই শিলিগুড়িতে থাকাতেই মোহর লাগলো। তিন্নিকে তড়িঘড়ি ঘুম থেকে ওঠানো হল। খুব মনখারাপ তিন্নির। হেলিকপ্টার চড়া হল না।

নামচি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান না থাকলেও ওখানে বিখ্যাত একটি চারধাম শিবমন্দির আছে জানতাম। আমরা ৯-০০ নাগাদ রেডি হয়ে নিচে নামলাম। হোটেল থেকে চেক-আউট করবার সময় ওরা ব্রেকফাস্ট প্যাক করে দিল। বেড়িয়ে পড়লাম নামচির দিকে।

নামচি হল দক্ষিণ সিকিমের একটি শহর। শুধুমাত্র পর্যটনস্থল হিসাবে নয় এই অঞ্চলটি তীর্থক্ষেত্র হিসাবে বেশি পরিচিত। আমি পূজো করব বলে উপোস করে থাকলাম। তিস্তাকে পাশে রেখেই চলা। প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কারণে আজ তিস্তার জলোচ্ছ্বাস অনেকটাই প্রবল। তাই অনেকেই ‘রিভার রাফটিং’ করছে। নামচি একটি বড় জনবহুল শহর, অনেক প্রশাসনিক দপ্তর এখানে আছে। এখানকার ‘সেন্ট্রাল পার্ক’এলাকাটি বেশ জমজমাট। জানতে পারলাম, এই মার্কেটে জিনিসপত্র বেশ সস্তা আর বিশেষ করে জুতোর জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের নামিদামি জুতোর ব্রান্ডের ‘ফার্স্ট কপি’এখানে পাওয়া যায়। বাইচুং ভুটিয়া স্টেডিয়াম এই নামচিতেই অবস্থিত। এছাড়া, এখানে একটি হেলিপ্যাডও আছে। কিন্তু সেটি আর্মির।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম আমরা কোনদিকে এখন যাচ্ছি? সে বলল ‘তেমি টি গার্ডেন’ আর এখান থেকে খুব সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়। এরপর যাবো ‘সিদ্ধেশ্বর ধাম’। এই কথা শুনে মনটা খুশি হল। বিগত চার দিন ধরে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি, যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে

আজ দেখতে পাবো। আর মনে মনে বাবা ভোলানাথকে স্মরণ করে চললাম। টি-গার্ডেন ঢোকবার মুখেই ড্রাইভার বলল, ওই দেখুন স্যার কাঞ্চনজঙ্ঘা। ওই-ইইই-টা হল প্রধান শিখরচূড়া...। বলে গাড়ি থামিয়ে আঙুল দিয়ে দেখাল।


Kanchenjongha

সত্যি! কি সুন্দর তার রূপ। মেঘবিহীন আকাশের কারণে পরিষ্কার রোদ ঝলমলে শিখরচূড়া দেখতে পেলাম। প্রাণ ভরে দেখলাম আর অনেক ফটো তুলে ক্ষান্ত হলাম। এখানে একদম ঠাণ্ডার লেশমাত্র নেই। সোয়েটার পরবারও প্রয়োজন ছিল না।

এরপর পাশেই তেমি টি গার্ডেন। চা বাগানের মধ্যে বড় করে লেখা আছে ‘আই লভ তেমি’। ওখানে সবাই ফটো তুলছে। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। ঘুরে ঘুরে চা বাগান দেখার পরে, ওখানেই তপন ও তিন্নি ব্রেকফাস্ট সারলো। আমি উপোস থাকায় কিছুই খেলাম না। এর প্রায় আধাঘণ্টা বাদে আমরা পৌঁছলাম ‘সিদ্ধেশ্বর ধাম’যার স্থানীয় নাম ‘সোলফক চারধাম। পাহাড়ের চূড়ায় বিশালাকৃতি শিব ঠাকুরের মূর্তি অনেক দূর থেকে দেখা যায়। এর ঠিক উল্টোদিকের পাহাড় চূড়ায় রয়েছে বুদ্ধ মূর্তি। যেন দু’জন একে অপরকে দেখছেন। এখানে রয়েছে সিকিমের সবথেকে বড় ‘মনাস্ট্রি' বা ‘বৌদ্ধমঠ। আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলাম। সত্যি চোখ জুড়োনো সৌন্দর্য। যারা যাননি তাদের বলবো অবশ্যই যাবেন একবার। খুব ভালো লাগবে এখানে।


Temi Tea Garden

মন্দির প্রাঙ্গন খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এই চত্বরে রয়েছে ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির যেমন - কেদারনাথ, নাগেশ্বর, বিশ্বনাথ, ঘৃষ্ণেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর, ত্র্যম্বকেশ্বর, সোমনাথ, ভীমশঙ্কর, মল্লিকার্জুন, বৈদ্যনাথ, মহাকালেশ্বর এবং রামেশ্বরম। প্রতিটি মন্দির আসল মন্দিরের আদলে তৈরি। আর রয়েছে ৪ ধাম মন্দির যেমন - বদ্রীনাথ ধাম, পুরী ধাম, দ্বারকা ধাম ও রামেশ্বরম ধাম। পূজো দেবার পর সমস্ত মন্দিরগুলি ঘুরে ঘুরে দর্শন করে নিজের জন্ম সফল করলাম। এই জীবনে এই সকল স্থান হয়ত দর্শন করতে পারব না তাই এক স্থানেই সকলকে দর্শন করার এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনি। এরপর চরণামৃত পান করে ও প্রসাদ গ্রহণ করে আমি উপোস ভাঙলাম। মন্দির থেকে বেরিয়ে কিছু খেলাম। তখন প্রায় সময় দুপুর ২টা। আমরা আর কোথাও না গিয়ে সোজা এলাম জোরথাং। এটি নামচি জেলার একটি মুখ্য শহর। এই শহরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে তিস্তার উপনদী রঙ্গিত। এখানে খাওয়া- দাওয়া করে সামান্য কিছু কেনাকাটা করে আমরা রওনা হলাম। এখান থেকে আমরা শিলিগুড়ির রাস্তা বেছে নিলাম কারণ এখন আমাদের গন্তব্য শিলিগুড়ি। আগামিকাল আমরা ফিরে যাব কলকাতা।


Chardham Temple, Namchi

১২ তারিখ রবিবার ২০২৩, আমার জীবনে অনেকগুলি না ভুলতে পারা দিনগুলির মধ্যে একটি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যে মানসিক প্রশান্তি কাজ করছিল তার পুরোটাই পরিবর্তিত হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের মাটি স্পর্শ করার পর। কতকটা কাকতালীয় মনে হলেও সত্যি। তিস্তা ব্রীজ পার করে সবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করলাম। রাস্তায় সুদূর বিস্তৃত ট্রাফিক জ্যাম। প্রথমে কারণটা বুঝতে পারলাম না কিন্তু তারপর যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছিল না। তিস্তার পাড়ে চোখ পড়তেই নজরে এল ভয়ংকর দাবানল। পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লেগেছে। দাউ-দাউ করে জ্বলছে বিস্তৃত এলাকা। কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের এলাকা জ্বলছে। কোথাও বা শুধু ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। হয়ত আগুনটা এখন ওইখানে নিভে গেছে। ভীষণ একটা টালমাটাল অবস্থা।

তপন গান ধরল...

ওরে ভাই, আগুন লেগেছে বনে বনে
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।
ওরে ভাই, আগুন লেগেছে বনে বনে।...

এ্যাই তুমি কি ভুলভাল গাইছো? ওটা আগুন না ফাগুন হবে। মরণ!! রবি ঠাকুর কে নিয়ে মস্করা না।

আরে! আমি যেটা দেখছি সেটাই তো বললাম।

হয়ত, পরিস্থিতি হালকা করবার জন্যই তপন এইরূপ করেছিল সেটা পরে বুঝলাম। তিন্নির তখন হাসি থামেনি। বলেই চলেছে বাবা আর একবার হয়ে যাক। আমি কটমট করে পেছন ঘুরে তাকালাম।


Wildfire seen from the banks of the river Teesta


Wildfire seen from the banks of the river Teesta

এইসবের মধ্যে হোয়াটস্যাপে আমার এক প্রিয় বন্ধুর সাথে চলছে আত্মসম্মানের লড়াই। ওই যে শুরুতে বলেছিলাম না ঝগড়া চলছে। তাই আগুন তখন শুধু জঙ্গলে নয় আমার মনেও জ্বলছিল। এইসময় হঠাৎ পাথর পড়া শুরু হল। একটা পাথর আমাদের গাড়ির উপরেও পড়ল তারপর ছিটকে পেছনের গাড়ির সামনের কাঁচ ভেঙে দিল। বেশ ধুপধাপ পাথর পড়ছে তখন। আমরা কালিঝোরা তখনও পৌছইনি। পাথর পড়া বন্ধ হলেও বন্ধুটির বাক্যবাণ তখনও সমান লয়ে চলছে। আমি বাধ্য হয়েই কথায় ইতি টানলাম। আগুন লাগা, পাথর পড়া আর একই সময়ে প্রিয় বন্ধুর কষ্টদায়ক আচরণ সত্যিই কাকতালীয়। মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছিল। মাথার আর দোষ কি?

পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলি আমায় বিভীষিকার মত তাড়া করতে লাগলো। ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেল, ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখলাম আমরা প্রায় শিলিগুড়ি পৌঁছে গেছি। আজ আমাদের পেলিং-এ রাত্রিবাস করার কথা ছিল, আর আগামিকাল ওখান থেকেই বাগডোগরা এয়ারপোর্ট। কিন্তু কিছু পরিকল্পনা পরিবর্তনের কারণে আমরা রবিবারই শিলিগুড়ি চলে এলাম। তপনের বন্ধুর হোটেলেই আমরা উঠলাম। রাত্রিটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন সকালে তপনের সাথে ওখানকার বিখ্যাত হংকং মার্কেটে গেলাম। তিন্নি হোটেলেই রয়ে গেল। বেশ কিছু ঘর সাজানোর উপকরণ আর খুঁটিনাটি উপহার সামগ্রী কিনলাম। বেশি দেরি না করে হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্ট-এর উদেশ্যে। রওনা হলাম বাড়ির পথে। ৪৫ মিনিটের আকাশপথের যাত্রায় তখন শুধুই ক্লান্তি আর ফেলে আসা স্মৃতি।‘ সিকিম দা অ্যাবড অফ্ গড’।

মা ওঠো। আমরা কলকাতায় নামব। কি যে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে পড়ো!

একগাল হেসে তিন্নিকে বললাম, না রে বাবু ক্লান্তিতে চোখ লেগে এসেছিল। শরীরটা ভাল লাগছে না।

এই ৬ দিন ৫ রাত্রির সিকিম ভ্রমণ আমার কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যেখানে আমি প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্যের সাথে তার ভয়াবহতাও দেখেছি। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সুন্দর মুহূর্তগুলোকে যেমন উপভোগ করেছি ঠিক তেমনই প্রিয়বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের যন্ত্রণাও উপলব্ধি করেছি। তুষার ধবল পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে মনকে যেমন প্রশান্ত করেছি তেমনি খরস্রোতা তিস্তার পারে বসে নোনা জলে নিজের বুক ভাসিয়েছি। সবমিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতির ভ্রমণ। ওই যে কথায় আছে না... শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। তাই ভালো মন্দের বিচার রইল আপনাদের হাতে।

আমার গল্পটি ফুরোলো নটে গাছটি মুড়োলো।

(এই লেখার সমস্ত তথ্য স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত।)


#SikkimTheAbodeOfGod #Sikkim